বিভিন্ন বাহিনীর জন্ম ও অপকর্ম ছাত্রলীগ ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারত ভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে বাংলায় মুসলিমলীগ-পন্থী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। কিন্তু সে-সময় ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র না-থাকায় এবং নিজে কলকাতায় বাস করায় তিনি পাকিস্তানের পূর্ববাংলায় ছাত্রলীগ গড়ে তােলায় আগ্রহী হন নি। এমতাবস্থায় ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ ঢাকায় ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করেন। পরে মুজিব ও অলি আহাদের মধ্যে মতবিরােধ হওয়ায় দু’জন দুই রাজনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থান নেন। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের দু-চারজন নেতা-কর্মী এদিক-ওদিক গেলেও সংগঠন হিসেবে তা সবসময় মুজিবের সাথেই ছিল। ১৯৬৬ সালে ৬-দফাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দ্বিধা-বিভক্ত হয়। আবদুস সালাম খান, খন্দকার মােশতাক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রবীন আওয়ামী লীগাররা ৬ দফার বিরােধিতা করেন। ছাত্রলীগই তখন সারাদেশে প্রচার করে ৬ দফাকে জনপ্রিয় করে তােলে। ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে, ১৯৭১ -এর অসহযােগ আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা অনন্য। ২৩ মার্চ ১৯৭১ প্রতিরােধ দিবসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনসহ স্বাধীনতার পক্ষে সে সময়কার নানাবিধ কাজকর্মে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ছাত্রলীগের ষাটের দশকের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সিরাজুল আলম খান রাজনৈতিক পড়াশােনার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে, শেখ ফজলুল হক মণি সবসময় কতিপয় তরুণ আওয়ামী লীগারদের নিয়ে দল পরিবৃত্ত হয়ে থাকতে ভালােবাসতেন। মুজিবের ভাগ্নে হিসেবে তিনি সর্বত্র প্রাধিকার দাবি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১. ১৯৬০-৭২ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের তালিকা নিম্নরূপ : কাল সভাপতিসাধারণ সম্পাদক ১৯৬০-৬৩ শাহ্ মােয়াজ্জেম হােসেন। শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৬৩-৬ ওবায়দুর রহমান, কে এম সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৫-৬৭ সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী। আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৭-৬৮ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৮-৬৯ আবদুর রউফখালেদ মােহাম্মদ আলী ১৯৬৯-৭০ তােফায়েল আহমেদ আসম আবদুর রব ১৯৭০-৭২ নূরে আলম সিদ্দিকী শাজাহান সিরাজ কোনােরূপ প্রাধিকার না পাওয়ায় তিনি বিক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেজন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে কোনােরূপ সহায়তাত করেনই নি বরং সব কাজে বিরােধিতা করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ‘র’ -এর সহযােগিতায় এসব নেতৃবৃন্দ।
মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি (বা পাল্টা) মুজিব বাহিনী গড়ে তােলেন। স্বাধীনতার পর ২১ মে ১৯৭২ প্রথম ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়নকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের চার খলিফা এবং তাদের সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনীর সদস্যরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিদ্দিকী-মাখনের দল শেখ মণি এবং রব-সিরাজের দল সিরাজুল আলম খানের আশীর্বাদ লাভ করে। কিন্তু উভয় দলের প্রার্থীই ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিকট পরাজয় বরণ করে। অল্পদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের নিকট পরাজিত হয়। এরপর সারাদেশে স্কুলকলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের জয়ের হিড়িক পড়ে যায়। উপর্যুপরি এই পরাজয় ছাত্রলীগের মধ্যকার ‘আতঙ্ক, ক্রোধ ও আক্রোশ’ আরও বাড়িয়ে দেয়। উভয় দল মুজিবের সমর্থন লাভের আশায় নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। ২০-২৩ জুলাই ১৯৭২ আহুত হয় ছাত্রলীগের উভয় দলের জাতীয় সম্মেলন। সিদ্দিকী-মাখন সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও রব-সিরাজ পল্টন ময়দানে সম্মেলনের মঞ্চ স্থাপন