You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.10 | পূর্ব পাকিস্তানে অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন- শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান- ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আকস্মিকভাবে স্তব্ধ | দৃষ্টিপাত - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব পাকিস্তানে অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন
শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান- ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আকস্মিকভাবে স্তব্ধ

গত ৭ই মার্চ রবিবার ঢাকা রমনা ময়দানে একটী বিরাট জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান একটা দৃপ্ত ভাষণ দেন। এই ভাষণটী রেডিওতে রীলে করা হবে বলে রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘােষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ ঢাকা রেডিও স্টেশনটী দুপুর দেড় ঘটিকা থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন সকাল বেলা স্টেশনটী খােলা হয় এবং সকাল ৮ ঘটিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার রেকর্ড ঢাকা কেন্দ্র থেকে বাজান হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আগামী ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের সভা ঢাকায় আহ্বান করেছেন। তাতে যােগ দেওয়ার পূর্বে শেখ মুজিবুর চার দফা দাবী উত্থাপন করেছেন। এই দাবীগুলাে পূরণ হলে তবেই তিনি এবং তার দল এই পরিষদের সভায় যােগ দেবেন কিনা বিবেচনা করবেন। এই দাবীগুলাে হচ্ছে ১) সামরিক আইন প্রত্যাহার ২) সৈন্যদলকে ব্যারেকে ফিরে যেতে হবে ৩) গণহত্যার তদন্ত ও ৪) জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবীগুলাে পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অসহযােগ আন্দোলনের আহ্বান দেন।
রমনা ময়দানে ভাষণদান কালে শেখ মুজিবুর বলেন, জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে কোন আলােচনা করার প্রয়ােজন বােধ করেন না। প্রথমে তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারী এই সভা আহ্বানের কথা বলেছিলেন কিন্তু ভুট্টোর কথায় সেই সভাটা প্রেসিডেন্ট ৩রা মার্চ ধার্য করেন। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে কোন পরামর্শ না করেই অতর্কিতে সেই সভাটিও বাতিল করে দেয়া হয়। এতে প্রেসিডেন্টের মতলব অতি সুস্পষ্ট।
তিনি যে অসহযােগ আন্দোলনের আহ্বান দেন তাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ’ আখ্যা দেন। গত ৮ ই মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। সমস্ত শিক্ষায়তন, অফিস আদালত, সেক্রেটারিয়েট সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং এসকল গৃহের চূড়ায় কাল পতাকা উড়ানাে হয়েছে। দিনে দু’ঘণ্টা করে ব্যাংকের কাজ চালানাে হবে তবে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন অর্থ প্রেরণ করতে দেয়া হবে না। সমস্ত প্রকারের কর বন্ধ করে দিতে তিনি আহ্বান জানান। সৈন্য দলের সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়ার আহ্বানে জনগণ সাড়া দিয়েছেন বলে প্রকাশ। ট্রেনেও সৈন্য দলের আনাগােনা বন্ধ করে দেয়ার জন্য আন্দোলন চালানাে হচ্ছে।
শেখ মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগের সদস্যরা জেল আক্রমণ করে বন্দীদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন বলেও প্রকাশ।
শেখ মুজিবুর তার ভাষণে বলেন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের বাড়ীকেই এক একটি দূর্গে পরিণত করতে হবে। যার যতটুকু শক্তি আছে তাই দিয়ে এই অন্যায় অবিচারকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গী শাসনে তার এই ভাষণ হয়তাে বা শেষ ভাষণও হতে পারে, তিনি হয়ত চিরদিনের মতাে চলে যেতে পারেন তাই বলে জনসাধারণকে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। অধিষ্ঠিত হতে হলে সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হবে।
তিনি আরাে বলেন, প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য আমি লালায়ীত নই। আমি চাই জনসাধারণকে অধিষ্ঠিত করতে। আমার প্রতি আপনারা বিশ্বাস রাখুন তাঁর ভাষণ দান কালে হাজার হাজার জনতা চিৎকার দিয়ে তাকে সমর্থন জানান।
এই সাতদিন ব্যাপী অসহযােগ আন্দোলনে যদি চার দফা দাবী মেনে নেওয়া না হয় তা হলে আরাে বৃহত্তর আন্দোলনের কথা আওয়ামী লীগ ভাবছেন এবং তার প্রস্তুতিও চলছে বলে প্রকাশ।
পরবর্তী পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বদেশ রক্ষা ও চরম আত্মত্যাগের আহ্বান জানাবেন বলে ওয়াকিবহাল মহলে আশংকা করছেন। পূর্ব বঙ্গের ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন শাখাকেও তিনি “দেশােদ্ধারের আহ্বান জানাবেন বলে শােনা যাচ্ছে।
বৃটিশ সরকার বৃটিশ নাগরীকদের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল ৯০ জন বৃটিশ পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন। শ’খানেক জার্মানও রওয়ানা হয়ে গেছেন।
নাগরীকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জাপান থেকে একটি বিমান পাঠানাে হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘ ফ্রান্স প্রভৃতি অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতিনীধিদেরও ফেরত নেওয়ার জন্য নিজ নিজ রাষ্ট্র থেকে নির্দেশ এনেছে।
গতকাল ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শ্রীবি, এস, সিদ্দেকী পূর্ব পাকিস্তানের নব নিযুক্ত গভর্ণর লে. জেনারেল টিকা খানের শপথ গ্রহণে অস্বীকার করায় তাহার পক্ষে কাৰ্যভার গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।
কাৰ্য্যতঃ আওয়ামী লীগের নির্দেশেই বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কতিপয় উচ্চ পদস্থ কর্মচারী নিয়ােগেরও সংবাদ পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রসংঘে ইউ, থান্টের নিকট এক তারবার্তায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সংস্থাগুলি আবেদন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশই জটিল আকার ধারণ করে চলেছে।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ১০ মার্চ ১৯৭১