You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয়-বাংলা
েমাঃ আব্দুল বাছিত চৌধুরী বি—এ

আজ পূৰ্ব্ববাংলার আকাশ বাতাস “জয় বাংলা” ধ্বনিতে মুখরিত। প্রত্যেক বাঙালীর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে মন্ত্রের মত “জয় বাংলা”।
মনে পড়ে এই ভাবেই একদিন ভারতের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল আর একটি মন্ত্রে। সেই মন্ত্রটি ছিল “বন্দে মাতরম”। “বন্দে মাতরম” উচ্চারণ করে কত বীর মৃত্যুবরণ করেছিল তার ইয়াত্তা নেই। কত প্রবল ছিল সেই মন্ত্রের প্রভাব। মানুষ মৃত্যুকে তুয়াক্কা [তােয়াক্কা] করেনি। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ভারত মাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মুক্তি সগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। তার আন্দোলনের রূপ ছিল অহিংস ও অসহযােগ।।
এবার আমরা নূতন করে প্রত্যক্ষ করলাম পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ববাংলায় অসহযােগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য গণতন্ত্রীয় বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন। গণতান্ত্রিক মূল্যবােধে বিশ্বাসী শেখ মুজিব ঘােষণা করলেন “আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচতে চাই”। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। তারা কোন বিচ্ছিন্নতাকামী দল নয়। শেখ মুজিবের মতে সংখ্যা গরিষ্ঠ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংখ্যা লঘিষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
পশু শক্তিতে বলীয়ান জঙ্গী—শাসক গােষ্ঠী সমগ্র পাকিস্তানের এগার কোটি মানুষের রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে এক বিরাট বাধা। তাই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তার হাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের এই প্রবল গণ আন্দোলনের চাপে বাধা হয়ে জঙ্গী শাসক গােষ্ঠী পাকিস্তানী নাগরিকদের ভােটাধিকার মেনে নিল “One man one vote” এর ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের রায় দেখে মনে হলাে ওটা নির্বাচন নয় ও যেন একটা গণভােট। সমগ্র পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলাে। গণ জাগরণের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন বাধ সাধলাে Peoples Patryর chairman জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাতে সায় দিলেন। ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র। তারা কিছুতেই সহ্য করিতে পারেনা যে শেখ মুজিবের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা চলে যাক, তারা চায় না যে পাকিস্তানে একটা যুগােপযােগী প্রগতিশীল গণতন্ত্র, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থাশীল সরকার গঠিত হােক। নির্বাচনের ফলের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের অন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ্যভাবে জ্ঞাপন করিলেন। ব্যতিক্রম কেবল উগ্রপন্থী ভুট্টো সাহেবের People’s Party, তিনি হুঙ্কার দিলেন রা এপ্রিলের আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রদেশ হতে কোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সদস্য যদি যােগ দিতে চান তবে তাদেরকে গুড়া করে পিষিয়ে দেবেন। এই ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান বাতিল করে দিলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে এই উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজনীয়তাটুকু পৰ্য্যন্ত অনুভব করেন নি। এই ঘটনা থেকে ষড়যন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেল। | শেখ মুজিব জনগণের প্রতি উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানালেন ইয়াহিয়ার এই জঘন্য আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ সবাই যেন অহিংস ও অসহযােগ আন্দোলন শুরু করে। জনগণ এই আহ্বানে বিপুল উৎসাহ সহকারে সাড়া দিল। ধুর্ত জঙ্গীশাসকের ছলনার অভাব হয় না। আলাপ আলােচনার মাধ্যমে এই রাজনৈতিক সঙ্কট অবসানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ইয়াহিয়া খান। শেখ মুজিব বিশ্বাস করে তার সেই আবেদনে সাড়া দিলেন। কিন্তু যে ফল ফলল তা বিষময়।।
আলাপ আলােচনার অজুহাতে ধুরন্ধর সামরিক Dictator ইয়াহিয়া খান কূটচক্রী ভূট্টোর কুপরামর্শ ও প্ররােচনায় সময় কাটাতে লাগলেন এবং ভিতরে ভিতরে সামরিক প্রস্তুতি চলল। রাজনৈতিক সমাধানে প্রায় পৌঁছে গিয়ে হঠাৎ ইয়াহিয়া সাহেব পিছু হটলেন এবং অতর্কিতে ২৫শে মার্চ গভীর রাত্রিতে ভূট্টো সাহেবকে নিয়ে পাড়ি দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তারই আদেশে সেই রাতেই শুরু হল ধর পাকড়, ব্যভিচার ও জুলুম। নিরস্ত্র জনতার উপর সশস্ত্র সেনাবাহিনীর হামলা ও পাইকারীভাবে গণ-হত্যা লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযােগ। জনতা বেশীক্ষণ নির্বিকার থাকতে পারলনা, বাধ্য হয়ে অবস্থার চাপে পড়ে পাল্টা প্রতিরােধ গড়ে তুলল। তাই শুরু হলাে সংগ্রাম মুক্তিসংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

সূত্র: আজাদ, ১৬ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!