You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ

গত ২৬ শে মার্চ ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। কিন্তু জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়ার নজীরবিহীন অতর্কিত গণহত্যা ও নির্যাতনের ফলে সমগ্র পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দ তথা জনগণ একে অন্যের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
তারপর মুক্তিফৌজ যখন পশ্চিম পাক সৈন্যদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেন তখন গত ১২ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নবগঠিত সরকারের নাম ঘােষনা[7] করা হয়।
সেই সরকার প্রকাশ্যভাবে জনগণের সামনে দাঁড়ালেন ১৭ এপ্রিল। আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করলেন। মুজিব নগরের একটা আম্রকুঞ্জে মনােরম পরিবেশে এ অনুষ্ঠানটী অনুষ্ঠিত হয়। সভামঞ্চের উপর তিনটি সােফা লাল আর সাদা কাপড় দিয়ে মােড়া। দুপাশে তিনটী কাঠের চেয়ার। সামনে ছােট একটী সাইড টেবিল। মঞ্চের দুপাশে কাঠের ছােট ছােট চেয়ার পাতা। একদিকে বসেছেন অতিথিরা অন্যদিকে আছেন সাংবাদিকরা। একটু দূরে রশি দিয়ে একটী বৃত্ত রচনা করা হয়েছে। বৃত্তের মাঝে সশস্ত্র সৈনিকেরা দাঁড়িয়ে আছেন। বৃত্তের ওপারে দশ সহস্রাধীক দেশভুভিযুক্ত নাগরীকদের ভীড়। আরাে কিছু রাইফেলধারী সৈনিকরা গাছের নিচে ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছেন। শতাধীক বিদেশী সাংবাদিক সভায় উপস্থিত ছিলেন।
নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও গার্ড অব অনার গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঞ্চে এলেন। জনাব ইউসুফ আলী এম-এন-এ স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করলেন এবং একে একে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সেনাবাহিনীর সর্বাধীনায়ক কর্ণেল ওসমানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খন্দকার মােস্তাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব কামারুজ্জামানের শপথ বাক্য পাঠ করালেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার বক্তৃতায় সুশুরুতে বারবার বিদেশী সাংবাদিকদের সত্যপরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, যুদ্ধ তারা চান নি নিয়মতান্ত্রিক পথে শান্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু পাঞ্জাবী সাম্রাজ্যবাদ তা’হতে দেয়নি। জোর করে তাদের উপর মারদাঙ্গা চাপিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা আর হয়নি। রাতের অন্ধকারে পাঞ্জাবী সেনারা অতর্কিতে ছাত্র, বুদ্ধিজীবি, কৃষক, শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যা করতে সুশুিরু করে দিয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি চান বিচার, নতুন রাষ্ট্রের জন্য সহানুভূতি, সাহায্য আর স্বীকৃতি। যুবক, ছাত্র, সেনাবাহিনী, ই,পি,আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুজাহিরদ] এবং দেশের সকল শ্রেণীর স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এত রক্তপাত কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না। জয় তাদের হবেই।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আট পৃষ্ঠার এক বিবৃতি পাঠ করেন। তিনি বলেন, ২৪ শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়ার সর্বশেষ বৈঠক বসে। আলােচনা শেষ হওয়ার আগেই ঐদিন রাত্রেই বাঙালী ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম সামরিক বাহিনী থেকে হঠাৎ সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছে। চরমপত্র নয়, কারফু নয়, হঠাৎ ২৫ শে তারিখ মধ্য রাত্র থেকে মেশিন গান চালানাে শুরু হয়ে গেল। আর পরের দিন টিক্কা খানের ঘােষণার আগেই ৫০ হাজার মানুষকে খুন করা হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলা সরকার পরে এই গণহত্যার স্তৃত বিবরণ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান মরে গেছে, মৃতদেহের পাহাড়ের নীচে তাকে কবর দেয়া হয়েছে। ইয়াহিয়া গণহত্যা চালিয়ে নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়লেন। প্রধানমন্ত্রী নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান। কৃতজ্ঞতা জানান ভারত ও রাশিয়ার জনগণের প্রতি।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২১ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!