করে। উভয় দলের পােস্টারে প্রধান অতিথি উদ্বোধক হিসেবে শেখ মুজিবের নাম প্রচার করা হয়। শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেখ মুজিব সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যােগ দেন। আনন্দে উল্লসিত কর্মীরা স্বাধীনতা এনেছি, মুজিববাদ আনব’ শ্লোগানে সম্মেলনস্থান মুখরিত করে তােলে। স্বভাবত এরাই মুজিববাদ” কায়েমের অধিকার পায়। সম্মেলনে শেখ শহিদুল ইসলামকে সভাপতি ও এম. এ. রশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিববাদী’ ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়। অপরদিকে, পল্টনে সম্মেলন আয়ােজনকারীরা মুজিবকে নিতে ব্যর্থ হয়ে তার বিকল্প হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছাত্রলীগ নেতা স্বপনের পিতাকে দিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করায়। এরা মুজিববাদের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘােষণা করে। ২. ডাকসু সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ শহীদুল ইসলাম ও মনিরুল হক চৌধুরী সিদ্দিকী মাখনের এবং আফম মাহবুবুল হক ও জহুরুল ইসলাম রব-সিরাজের সমর্থন লাভ করেন। জাতীয়বাদ (বাঙালি), গণতন্ত্র (সংসদীয়), ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র -এই চারটি মৌল নীতিকে তারা ‘মুজিববাদ’ ঘােষণা করে। মুজিববাদ কায়েম প্রসঙ্গে স্বয়ং মুজিব বলেছিলেন, ‘যদি এটা করতে চাও, তবে আমার মৃত্যুর পরই কোরাে।’
উদ্ধৃত: এ.এল, খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৪ সিরাজুল আলম খানই প্রথম মুজিববাদের প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু ছাত্রলীগের বিভক্তিতে মুজিব অপর পক্ষকে সমর্থন দেয়ার ফলে জনাব খানের পক্ষে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার আর সুযােগ না থাকায় তিনি জাতীয়তাবাদ ছেড়ে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হন। শুধু তাই নয়, মার্কসের অনুকরণে দাড়ি রেখে, লম্বা চুল রেখে (হুমায়ুন আজাদের চোখে যাকে আজকাল ভগবান রজনিশের মতাে দেখায়’) তিনি সমর্থকদের মধ্যে নিজেকে ‘দাদা” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এখন অবশ্য তিনি পুনমূষিক হয়ে বাঙালি জাতীয়বাদের উপর গবেষণা করে বই লেখে ও বছরের অধিকাংশ সময় স্বপ্নের ‘আমেরিকায় বাস করতেই স্বাচ্ছন্দ বােধ করেন। আফম মাহবুবুল হককে সভাপতি ও শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় এ-দলের কমিটি দুটি ভিন্ন স্থানে সম্মেলন অনুষ্ঠান ও দুটি কমিটি করার মধ্যদিয়ে ছাত্রলীগের বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। দু-দলের সংঘর্ষে প্রাক্তন নেতা আবদুর রাজ্জাক ও আসম আবদুর রব সহ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। সংঘর্ষ ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিত্বের সংঘাত প্রথমে নেতৃত্বের কোন্দলে ও পরে আদর্শগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞ মহল এই বিভক্তিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিষবৃক্ষের অঙ্কুরােদগম বিবেচনা করে শঙ্কিত হন। অথচ মুজিব কেন এ কলহ মিটিয়ে না দিয়ে ডাকসুতে দুটি প্যানেল হতে দিলেন বা ছাত্রলীগের দুটি সম্মেলন হতে দিলেন অথবা নিজে একাংশের সম্মেলনে যােগ দিয়ে বিভক্তির আগুনে ঘৃতাহুতি দিলেন তা কারও বােধগম্য হয়নি। দিন যত যাচ্ছিল, দেশে সমস্যা তত বাড়ছিল। সেই সাথে কমছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবের জনপ্রিয়তা। আওয়ামী-পরিবারের একাংশ দল ছেড়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে জাসদ গঠন করলে তা হয়ে উঠে মুজিব-বিরােধীদের কণ্ঠস্বর ও আশ্রয়কেন্দ্র। এই নতুন দল ও এর রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগে বিভক্তি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের স্লোগান ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিজয়ী ছাত্র-ইউনিয়ন নানা কারণে তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি, উপরন্ত সরকারের ‘বি-টিম’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দেয়।
কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা অনুমান করে কতিপয় শস্ত্রপাণি ছাত্রলীগ কর্মী শহীদুল্লাহ হল সহ কয়েকটি হলের ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে। নির্বাচনের ফলাফল কেড়ে নেয়ার শিক্ষা তারা পেয়েছিল মূল দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই, ৭ মার্চের (১৯৭৩) প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে থাকলে সারাদেশ দখলে থাকবে তত্বে বিশ্বাসী হয়ে মােনায়েম খান উপাশ্চার্য ওসমান গনির সহায়তায় এন এস এফ-কে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রাখার চেষ্টা করে। ছাত্রলীগও ঐ দখল-তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ব্যালট ছিনতাই করে জয়ী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা ছাড়াও শাসকদলের ও তাদের মিত্রদের দেওলিয়াপনা জনসমুখে উন্মােচিত করে। এখানেই শেষ নয়, বিশিষ্ট সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর ভাষায় : এরপর পাঁচই এপ্রিলের সেই বিভীষিকাময় দিনটি। মাঝরাতের ব্রাশফায়ারে নিহত হলেন ছাত্রলীগের সাতজন নেতা। তাদের মধ্যে একজন কোহিনূর ছিলেন শেখ কামালের ব্যক্তিগত বন্ধু। গুজব রটল, এরা শেখ মণির সঙ্গে যােগ দিয়ে পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং প্রধান গ্রুপের সঙ্গে একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্যও প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযােগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে পুলিশ ৭ এপ্রিল ১৯৭৪ গ্রেফতার করে।” (তােফায়েলের মাথার উপরেও গ্রেফতারি পরােয়ানা ঝুলছে বলে ঢাকায় গুজব ছিল)। পরে ২৬ জুলাই ২৬ জন ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। দলীয় নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রলীগের একাংশ আন্দোলন শুরু করে। তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রধান সমর্থকরা ১০-১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ অফিসে অনশন করে। ইতােপূর্বে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মূলত ছাত্রলীগের দুই দল ও এদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলেই এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৯ এপ্রিল ১৯৭৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে প্রধান-সমর্থকের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র উদ্ধার করে। এর আগে ১১ জুন বিভিন্ন হল থেকে ২ লাখ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। বলাই বাহুল্য, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য অন্যকোনাে দুষ্কৃতকারীর প্রয়ােজন ছিল না, এক ছাত্রলীগই এজন্য যথেষ্ট ছিল। এদের এসব কার্যাবলি মুজিবকে জনগণ থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও লক্ষ্যভ্রষ্ট করে ফেলে।
মুজিববাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে যুগপৎ পাকবাহিনীর আক্রমণ ও বীর বাঙালির প্রতিরােধ শুরু হয়। কিন্তু আক্রমণের প্রচণ্ডতায় টিকতে না পেরে ক্রমে প্রতিরােধকারীরা প্রথমে গ্রামাঞ্চলে ও পরে ভারতীয় সীমান্তের ওপারে আশ্রয় গ্রহণ করে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক লােক সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থী হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এক লক্ষ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। ওসমানী রাজনৈতিক সচেতন’ ছেলেদের রিক্রুট করার অধিকার দিয়ে এপ্রিল মাসে রাজ্জাক, তোফায়েলকে ‘অথােরাইজেশন লেটার’ দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে রিক্রুটিং ছাড়াও তাদের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন, এর ট্রেনিং ও আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০। মুসলিম লীগ নেতা রাজাকার গমিরউদ্দিন প্রধানের ছেলে শফিউল আলম প্রধান জিয়ার সামরিকশাসনামলে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করে সিরাজ শিকদারের কবরে পুষ্পস্তবক দিয়ে নতুন রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে এবং কিছুদিন পর বায়তুল মােকাররমে সােনার দোকান লুট করতে গিয়ে ধরা পড়ে কয়েক বছর জেল খাটে। [ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল) পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৫২-৫৩]। উল্লেখ্য, এই প্রধান ৩০ মার্চ ১৯৭৪ ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টনে জনসভা করে গাজী গােলাম মােস্তফা, আবিদুর রহমান প্রমুখ ২৩ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ তুলে তাদের বিচার দাবি করে। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৫১পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এসব সুযােগ গ্রহণ করে তারা মুজিব বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনী গড়ে তােলেন। ভারতে এসে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান ‘আট দিকপাল” গােয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং (RAW) -এর বিশেষ সমাদর লাভ করেন। র’-এর সাথে পূর্বে থেকেই তাদের বিশেষ করে শেখ মণির ‘লবি’ ছিল বলে শােনা যায়। উত্তর প্রদেশের দেরাদুনস্থ টানডাওয়া ও আসামের হাফলং -এ মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ, বাসস্থান, খাদ্য, পােশাক সহ যাবতীয় রসদের যােগান ‘র’-এর মাধ্যমে দেয়া হত। জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু ছিল। প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশল প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান।” ভারত-সরকার মুজিববাহিনী গঠন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারের কাছে গােপন রাখে। প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে ‘প্রথম দল বেরিয়ে আসলে এদের নামকরণ হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, পরে মুজিববাহিনী।
তখনই জানা যায়, এরা আলাদা কমান্ডে চলবে; সশস্ত্রবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী, এমনকি বাংলাদেশ সরকারেরও এদের উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এরা সরকার নয়, শেখ মণির প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। শাহজাহান সিরাজের রিপাের্ট মতে : সরকার গঠনের শুরু হতে প্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও মুজিববাহিনীর মধ্যে কোনাে প্রকার সরাসরি যােগাযােগ ছিল না। ভারত সরকারের সহযােগিতায় প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতাদের আপন চেষ্টায় মুজিববাহিনী ট্রেনিং ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা লাভ করেছিল। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন : জাতি যখন সম্পূর্ণভাবে একটি নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান তখন যুবশক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।১৩৮. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৩ ৯. শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আসম আব্দুর। রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। এই আট ছাত্র নেতা। নিজেদের মুজিবের মনােনীত প্রতিনিধি দাবি করতেন। তবে নুরে আলম সিদ্দিকী প্রেম ও বিয়েতে জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিব্বত নিয়ে চীন-ভারত বিরােধের সময় তিব্বতী যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে চীনে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনায় জে,ওবান বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ভারতীয় মিজো ও নাগা বিদ্রোহীদের নাশকতা প্রতিরােধের দায়িত্বেও তিনি কর্মরত ছিলেন।মঈদুল হাসান, মূলধারা ১৯৭১, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা,৭৭-৮০ ১০. শাহজান সিরাজ, সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪১১. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশনা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৬৬ মুজিববাহিনীর নেতারা দাবি করেন ১, সশস্ত্রবাহিনী গড়ে-তােলার ব্যাপারে একমাত্র তারাই শেখ মুজিবের মনােনীত প্রতিনিধি ২. আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে তারাই বিকল্প নেতৃত্ব দেবেন। ৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনাে কারণে দীর্ঘায়িত হলে এতে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে, তাহলেও এদের মােকাবেলায় পাল্টা শক্তি হবে এই মুজিববাহিনী ভারত সরকার সম্ভবত ‘এক বাক্সে সকল ডিম না-রাখার জন্য মুজিববাহিনী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজি মুজিববাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন।
কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি। মুজিব বাহিনী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারপরিবর্তে ওরা মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নেয়া ও আনুগত্য পরিবর্তন করানাে, অন্যথায় তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াতে অধিক সক্রিয় ছিল। আমীর-উল ইসলামও স্বীকার করেন : সামরিক বাহিনীর সাথে মুজিব বাহিনীর, মুজিব বাহিনীর সাথে অনিয়মিত মুক্তিযােদ্ধা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের খুঁটিনাটি বিরােধ দেখা দেয়। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির বৈঠকেও আলােচিত হয়। এ সব নিয়ে আওয়ামী লীগেও অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ২১ ও ২৭ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত দু’টি সভায় আবদুল মমিন তালুকদার, শামসুল হক, নুরুল হক, আবদুল মালেক উকিল, এম এ. হান্নান প্রমুখ নেতা প্রকাশ্যে মুজিববাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে অভিযােগ তােলেন এবং এ বাহিনীকে এক কমান্ডের অধীনে আনার জোর দাবি করেন। ওসমানী আগস্ট মাসে রিক্রুটিং-এর জন্য এর নেতাদের প্রদত্ত্ব প্রাধিকার প্রত্যাহার করেন এবং মুজিববাহিনীকে শিঘ্রই তার কমান্ডের অধীনে না দেওয়া হলে পদত্যাগের হুমকি দেন।” কিন্তু এসবের কিছুই কার্যকরী হয়নি। উপরন্তু তাজউদ্দিনকে | প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরাতে না-পেরে তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং কমান্ডাে প্রেরণ করে। উপায়ান্তর না দেখে তাজউদ্দিন ২২ অক্টোবর এ-বিষয়ে মুজিববাহিনীর সমর্থক সৈয়দ নজরুলের উপস্থিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি অভিযােগ উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ডি পি ধরকে এ-বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন এবং সে মােতাবেক কলকাতায় একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে ভারত-সরকারের পক্ষে মেজর জেনারেল বি এন সরকার ও ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী এবং ১৪. মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯ ১৫. আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৬১৬. . ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৪-৭৫ ১৭. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৬ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮০ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৫মুজিববাহিনীর পক্ষে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদ উপস্থিত ছিলেন। মুজিববাহিনী-পক্ষ নিজেদের আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার ‘একমাত্র অধিকার দাবি করায় বৈঠক ব্যর্থ হয়।
ইতােপূর্বেও ডিপি ধর এবং ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাও -এর সাথে মুজিববাহিনীর স্বতন্ত্র কমান্ড হেতু মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপ্রীতিকর ও ক্ষতিকর দ্বৈত কমান্ড’ বিষয়ে আলােচনা হয়। কিন্তু ভারতীয় পক্ষের নীরব-ভূমিকায় আলােচনা ব্যর্থ হয়।মুজিববাহিনীর নেতৃবৃন্দ শুধু যুদ্ধফ্রন্টে নয়, রাজনৈতিক ফ্রন্টেও সমস্যা সৃষ্টি করে। আমীর-উল ইসলামের ভাষায় :প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভার প্রতি আমাদের যুব সমাজের একটা অংশের বিরূপ মনােভাব ছিল। তারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব মেনে নিতে অনীহা প্রকাশ করছিলেন। যুবকদের এই অংশের কাজ ছিল বিভিন্নভাবে সরকারকে অপদস্ত ও হয়রানি করা। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে কুৎসা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করে।তবে এক পর্যায়ে মুজিববাহিনীর অভ্যন্তরেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেখ মণি সংগঠক, সিরাজুল আলম খান তাত্ত্বিক। এ দুইয়ের সমন্বয়ে মুজিববাহিনী। কিন্তু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে শেখ মণির প্রতি বাহিনীর আনুগত্যের অঙ্গীকারের বিরােধী হন সিরাজুল আলম খান। শুরু হয় দুজনের ব্যক্তিত্বের লড়াই।এ সবের মধ্যদিয়েই সময় এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অনুগত মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ঢাকা তখন এদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মধ্যদিয়ে পথ নির্ধারিত হওয়ায় মুজিববাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। আর ততক্ষণে রচিত হয়ে যায় বিজয়ের ইতিহাস, নির্ধারিত হয়ে যায় যার যার ভূমিকা। ২৬ ডিসেম্বর জেনারেল ওবান ঢাকা পৌছান। এদিনই শেখ মণি মুজিববাহিনীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘােষণা করেন। বিলােপ না করে কোনাে উপায়ও ছিল না। কারণ কুমিল্লা (মাখনের এলাকা) ব্যতীত সারাদেশে মুজিববাহিনীর সদস্যরা ততদিনে ‘শপথ ভঙ্গ করে সিরাজুল আলম খানের অনুগত হয়ে পড়ে। মুজিববাহিনী যত-না যুদ্ধ করেছে, গুপ্তহত্যা করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সিরাজুল আলম খান ক্রমে জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে (প্রকৃত প্রস্তাবে নাৎসিবাদের অনুকরণে) মুজিববাদ’ নামে একটি মতবাদ গড়ে-তােলার প্রয়াস পান।