You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলায় পাক সেনার পৈশাচিক তাণ্ডব
নির্বিচারে হত্যা-লুঠতরাজ রাহাজানি-বােমাবর্ষণ
প্রত্যক্ষদর্শী বৃটিশ নাগরিকের মর্মান্তিক বর্ণনা

স্বাধীন বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতাে শ্রীহট্ট শহরে এবং মফস্বলে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যে মর্মান্তিক বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে, তার সঠিক এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রদান করেছেন বৃটিশ নাগরিক এবং বৃটিশ পাশপাের্টধারী মিঃ এম, এ, খান এ মুজাহিদ। মিঃ মুজাহিদ ৪ঠা এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটায় সিলেট থেকে পদব্রজে রওয়ানা হন এবং পরদিন দুপুর বারােটায় করিমগঞ্জ পৌছেন। পাকিস্তানী সৈন্যের নরহত্যা, লুঠতরাজ এবং অন্যান্য উৎপীড়নের বিবরণ দেওয়ার সময় মিঃ মুজাহিদ কাঁদিতে থাকেন। মিঃ মুজাহিদের বিবৃতির সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি আমরা নীচে দিলাম।
মার্শাল ল জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিলেটের ডিসি, এস পি, এস ডি ও ও এস ডি পি ও’কে স্ব স্ব গৃহে অন্তরীণ রাখা হয় এবং ২৬ শে মার্চ থেকে কাফু জারী হয়। বৈধ বৃটিশ পাশপাের্টধারী নাগরীকদের মারধাের করা হয় এবং তাদের পাশপাের্ট বাজেয়াপ্ত করে জালিয়ে দেওয়া হয় যার ফলে বাইরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। গােটা স্বাধীন বাংলা জুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভীতি এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সমস্ত বড় বড় দোকান থেকে নগদ টাকা এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সমৃদ্ধ বাড়ি গুলিতেও সেনাবাহিনী গয়নাপত্র লুট করে এবং মহিলারাও অত্যাচারিত হয়। মধ্যে মধ্যে সৈন্যরা মেশিনগানবাহী জিপ এ করে শহরে এবং গ্রামে পাহারা দিতে বেরােয় এবং চতুর্দিকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা করতে থাকে। শহর এবং গ্রামে জনসাধারণের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে যে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ী যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারহাট, রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে, যদিও স্বাধীন বাংলার জন্য সংগ্রামী মনােবৃত্তি এখনও সম্পূর্ণ বজায় আছে।
সৈন্যবাহিনী স্বাধীন বাংলার জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সব সময়ই সচেষ্ট। ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খানের সােনার বাংলাকে শ্মশান করে দেওয়ার হুমকি তারা কার্যকর করেছে। সিলেট শহরে কামান বসানাে হয়েছে। কীনস ব্রীজের উত্তরে একটি কামান বসানাে হয়েছে। দক্ষিণে সুনামগঞ্জ বালাগঞ্জ ইত্যাদির দিক মুখ করে আরেকটি কামান বসানাে হয়েছে। তৃতীয় কামান বসানাে হয়েছে বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, শেওলার দিকে মুখ রেখে এবং চতুর্থটি কদমতলীতে সিলেট কোর্ট, ডি, সি, এস ডি ওর অফিস এবং বৃহৎ হােটেলগুলির উপরের তলায় মেশিনগান বসানাে হয়েছে। যথেষ্ট গুলি চালিয়ে এইগুলির সাহায্যে সৈন্য বাহিনী কয়েক শ লােককে হত্যা করেছে। মার্শাল ল’ চালু হওয়ার পরেই জনসাধারণকে বন্দুক থানায় জমা দিতে বলা হয়। খুব কম লােকেই বন্দুক জমা দেয়। কয়দিন পর বন্দুক থানা থেকে ফেরৎ আনতে বলা হয়। বন্দুকের মালিকরা থানায় গিয়ে জানতে পারেন যে সৈন্যরা থানা থেকে বন্দুকগুলি নিয়ে গেছে।
সমস্ত ব্যাংককে ৩০ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত অর্থ এবং মূল্যবান সামগ্রী জমা দিতে বলা হয়। যে সমস্ত ব্যাংক জমা দেয় নি, সেগুলাে বাজেয়াপ্ত করা হয়। সিলেট জেলার প্রায় সমস্ত ছাপাখানা ধ্বংস করে দেয়া হয়। দুয়েকটি কড়া মিলিটারি পাহারায় রাখা হয়েছে, সেগুলাে থেকে সৈন্যরা নিজেদের ছাপার কাজ করায়। সিলেট শহর থেকে যারা অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পালিয়ে যেতে চায় সৈন্যরা তাদের গয়নাপত্র ছিনিয়ে নেয়। মেয়েদের শ্লীলতাহানী এবং শিশু হত্যার ঘটনাও ঘটছে।
স্বাধীন বাংলা সংক্রান্ত সমস্ত সংবাদই চেপে রাখা হয়। মুক্তিফৌজের অভিযান এবং মরণ সংগ্রামের কথা পাকিস্তান রেডিও উল্লেখ করেনি। আকাশবাণী, বিবিসি রেডিও অষ্ট্রেলিয়া এবং ভয়েস অব আমেরিকাকে ধন্যবাদ তাঁহাদের জন্য শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে সংঘটিত এই অভূতপূর্ব জনজাগরণের সংবাদ বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। মুজিবুর রহমান বর্তমানে সম্পূর্ণ স্বাধীন অবস্থায় এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ঢাকা বা চট্টগ্রামে কোন রেডিও স্টেশন নেই। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেট রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে করাচীর প্রােগ্রাম রীলে করে ঢাকা ষ্টেশনের নাম করে চালাচ্ছে। মৌলভিবাজার এবং সমশের নগর এখন মুক্তিফৌজের দখলে এবং গত ২রা এপ্রিল যথাক্রমে সকাল ৬-৩০ এবং সকাল ৮-১৫ মিনিটে ঐ দুই যায়গায় বােমা বর্ষণ করা হয়। শালুটিকর (সিলেট) বিমানঘাটি বুকিং অফিসে যাত্রিদের ওপর সকাল ৮-১৫ মিনিটে ৩রা এপ্রিল বােমা ফেলা হয়। সমস্ত স্বাধীন বাংলায় আওয়ামী লীগের অফিসগুলি জ্বালিয়ে ফেলা হয়। আওয়ামী লীগের নেতার খুঁজ না পেয়ে তাঁদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গভীর রাত্রে শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, উকীল এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সৈন্যরা গভীর রাত্রে বাইরে ডেকে এনে হত্যা করে।
ও আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঢাকায় কলেজে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বীভৎস গণহত্যার সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। মর্মান্তিক বীভৎসতা নিজের চোখে দেখে সে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলার জনসাধারণের সামগ্রিক নিরাপত্তাই আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। নিরস্ত্র নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমেই আজ সামরিক শাসন তার অস্তিত্ব বজায় রাখছে।
পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে যাদের বৃটিশ নাগরিকত্ব এবং পাসপাের্ট আছে তাদের বি,ও,এ সির বিমানে ইংল্যান্ড যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
সমগ্র বিশ্ব মানবতার কাছে এবং সভ্য সরকারগুলির কাছে এই বিপন্ন মানব গােষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য তিনি আবেদন জানান।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ৭ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!