মুজিব বাহিনী মুজিবনগর সরকারকে অপদস্ত ও হয়রানি করা পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজে অন্তরায় হিসেবে কাজ করা ছাড়াও মুজিব ও তার সরকারকে জনগণ২১ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫২ ২৪ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৫ ২৩ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৩।থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
এর সদস্যরা সর্বশেষ রক্ষীবাহিনীতে ও গণবাহিনীতে গিয়ে সর্বনাশের ষােলােকলা পূর্ণ করেছে। রক্ষীবাহিনী মুজিব নগর সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিবাহিনী ছাড়াও মুজিববাহিনী, (ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির) সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনীসহ আরও কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনার ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্কটি মধুর ছিল না। যুদ্ধের পর এর আরাে অবনতি ঘটে। প্রাধান্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোনাে কোনাে স্থানে সংঘর্ষে পর্যন্ত গড়ায়। স্থানে স্থানে কিছু তরুণ অস্ত্র হাতে মুক্তিযােদ্ধা সেজে পরিস্থিতি জটিল করে তােলে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার সাথে সাথে বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী তথা ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বিশেষ করে প্রতিহিংসামূলক কার্যক্রম সংগঠিত হতে না-দেয়ার ব্যপারে ভারতীয় বাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর এই নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষ করে মুজিববাহিনীর পছন্দ হয়নি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে সকল মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। মুজিববাহিনীর সদস্যরা মুজিব ফিরে না-আসা পর্যন্ত অস্ত্র জমাদানে অস্বীকৃতি জানায়। অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্র জমাদানের পর তাদের প্রতি অবমূল্যায়নের আশঙ্কা করে। মুক্তিবাহিনীর অছাত্র সদস্যরা বেকার হয়ে পড়ার শঙ্কায় ভীত হয়। এ সব কারণে অস্ত্র জমাদানের আহ্বান সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে দেশ পরিচালনায় সুযােগদানের জন্য জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ঘােষণা দেন। তাজউদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে ১১-সদস্যের জাতীয় মিলিশিয়া কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করা২৪.সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার সদস্যদের নিয়ে সরকার নিয়মিত বাহিনী’ এবং ছাত্রযুবক, কৃষক-শ্রমিক অর্থাৎ সিভিল সদস্যদের নিয়ে ‘গণবাহিনী গড়ে তুলে। গণবাহিনী জনসাধারণ্যে মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এলাকা-বিশেষে তা “ফ্রিডম ফাইটার’, মুক্তিফৌজ নামেও পরিচিতি পায়। তবে সকল বাহিনী সদস্যদের সাধারণ পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা ২৫. পশ্চাদপসরণ ও পলায়নকালে পাকবাহিনী ও রাজাকার প্রভৃতি বাহিনীর সদস্যরা যত্রতত্র অস্ত্র ফেলে দেয়।
এসব যােগাড় করে কিছু তরুণ ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী সাজে। অচিরেই এরা। ১৬শ ডিভিশন” আখ্যা পায়। পরে ২৬. ২৪-৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাঘা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী, কমরেড মােহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী ও শেখ মণির নেতৃত্বে মুজিববাহিনীর অস্ত্র মুজিবের হাতে সমর্পণ করা হয়। ধারণাকৃত লক্ষাধিক অস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ৩০ হাজার অস্ত্র জমা পড়ে। বাইরে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পরে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাের্ডে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, (উভয় দল), কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস ছাড়াও মুজিববাহিনীর প্রতিনিধি রাখা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ বাের্ডকে কার্যকরী করা হয় নি। আওয়ামী লীগ হয়তাে সরকারি কাজে অন্য দলের শরিকানা চায়নি। পরে ৮ মার্চ ১৯৭২ গ্রাম রক্ষীবাহিনী’ বিলুপ্ত করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের আদেশ জারি করা হয়। ম্যাসকারনহাসের ভাষায় :… ঐ বাহিনীর সকল সদস্যই মুজিবের ব্যক্তিগত আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করত। নামটা খুব শ্রুতিমধুর হলেও, আসলে এই বাহিনী ছিল একধরনের প্রাইভেট আর্মির মতাে এবং হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে এর খুব একটা তফাৎ ছিল না। প্রাথমিকভাবে রক্ষীবাহিনীকে পুলিশের সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনীর (মুজিববাহিনীর) পুরনাে সদস্যদের মধ্যে থেকে বাছাই করা ৮ হাজার লােক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। ২২ জুন ১৯৭২ ঢাকা শহরে অস্ত্র তল্লাশি অভিযানের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। এদের সুযােগ ও কার্য সম্পর্কে বলা হয় : মুজিবের বিরােধিতা দিন দিন বাড়তে থাকলে, তিনি সেনাবাহিনীর সঠিক বিকল্প হিসেবে রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ হাজরে উন্নীত করেন। তাদেরকে মিলিটারি ট্রেনিং, আর্মি স্টাইলে পােষাক, স্টিল হেলমেট এবং আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। এর অফিসারবৃদের প্রায় সকলই ছিল রাজনৈতিকভাবে একই মতাদর্শের সমর্থক। এই বাহিনীকে খােলাখুলিভাবে মুজিব আর আওয়ামী লীগের শক্র এমনকি সমালােচকদের নিধনকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছিল। একসময়েরক্ষীবাহিনী জনসাধারণের মনে প্রকম্পিত সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সময়ান্তরে অত্যাচার-নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, এদের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাইজদি কোটে ৯ জুন ১৯৭৩ হরতাল পালিত হয়।
মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ্ জানাচ্ছেন : দেশবাসীর মধ্যে যেসব সমস্যা বিরাজ করছিল, সামরিক বাহিনীর মধ্যেও তা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ মনােভাব ছিল যে, তারা অবহেলিত। অফিসিয়াল আর্মির পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল।৩০” বাের্ডের সদস্যবৃন্দ হলেন তাজউদ্দিন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী) ২. এ এইচ এম কামারুজ্জামান(স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) ৩, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ) ৪. মনােরঞ্জন ধর (কংগ্রেস) ৫, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ন্যাপ) ৬. কমরেড মণিসিংহ (কমিউনিস্ট পার্টি) ৭. তােফায়েল আহমদ (মুজিববাহিনী) ৮, আবদুর রাজ্জাক (মুজিব বাহিনী) ৯, রফিক উদ্দিন ভূঞা (আওয়ামী লীগ) ১০, গাজী গােলাম মােস্তফা (আওয়ামী লীগ) ও ১১. ক্যাপ্টেন সুজাত আলী (আওয়ামী লীগ) অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩০ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩০ মতিউর রহমান, পনের আগস্ট : পেছনে ফিরে দেখা (নিবন্ধ), প্রথম আলাে, ১৬ ও ১৭ আগস্ট ২০০২ ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে রক্ষীবাহিনীকে বিনা-পরােয়ানায় যে-কোনাে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, রক্ষীবাহিনী এ ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে এবং একপর্যায়ে ‘আইনের আওতা বহির্ভূত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট রক্ষীবাহিনীকে দোষী বলে চরম তিরস্কার করে। সুপ্রিমকোর্ট দেখতে পায় যে, রক্ষীবাহিনী আইন-কানুন, নিয়ম-পদ্ধতি ইত্যাদি কিছুই মেনে চলে। এমনকি গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের কোনাে রেজিস্টারও তাদের ছিল না। কোর্টের তিরস্কারের জবাবে মুজিব ‘ঐ সকল কাজে হস্তক্ষেপ না-করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করেন। তবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন : জাতীয় রক্ষীবাহিনী কোনাে ভালাে কাজই করেনি এ-কথা ঠিক নয়। বিপুল পরিমাণ বেআইনি অস্ত্র এরা উদ্ধার করেছে এবং আটক করেছে প্রচুর পরিমাণ চোরাচালানকৃত পণ্য। কালােবাজারী এবং অবৈধ গােদামজাতকারীরা রক্ষীবাহিনীর নাম শুনেই আতভক্ষ বােধ করত। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করায় এই সুনাম তারা ধরে রাখতে পারে নি।শেষ দিকে রক্ষীবাহিনীর রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়। বাড়াবাড়ির জন্য দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়।
২৫ নভেম্বর ১৯৭৪ রক্ষীবাহিনীর দু’জন লিডারকে চাকুরি থেকে অপসারণ করা হয়। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার ততদিনে হয়ে গেছে। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাসে রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম বিপুলভাবে দায়ী।স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, শুরু থেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর শুরু হয় প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযােগিতা। কোথাও কোথাও কমান্ডাররা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস পায়। এমতাবস্থায় সরকার মুক্তিবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে কোনাে কাজ করা যাবে না বলে ঘােষণা দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ মুজিববাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সকল ইউনিট বাতিল করা হয়।কিন্তু তারপরও অবস্থার ইতরবিশেষ হয়নি। দু’সপ্তাহ পর ১৪ মার্চ ১৯৭২ ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। বাতিল মুজিববাহিনী-সদস্যরাই নতুন নামে পূর্বের অবস্থান গ্রহণ করে।৩১. অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২ মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউনিভারসিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৮৪ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০জাসদ রক্ষীবাহিনীকে ভারতীয় সৈন্য বলেও প্রচারণার প্রয়াস পায়। ‘উ, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮লালবাহিনী আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগের নেতা আবদুল মান্নান বাছাইকৃত শ্রমিকদের নিয়ে লাল বাহিনী গড়ে তুলেন।
বাহিনীর সদস্যদের মাথায় লাল কাপড়ের পট্টি বাধা হত। এ থেকেই এই নাম। এরা কলকারখানায় কাজ না করে রাজপথে কুচকাওয়াজ করে বেড়াত। সময় সময় বিভিন্ন স্থান থেকে লােক ধরে এনে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করত। এদের দৌরাত্ম্য এতদূর পৌছেছিল যে, ৬ দফার অন্যতম প্রণয়নকারী, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, সিএসপি আহমদ ফজলুর রহমান পর্যন্ত তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি। বেগম হাছিনা রহমানের ভাষায় ;অনেকগুলাে লােক গাড়িতে করে এসে আমাদের ধানমণ্ডির (তৎকালীন) ৩০ নম্বর রােডের বাড়িতে ঢুকল। লােকগুলাের চেহারা ছিল গুণ্ডামার্কা, আর তাদের মাথায় ছিল লাল কাপড়ের পঠি বাঁধা। সবাই জানত এরা লালবাহিনীর লােক, আর লালবাহিনী ছিল শ্রমিকলীগের সভাপতি আবদুল মান্নানের নিজস্ব গুপ্তাবাহিনী। এ লােকগুলাে এসে রহমান সাহেবকে জোর করে ধরে টেনে হিচড়ে তাদের গাড়িতে তুলল, তারপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেল।… বঙ্গবন্ধু তখন বাসায় ছিলেন না। হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নাহয় অন্য কোথাও কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমার আকুল অবস্থা দেখে বেগম মুজিবই বঙ্গবন্ধুর কাছে রহমান সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ দেন। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপেই লালবাহিনীর নেতা আহমদ ফজলুর রহমানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।… …পরে প্রকাশ্য জনসভায় রহমান সাহেবের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার মতাে সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিল লালবাহিনীর ঐ স্বঘােষিত নেতা। এসব ঘটনা থেকেই বােঝা যায় যে, হঠাৎ করে লালবাহিনীর নেতার গায়ে হাত দেওয়ার মতাে ক্ষমতা তখন বঙ্গবন্ধুরও ছিল না।শেষপর্যন্ত অবশ্য এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ লালবাহিনীর নেতা ও সাংসদ আবদুল মান্নানকে ঢাকা কটনমিল ব্যবস্থাপনা চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ততদিনে বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।৩৬.হাছিনা রহমান, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও আহমদ ফজলুর রহমান, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা,১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১২৩-২৮
সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান