You dont have javascript enabled! Please enable it!

আগস্ট ক্যু  পাকিস্তানে প্রথম যেদিন সামরিক শাসন জারি হয়, সেদিনই মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। আইয়ুবী আমলের শেষদিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অভিযােগ এনে সামরিক আদালতে তার বিচারকার্য শুরু হয় এবং তাকে সূর্যের আলাে দেখতে দেওয়া। হবে না’ বলে ঘােষণা করা হয়। প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সামরিক শাসনের পাকিস্তানি আমলের অধিকাংশ সময়টাই তার কেটেছে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে কনডেমড সেলে রাখা হয় এবং সেলের পাশেই একটা কবরও খনন করা হয়। ১৯৬৯ ও ১৯৭১ -দু’বারই মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি ফিরে এসেছেন। তিনি নির্যাতিত হয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কালটা জুড়ে। এরূপ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন আপামর জনগণ। ফলে সামরিকবাহিনীর প্রতি মুজিবের একটি স্বাভাবিক ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুজিব বলেছিলেন যে, তিনি একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের বিরুদ্ধে। তাঁর নিজের ভাষায় আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না।” (মুজিব না চাইলেও সে দানবের সৃষ্টি হয় এবং সপরিবারে মুজিবই এর প্রথম শিকার হন)। বেগম মুজিবও সেনাবাহিনীর লােকদের ভীষণ ভয় করতেন। প্রহরারত সৈন্যদের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি স্বামীকে বলতেন, এ সমস্ত লােকেরা একদিন তােমার বিরুদ্ধে তাদের বন্দুক প্রয়ােগ করবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালেই সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেখা দেয়। ছাত্র, যুবক, মুক্তিযােদ্ধা, সামরিক বাহিনী ও আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। সংসদ সদস্য ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করায় সামরিক অফিসাররা অ-খুশি ছিল এবং তারা ওসমানীকে এড়িয়ে চলত। মুজিববাহিনী সৃষ্টি তাদের অবিশ্বাসকে আরও বৃদ্ধি করে। শফিউল্লাহ্ জিয়া ও খালেদ মােশাররফ এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। অপরদিকে যুবকরা মনে করত, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এককালে পাকিস্তানি১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯ ২. এএল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬২ বাহিনীর সাথে থাকায় তাদের ভাবধারায় প্রভাবান্বিত।

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নিম্নোক্ত বক্তব্যেও -এর আভাস পাওয়া যায় : সামরিক বাহিনীর সকল অফিসারের সহযােগিতা ও সম্মান আমাদের অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রতি এদের আস্থার অভাব স্পষ্টতই দেখা যায় ।… ওদের এটাও বুঝানাে দরকার যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধ অচল এবং নতুন দেশ গড়াও অসম্ভব। তাই দেশপ্রেমের তাগিদে যারা অস্ত্র ধরেছেন, একই কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে ওদের কাতারবন্দি হওয়াও উচিত। এ থেকে বােঝা যায়, যুদ্ধকালেই সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আওয়ামী-বিরােধিতার বিষবৃক্ষের অঙ্কুরােদগম ঘটে। অবহেলিত সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে (৭ মার্চ ১৯৭৩) আওয়ামী লীগ মােট প্রদত্ত (৫৫.৬২ শতাংশ) ভােটের ৭৩.২ শতাংশ লাভ করে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টগুলােতে ‘ সৈন্যেরা নির্বাচনে ৮০% ভাগেরও কিছু বেশি ভােট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রদান করেছিল।’ এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সামরিকবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের অবহেলিত মনে। করত। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন : আমরা সত্যিকার অর্থে কোনাে সেনাবাহিনী ছিলাম না। কাগজপত্রে আমাদের কোনাে অস্তিত্বই ছিল না। সেনাবাহিনীর জন্য আইনগত কোনাে ভিত্তি ছিল না। টেবল অব অর্গানাইজেশন এ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট বলে কিছু ছিল না। সবই ছিল ‘এডহক’। সেনাবাহিনী বেতন পেত। কারণ শেখ মুজিব তা দিতে বলেছিলেন। মুজিবের মুখের কথার ওপর আমাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর (জিয়ার চিফ অব জেনারেল স্টাফ) -এর ভাষায় : এ দেশের সেনাবাহিনী একটা স্বেচ্ছাসেবক দলের মতাে।… প্রত্যেকেই এরা। হতভাগ্য, এদের খাবার নেই, কোনাে প্রশাসন নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই, জার্সি নেই, গায়ের কোট নেই, পায়ের বুট পর্যন্ত নেই। শীতের রাতে এদেরকে কম্বল গায়ে। দিয়ে পাহারা দিতে হয়। আমাদের অনেক সিপাই এখনও লুঙি পড়ে কাজ করে।

এদের কোনাে ইউনিফরম নেই। তদুপরি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অজ্ঞাতে বিশেষ আর্মি চ্যানেলে গােপনীয়ভাবে’ ৬। হাজার পাউন্ড প্রশিক্ষণ ফি পাঠিয়ে মুজিবের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী দ্বিতীয় পুত্র। জামালকে বিলেতের স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষিত করে সেনাবাহিনীর উচ্চপদের জন্য তৈরি করার বিষয়টিও সামরিকবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি করে।৩. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পষ্ঠা ৯৩-৯৪ ৪. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬-২৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭মুক্তিযােদ্ধা বনাম প্রত্যাগত দ্বন্দ্ব ৮ মার্চ ১৯৭২ সরকার পূর্বতন ‘গ্রাম রক্ষীবাহিনী’ বিলুপ্ত করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ গঠন করে। এই প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যদের নিয়ােগ, শপথ, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও কার্যাবলি সাধারণ মানুষ এবং সামরিকবাহিনীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পর আটকে পড়া ১,২০০ অফিসার ও ৩৫ হাজার বাঙালি জোয়ান পাকিস্তান থেকে স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন। সামরিকবাহিনীতে মুক্তিযোেদ্ধা’ ও ‘স্বদেশ প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রদত্ত দুই বছরের সিনিয়রিটিতে অমুক্তিযােদ্ধারা বিক্ষুব্ধ হন। শেখ মুজিবের মহানুভবতায় তারা। (অমুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা) সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং একের-পর-এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। তাদের ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যই ছিল চরিত্র হননের মাধ্যমে সিনিয়র মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের স্বপদ থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলাে দখল এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করা। প্রত্যাগতদের, বিশেষ করে পাক ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সে কর্মরতদের নিয়ােগ করাকে অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ মেজরদের নেতৃত্বাধীন আক্রমণকারী তিনটি দলই ছিল পাকিস্তানি-সৃষ্টি।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ইন্ডিয়ান রেভল্যুশন আর্মির সদস্যদের ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীতে পুনঃনিয়ােগের সুপারিশ-সংবলিত একটি নথি অনুমােদনের জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের নিকট পাঠালে ব্যাটন নেহেরুকে বলেন, আপনি চাইলে আমি অবশ্যই তা অনুমােদন করব, তবে আমি মনে করি শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। ওদের কৃতিত্বের জন্য অন্যভাবে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। নেহেরু তাই করলেন। বাংলাদেশেও তা করা উচিত ছিল বলে রাজনৈতিক বিশেষ মহল মনে করেন। মেজর ডালিম ও গাজীর পরিবারের দ্বন্দ্ব। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা লেডিজ ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে রেডক্রস চেয়ারম্যান গাজী গােলাম মােস্তফার ভাই মেজর ডালিমের স্ত্রী তাসনিমকে উদ্দেশ্য৮. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত, মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১১২। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০। মতান্তরে, গাজীর এক ছেলে। উক্ত বিয়ের কনে ডালিমের বােনকে উত্যক্ত করে এবং ডালিম তাকে চড় মারে। কেউ কেউ বলেন, ডালিমপত্নী তার নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে অপমানিত হন- যা সত্য নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা ও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের পর ১৮। এপ্রিল ১৯৭১ কলকাতাস্থ পাক-মিশনের একজন ব্যতীত সকল কর্মকর্তা হােসেন আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই একজন হলেন আর আই চৌধুরী। (১৯৬৪ করে আপত্তিকর মন্তব্য করে। এ নিয়ে বাদানুবাদের একপর্যায়ে গাজীর ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী যােগ দেয় এবং ডালিম-তাসনিম দম্পতিকে বেইজ্জতি করে ও কিডন্যাপের চেষ্টা করে। উভয়পক্ষ থেকেই মুজিবের কাছে বিচার প্রার্থনা করা হয়। প্রচলিত বাঙালিরীতি অনুযায়ী মুজিব গাজী ও ডালিম উভয়ের হাত মিলিয়ে দিয়ে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে এর মীমাংসা করে দেন।

কিন্তু বিষয়টি এখানে শেষ হলনা। ডালিমের সহকর্মী আর্মি বন্ধুরা দুটি ট্রাকে করে গিয়ে গাজীর নয়া পল্টনের বাড়ি তছনছ করে এবং হুমকি দেয় যে, ‘ডালিমের কিছু হলে শহরে রক্ত বয়ে যাবে।’ | শৃঙ্খলাই সামরিকবাহিনীর আইন। তাই এই উদ্ধৃঙ্খল ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার তদন্তপূর্বক ডালিম, “ নূর, হুদাসহ ২২ জন যুবা অফিসারকে চাকরিচ্যুত বা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। শাস্তিপ্রাপ্তরা এজন্য ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের প্রতি বিক্ষুব্ধ হন।সালে মােনায়েমী রাজত্বে তিনি ছিলেন পাবনার পুলিশ সুপার। সরকারবিরােধী মিছিল করার অপরাধে সে-সময় তার নেতৃত্বে বহু লােককে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর তার স্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে কলকাতা পৌছার পরে অন্যান্যদের অনুরােধে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যুদ্ধ চলাকালে শরফুল হক ডালিম আহত হয়ে চিকিৎসা ও বিশ্রাম গ্রহণকালে আর.আই. চৌধুরীর কন্যা তাসনিমের প্রেমে পড়ে এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কি জনাব চৌধুরী তাতে রাজি না হওয়ায় ছেলে ও মেয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিয়ে করে। পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন তাদের সকলকে মিলিয়ে দেন। (আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮)। কলকাতার সানডে’ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বাড়ীর লনে তােলা ডালিম ও তার সুশ্রী স্ত্রী তাসনিমের ছবি দিয়ে একটি প্রচ্ছদকাহিনী প্রকাশ করে। এতে প্রতিবেদক মন্তব্য করেন, তাসনিমের চেহারাই মনে হয় ১৫ আগস্টের ভােরের সংঘটিত অ্যুথানের ট্যাঙ্কগুলােকে অগ্রসর হতে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। (এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৯) এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০। ডালিম, তার স্ত্রী তাসনিম ও শাশুড়ি হেনা মুজিবের বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত করত (এমনকি ডালিমের চাকরি থেকে অপসারিত হওয়ার পরও)। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ডালিমের মা মারা যায় এবং শােক কাটিয়ে উঠার আগেই তার বাবা এক যুবতীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করায় সে বাবার সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখে। ডালিম রেগম মুজিবকে মা ডাকত এবং বাঙালির প্রথানুযায়ী বিশেষ বিশেষ দিনগুলােতে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করত।

বিয়ের দু-তিন বছর পরও সন্তান না হওয়ায় ডালিম এ-সম্পর্কে বেগম মুজিবের পরামর্শ গ্রহণ করে। চাকরি থেকে অপসারিত হয়ে ব্যবসা করার জন্য মুজিব ডালিমকে লাখ লাখ টাকার লাইন্সেস আর পারমিট দিয়ে সাহায্য করেন। দু’জনই মাঝে মাঝে একসাথে মুড়ি খেতেন। মুড়ি ছিল উভয়েরই প্রিয় খাদ্য। রেহানার সাথে একদিন কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ডালিম বলে, যখন সময় আসবে। তখন তুমি জানতে পারবে কারা তােমাদের বন্ধু। হেনা অবশ্য তার জামাতাকে এজন্য ভসনা। করেন এবং দায়িত্বহীন’ কিছু না-বলার উপদেশ দেন। দুর্ভাগ্য রেহানার। প্রবাসে থাকা অবস্থায়। প্রিয় মাতা-পিতা, ভাই-ভাবী ও অন্যান্য আত্মীয়দের রক্তের দামে ‘বন্ধুদের চিনতে হয়েছে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সর্বনাশা বার্তাটি আনন্দে-উত্তেজিত কণ্ঠে ডালিমই প্রথম বেতারে ঘােষণা করেছিল।উচ্চাভিলাষী ফারুক-রশিদ মেজর ফারুকের পুরাে নাম দেওয়ান ইশরাতুল্লাহ সৈয়দ ফারুক রহমান। তার পিতা সৈয়দ আতাউর রহমান সেনাবাহিনীতে ডাক্তার (মেজর) ছিলেন। রাজশাহীর নওগাঁর বিশিষ্ট পীরবংশে তার জন্ম। ১৯৬৫ সালে রিসালপুরস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যােগ দিয়ে স্নাতক হয়ে তিনি ল্যান্ডার্স রেজিমেন্টে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন এবং আবুধাবীতে ‘সেকেন্ডমেন্টে গিয়ে আর্মড রেজিমেন্টে স্কোয়াড্রন কমান্ডার (ট্যাঙ্ক কমান্ডার) হিসেবে যােগ দেন। ১৯৭১ সালের মধ্য-জুনে ব্রিটিশ সানডে টাইমস’ ও চাচা নূরুল কাদেরের পত্র মারফত বাংলাদেশে সংঘঠিত পাক-সেনাবাহিনীর গণহত্যা-সংক্রান্ত বিবরণ পেয়ে পাক-সেনাবাহিনীতে আর চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ নভেম্বর লন্ডন হয়ে তিনি স্বদেশে পৌঁছেন।  মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের পিতা ছিলেন একজন প্রাথমিক শিক্ষক। কুমিল্লাদাউদকান্দি সড়কের মাঝামাঝি ছয়ফরিয়া গ্রামে রশিদের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৫ তিনি সালে সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে বেঙ্গল রেজিমেন্টে পােস্টিং চাইলে তাকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কমিশন দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে রশিদ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়ে ছুটিতে বেড়াতে এসে চট্টগ্রামের শিল্পপতি এস, এইচ. খানের (এ কে খানের ভাই) জ্যেষ্ঠা কন্যা জোবায়দা (টিঙ্কু)-কে বিয়ে করে কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশের বানুতে নিয়ে যান।

১৯৭১ -এ পৃথিবীর বিভিন্ন রেডিও মারফত সংবাদ পেয়ে পাক-সেনাবাহিনী ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। পিতামাতার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসে স্ত্রী-কন্যা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে ২৯ অক্টোবর ভারতের আগরতলা গমন করেন এবং জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের সাথে সংযুক্ত একটি মুক্তিবাহিনী দলের সাথে ডিসেম্বরের প্রথমদিকে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ঐ দলটির নাম দেয়া হয়েছিল মুক্তিবাহিনী হাউইটজার ব্যাটারি-যা স্বাধীনতার পর। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট হিসেবে উন্নীত হয় এবং রশিদ হন এর কমান্ডিং অফিসার। রিসালপুরের মিলিটারি একাডেমিতে ফারুকের সাথে তার পরিচয় হয়। ফারুক তার এক ব্যাচ সিনিয়র। স্বাধীনতার পর কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে এক বনভােজনে ফারুকের নজর কাড়ে রশিদের সুন্দরী শ্যালিকা ফরিদা (উর্মি)। রশিদের মধ্যস্থতায় ১২ আগস্ট ১৯৭২ ওদের বিয়ে হয়।১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে ফারুক এবং রশিদ মুজিবকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল। তারা পরস্পরে ভায়রা ভাই। ঢাকা সেনানিবাসে পাশাপাশি বাড়িতে১২. মিলিটারি একাডেমিতে মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মােশাররফ প্রশিক্ষক ছিলেন। তারা উভয়ে ফারুককে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যােগ দিতে বললেও তিনি তা করেননিবাস করায় উভয়ে একত্রে মিলিত হবার অবাধ সুযােগ পায় এবং এক বছর ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হত্যার ছক আঁকে।হত্যার পরিকল্পনা রচনা ও বাস্তবায়ন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশে জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। স্বাধীনতার পর জাতিসংঘের ঢাকাস্থ রিলিফ অপারেশনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আনবৃন্ড পরিচালিত দেশব্যাপী সাহায্য কর্মসূচি। দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুশাে কোটি ডলার পরিমাণ আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার পরও ১৯৭৩ সালের শেষদিকে দেশটি দেউলে হয়ে যায় ঘুস, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, কালােবাজারির কারণে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে ২৭,০০০ লােক (বেসরকারি মতে লক্ষাধিক) মৃত্যুবরণ করে।  দলে দলে মানুষ কাজ, খাদ্য বা ভিক্ষার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় ছুটে আসে। কিন্তু সরকার এদের পেটের আগুন নেভানাের ব্যবস্থা করতে পারেনি। উপরন্তু, বিব্রত হয়ে ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপক অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই লক্ষ ছিন্নমূল ও বস্তিবাসী মানুষকে জোর করে হয় তাদের গ্রামের বাড়িতে না হয় শহর থেকে দূরে ক্যাম্পে পাঠানাের ব্যবস্থা করে।

এ অবস্থার সুযােগ নিয়ে বিরােধীদল বিশেষ করে জাসদ ও মাওবাদী বিভিন্ন দল সরকার উচ্ছেদে তৎপর হয়। রাতের আঁধারে বিরােধীদের আক্রমণে ৫ জন সাংসদসহ ৪ হাজার আওয়ামী-নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন আওয়ামী বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর হাতে হাজার হাজার বিরােধীদলীয় নেতাকর্মী নিখোজ ও নিহত হয়। বিরােধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য প্রথমে জরুরি অবস্থা ঘােষণা, মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ, বিচারবিভাগের ক্ষমতা খর্বকরণ ও পরে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে, অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতি চোরা কারবার-মজুতদারী দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রচলিত ব্যবস্থা অকার্যকর প্রতীয়মান হলে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে এসব১৩. এএল খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ ১৪ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চোরাইকারবার প্রভৃতি কারণে ১৯ জন সাংসদ ও ৯ জন মন্ত্রির পদ বাতিল করা হয়। এসবের বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দয়া করে পরিশিষ্ট ৫ পড়ুন ঢাকার অদূরে ডেমরায় এরূপ একটি ক্যাম্পে ৫০ হাজারেরও অধিক লােক জড়ো করা হয়েছিল। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষীবাহিনী দ্বারা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। এতগুলাে লােকের জন্য মাত্র কয়েকটা পায়খানা ও টিউবয়েল এবং নামমাত্র রেশন। ঔষদের কোনাে সরবরাহ ছিল । পরিদর্শনে যাওয়া জনৈক সাংবাদিককে ঐ ক্যাম্পবাসী এক বুড়াে বলেছিল আমাদের খাইতে দেন, আর না হয় গুলি কইরা মারেন।’ ১৮.০২.৭৫ তারিখের গার্ডিয়ান পত্রিকা ঐ ক্যাম্পটিকে ‘মুজিবের লােকদের সৃষ্ট দুর্যোগ এলাকা’ নামে অভিহিত করে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ৬ পড়ুন | কাজে সামরিক বাহিনীকে মােতায়েন করা হয়। সামরিক সদস্যরা পূর্ণ উদ্যমে উপরিউক্ত দুষ্কৃতির অভিযােগে শত শত অপরাধীদের গ্রেফতার করে। ক্ষেত্র বিশেষে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, নৃশংস ও প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করে। (কুমিল্লায় তারা কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাকেও গ্রেফতার করে)। এই অভিযানের মাধ্যমে সামরিক সদস্যরা একদিকে ক্ষমতার স্বাদ পায়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যে, বেসামরিক প্রশাসন যেখানে ব্যর্থ, সেখানে তারা সফল হবে। অথচ সামান্য কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তি বাদে, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও লােকদের সৎ হিসেবে খ্যাতি ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই কিছু কর্মকর্তা ও সৈন্যরা ছিনতাইসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িত ছিল বলে অভিযােগ পাওয়া যায়।

যা হােক উক্ত অভিযানে বিভিন্ন অভিযােগে সামরিক সদস্যদের দ্বারা গ্রেফতারকৃত অপরাধীদের অধিকাংশই দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতাসীন আওয়ামী দলীয় এবং কিছু দিনের মধ্যে প্রায় সবাই উপরের টেলিফোন নির্দেশে বেকসুর খালাস পেয়ে যেতে থাকে । বিষয়টি জনমনে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। | ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে ‘পরিচ্ছন্ন অভিযানের দায়িত্ব পেয়ে মেজর ফারুক ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের ব্র্যাভাে স্কোয়াড্রন নিয়ে ডেমরা এলাকায় ২১ জন লােককে হত্যাকারী এক তরুণ ডাকাত সরদারকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাকালে হত্যাকারী স্বীকার করে যে, সে একজন আওয়ামীলীগার এবং তার ওস্তাদের নির্দেশে এ-কাজ করেছে। ফারুকের ভাষায় : ‘ঐ বদমায়েশের ওস্তাদ স্বয়ং শেখ মুজিব।’ ফারুক আরাে জানায়, এরপর একটি লিখিত নির্দেশে তাকে বলা হয় যে, সে কাউকে গ্রেফতার করলে, তার নিজ দায়িত্বেই তা করতে হবে। কোনাে অঘটন ঘটে গেলে, তার জন্য তার রেজিমেন্টাল কমান্ডার কিংবা ব্রিগেড কমান্ডার কেউই দায়ী হবেন না। ফারুকের ভাষায় :এর অর্থ ছিল এরকম যে, আমাদের অনাচার-দুর্নীতি দূর করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেখলেই থমকে দাঁড়াতে হবে। পুরাে ব্যাপারটাই এক দুঃখজনক ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছিল।সেই সময়কালে নব-বিবাহিত এক দম্পতি তাদের গাড়িতে টঙ্গী যাওয়ার পথে মােজাম্মেল নামে এক দুর্ধর্ষ আওয়ামী লীগার ও তার সহকর্মীদের হামলার শিকার হয়।১৭ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫২। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর পর এমনকি শফিউল্লাহ, মীর শওকত প্রভৃতি উঁচু পদমর্যাদার অফিসারদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধের সময় অবৈধ সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযােগ উত্থাপিত ও তদন্ত শুরু হয়। (ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮) অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, হাক্কানী পাবলিশার্স (পুনর্মুদ্রণ) ২০০০, পৃষ্ঠা ৪১-৪২। অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদি এলাকায়ও অনুরূপ অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়গাড়ির চালক ও আরােহী(স্বামী)-কে খুন করে তারা মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। অপর দু’জন সঙ্গীসহ টঙ্গীতে মেজর নাসেরের হাতে ধরা পড়ার পর মােজাম্মেল তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরােধ জানায়। মােজাম্মেলের ভাষায় :ব্যাপারটিকে সরকারি পর্যায়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন না। আজ হােক, কাল হােক, আমাকে আপনার ছেড়ে দিতেই হবে। সুতরাং টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতে আপনার আপত্তি কেন? মেজর নাসের এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে মনে করে কোর্টে সােপর্দ করে।

কিন্তু কিছুদিন পরই ঐ নৃশংস তিন খুনের আসামি মােজাম্মেলকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে সকলেই বিস্মিত হয়। সেনাবাহিনীতে ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ কাণ্ডটি শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপেই সম্ভব হয়েছিল। ডেমরা ও টঙ্গীর ঘটনাবলি মেজর ফারুক ও তার সহকর্মীদের ভাবনা ও কর্মের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ফারুকের ভাষায় :আমরা এমন এক সমাজে বাস করছিলাম, যেখানে অপরাধীরা নেতৃত্ব দিচ্ছিল। বাংলাদেশ যেন মাফিয়ার কর্তৃত্বাধীনে চলে গেল। আমরা সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। এখানে এমন এক সরকার কায়েম হয়েছিল, যে সরকার খুনের মতাে জঘন্য কাজে শক্তি যােগাত। আর এমনসব চরম কর্মকাণ্ড ঘটাত, যেগুলাে থেকে। জনগণকে ঐ সরকারের বাঁচানাের কথা ছিল। তা আর চলতে দেয়া যাচ্ছিল না। আমরা তাকে (মুজিবকে) খতম করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফারুক ব্যক্তিগতভাবে এবং ক্ষুদ্র দলে কর্নেল আমিন আহম্মেদ, মেজর হাফিজ, মেজর সেলিম, মেজর নাসের, মেজর গাফফার, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত প্রমুখের সাথে এ বিষয়ে আলােচনা করে। তাদের সকলেরই পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘমেয়াদি । কিন্তু ফারুক পারলে তক্ষণই মুজিবকে খতম করে দেয়ার পক্ষপাতি। এ সময় সে। ইন্দোনেশিয়ার শােকর্ন-উৎখাতের পরিকল্পনার কিছু রচনা পাঠ করে এবং শােকর্নোর। মতাে মুজিবকে গদিচ্যুত করে একটি প্রাসাদে বন্দি করে রাখার কথা ভাবে। কিন্তু পরক্ষণেই এ পরিকল্পনা বাতিল করে দেয় এই ভেবে যে, তাহলে তার (মুজিবের) নামে অন্য একটি পাল্টা শক্তি নিজে বা ভারতকে ডেকে এনে তাদের (ফারুকদের) সরিয়ে দেবে। ফারুকের ভাষায় : এর কোনাে বিকল্প নেই। মুজিবকে মরতেই হবে।’শৌখিন পাইলট ফারুক মুজিবকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাত্রাকালে হেলিকপ্টারে মারার পরিকল্পনা করে। ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে সে অনুরােধ১৯.  অ্যান্থনি ম্যাসকারহ্রাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩ ২০. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩। উল্লেখ্য, ডেমরা, টঙ্গী বা । অন্যত্র সংঘটিত ঘটনাবলি অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এ গুলােকে অজুহাত করে স্বাধীনতার স্থপতি এবং নির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে সপরিবারে হত্যা করা সহস্রগুণ বেশী নিন্দনীয়। ২১. এ সময় ফারুকের বন্ধু ও ভারাভাই মেজর রশিদ ভারতে বােম্বের নিকটবর্তী দেওলালীতে ১৪। মাস ব্যাপী একটি গানারি স্টাফ কোর্সে অংশ নিচ্ছিলকরেছিল যে, যখন মুজিবকে নিয়ে হেলিকপ্টার উড়বে, তার আগেই পিস্তলসহ সে (ফারুক) তার সাথে থাকবে।

তারপর রেডিও যােগাযােগ বন্ধ করে দিয়ে মুজিবকে গুলি করে মেরে মৃতদেহ সুবিধেজনক একটা নদীতে ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু পরে এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফারুক সামরিক কায়দায় অগ্রসর হয়। ফারুকের লক্ষ্যবস্তু মুজিব। তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান এবং খালেদ মােশররফের উপর যথেষ্ট অনুসন্ধান করে শক্রর পাতায় মুজিবের আত্মীয় ও প্রভাবশালী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির নাম লিখে; এই তিনজনকেই মরতে হবে।’ | পর্যটনের গাইড বইয়ে প্রকাশিত ঢাকা শহরের ছােট একটি মানচিত্রকে কেন্দ্র করে ফারুক ছদ্মবেশে পায়ে হেঁটে পদক্ষেপ মেপে মেপে দূরত্ব নিরূপণ করে নিজ পরিকল্পনায় আর্টিলারি পজিশন স্থির করে। এজন্য প্রতিরাতেই দশটার দিকে সে সাধারণ মানুষের বেশে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডে ঘুরে বেড়াত। মুজিবের গতিবিধি, অভ্যাস, কাজ, খাবার জায়গা প্রভৃতিও সে লক্ষ্য রাখছিল-যাতে চূড়ান্ত মুহূর্তে কোনাে ভুল না হয়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফারুক তার কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করে কুর জন্য প্রস্তুত হয়। গানারী স্টাফ কোর্স সমাপনান্তে ১৯৭৫’র মার্চের মাঝামাঝি ফিরে আসা রশিদকে ফারুক তার পরিকল্পনার কথা খুলে বললে রশিদ সময়-স্বল্পতা ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা তুললেও পরে তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। মুজিবের বিকল্প হিসেবে তারা জেনারেল জিয়ার কথা ভাবে। ফারুক জিয়ার সাথে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে এবং অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেশের দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি ইত্যাদির জন্য একটি পরিবর্তন প্রয়ােজন এবং সেক্ষেত্রে তার (জিয়ার) সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করায় জিয়ার উত্তর ছিল : আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তােমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও, তাহলে তােমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনে না।ফারুক প্রণীত কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৩০০ লােকের প্রয়ােজন। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির ছিল ৬টি ইতালীয় হাউইটজার, ১২টি ইয়ােগােস্লাভীয় ১০৫২২. ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে মুজিবহত্যার ওপর গ্রানাডা টেলিভিশনের জন্য একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ উপলক্ষে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস কর্তৃক ফারুকের উপরিউক্ত বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞসিত হলে জিয়া তা স্বীকার বা অস্বীকার কোনটিই না করে উত্তরদানে বিরত থাকেন।

পুনরায় জবাব পাওয়ার চেষ্টা করায় জিয়া অ্যান্থনিকে বহুবছর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ আদালতে প্রদর্শিত উক্ত টিভি অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্যাসেটে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ফারুক জানাচ্ছেন, ‘পঁচাত্তরের ২৮ মার্চ জেনারেল জিয়াকে ম্যানেজ করি। সে সময় জিয়ার বক্তব্য ছিল-সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে সরাসরি কিছু করা সম্ভব নয়, তােমরা জুনিয়ারা চাইলে গাে এ্যাহেড’ (ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬০)। জিয়া সম্পর্কে আরাে অধিক জানার জন্য পরিশিষ্ট ১২ পড়ুন।মি. মি. হাউইটজার এবং ৬০০ সৈন্য। ফারুকের ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারে ছিল ৩০টি টি৫৪ ট্যাঙ্ক ও ৮০০ সৈন্য। সুতরাং অন্যদের সাহায্য না পেলে দুই ভায়রাভাই-ই পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে সক্ষম। প্রয়ােজন শুধু দুটো শক্তিকে একত্রিত করা। | সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নিয়মানুযায়ী বেঙ্গল ল্যান্সার মাসে দু’বার রাতে ট্রেনিং এক্সারসাইজ পরিচালনা করে। রশিদ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার আর্টিলারিকে বেঙ্গল ল্যান্সারের সাথে একত্রে ট্রেনিং করার প্রস্তাব পেশ করে। এসব এক্সারসাইজের উদ্দেশ্য হল, অন্ধকারে নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার কৌশল সম্পর্কে সৈন্যদের সম্যক অবগত করা। সুতরাং এ ট্রেনিং একত্রে হলে উভয় পক্ষই একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে মনে করে সেনাসদর রশিদের প্রস্তাবে অনুমতি দিয়ে ফারুকের ট্যাঙ্ক ও রশিদের আর্টিলারি একত্রিত হওয়ার সুযােগ করে দেয়। কয়েকমাস ধরে চলা, দুই বাহিনীর রাত্রিকালীন মহড়ায় পাশ্ববর্তী সকলেই ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রের গুলির আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে মধ্য-আগস্টে ভিন্ন উদ্দেশ্যে বের হলেও লােকে এদের সন্দেহ করে না। ইতােমধ্যে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ থেকে ৬১টি জেলায় মুজিব মনােনীত ‘গভর্নরগণ স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা শুরু করবেন। গভর্নরগণ নিজ নিজ এলাকায় অবস্থিত পুলিশ, বিডিআর, রক্ষী ও সামরিক বাহিনীর ইউনিটেরও নিয়ন্ত্রণ করবেন। শাসনব্যবস্থায় এই পরিবর্তনকে দ্বিতীয় বিপ্লব’ আখ্যায়িত করা হয়।এমতাবস্থায় ফারুক ও রশিদ দু’জন মিলে ১ সেপ্টেম্বরের পূর্বেই আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়। ফারুক ৩ জুলাই থেকেই চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত ছিল।

তার রণকৌশলের পরিকল্পনা ও সৈন্যসামন্তও প্রস্তুত। ডায়েরি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতে বেঙ্গল ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির পরবর্তী যৌথ নৈশ ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হবে। রাত পােহালে শুক্রবার। শুক্রবারের জাতক ফারুক পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসার দিনটি ছিল শুক্রবার। ফরিদার সাথে তার বিয়েও হয় শুক্রবারে। ধর্মীয় দিক থেকেও দিনটি গুরুত্ববহ। ফারুকের ধারণা, সে ইসলাম২৩. ফারুক ৩০ মার্চ ১৯৭৫ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য তৈরি হয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, তার বড় বড় বুলি আওড়ানাে বন্ধুদের সবাই নিষ্ক্রিয়। মেজর হাফিজ, কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী। প্রমুখ রণে ভঙ্গ দেয়। এ সময় রশিদকে যশাের গানারী স্কুলে বদলি করা হলে কর্নেল শাফায়াত জামিলের অপ্রত্যাশিত সহায়তায় সে এপ্রিলে (৭৫) ঢাকাস্থ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে আসে। ২৪. কমান্ডিং অফিসৱা (সিও) ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দেয়া বার্ষিক ট্রেনিং নীতিমালা অনুযায়ী নিজেদের ট্রেনিং প্রােগ্রাম তৈরি করে নিজ দায়িত্বে নিজেদের এলাকায় তা পরিচালনা করে। ইতঃপূর্বে নাইট ট্রেনিঙে দুটি ইউনিটের যৌথ অংশগ্রহণের নিয়ম ছিল না। ট্রেনিঙে লাইভ এমনিশন। নেয়ারও নিয়ম নেই। অ্যান্থনি মাসকারহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫২।আর দেশের স্বার্থে এ কাজ করতে যাচ্ছে। তাই এবারও শুক্রবার তার জন্য শুভ হবে। জিয়াকে দলে ভেড়াতে না পেরে ফারুক রশিদের ওপর রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে মুজিবের উত্তরসুরি বাছাইয়ে দায়িত্ব দিল। রশিদ চারটি দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনার কথা ভাবলাে। ১. আওয়ামী লীগ, ২. রক্ষীবাহিনী ৩. মুজিব নিহত হলে প্রতিশােধ পরায়ণ লােকজন কর্তৃক আওয়ামী লীগারদের নির্বিচার হত্যা ও ৪, ভারতীয় হস্তক্ষেপ। রশিদ আওয়ামী লীগ থেকেই মুজিবের উত্তরসুরি বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে তার মতে, আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনী বিদ্রোহী হবে না, প্রতিশােধ পরায়ণকারীরা সাহসী হবে না এবং ভারতীয় হস্তক্ষেপেরও সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু মুজিবের বিকল্প বের করা খুব সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মােশতাককে রশিদ পছন্দ করল। | মােশতাক তখন বানিজ্য মন্ত্রী ও বাকশালের তিন নম্বর সদস্য। তিনি ও রশিদ।

একই-কুমিল্লা জেলার অধিবাসী ও পরস্পরের আত্মীয়। তিনি একজন খ্যাতিমান এ্যাডভােকেট ও দাউদকান্দির পীরের সন্তান। আওয়ামীলীগার হিসেবেও তিনি কম বিতর্কিত। রশিদের ধারণা, তাকে পুতুলের মতাে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে এবং সুবিধামতাে যে-কোনাে মুহূর্তে সরিয়ে দেয়াও সহজ হবে।১৯৭৫ সালের মার্চের শেষদিকে, খন্দকার মােশতাকের পৃষ্ঠপােষকতায় ও মাহবুবর আলম চাষীর উদ্যোগে কুমিল্লাস্থ বার্ডে’ (বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভলাপমেন্ট) তিনদিনব্যাপী চট্টগ্রাম-বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বিভাগের সকল ডিসি/এডিসি ছাড়াও মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, মাহবুব আলম চাষী, অধ্যাপক খুরশিদ আলম (কুমিল্লার গভর্নর মুজিব হত্যা মামলার ৪৩ নং সাক্ষি) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকালে একটি আর্মি-জিপে সিভিল ড্রেসে মােশতাকের ভাগ্নে মেজর রশিদ ও মেজর বজলুল হুদা। বার্ডে আসেন এবং মাহবুব আলম চাষী ও তাহেরদ্দিন ঠাকুরসহ রেস্ট হাউসে মােশতাকের কক্ষে বৈঠক করেন।২৭. ফারুক ব্যক্তিগত জীবনে কতখানি ধর্মনিষ্ঠ তা জানা নেই। তবে তার এই ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে তিনি ঐশী মঞ্জুরীর প্রত্যাশায় কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের হালি শহরের জন্মান্ধ বিহারী পীর আন্ধা হাফিজের সরণাপন্ন হন। পীর তাকে ১. আল্লাহ আর ইসলামের জন্য ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু না করা, ২. শক্তি অর্জন করা ও ৩. সঠিক সময় বেছে নেয়ার (আরাে তিন মাস অপেক্ষা করার) পরামর্শ দেন। ১৪ আগস্ট ফারুকের স্ত্রী ফরিদা পীরের সাথে সাক্ষাৎ করে সবুজ সংক্ষেতসহ পাঠ করার জন্য দুটি সুরা সংগ্রহ করে। [অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫১ ও ৬৬-৬৭) মােশতাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দয়া করে পরিশিষ্ট ১১ পড়ুন । স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মােশতাক মুজিবনগর সর্বকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। উভয়ে মিলে তারা আমেরিকার সহায়তায় পাকিস্তানের সাথে আপসমূলক কনফেডারেশন করার চক্রান্ত করে ধরা পড়েন ও দায়িত্ব হারান। পরে মুজিব কর্তৃক পুনর্বাসিত হয়ে মােশতাক চাষীকে বার্ডে নিয়ােগের ব্যবস্থা করেন । ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৬, ১৭, ৫৬ ও ১৯০মে-জুন মাসে মােশতাকের গ্রামে অনুষ্ঠিত এক ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মােশতাকের আমন্ত্রণে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, সংসদের চিফ হুইপ শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এমপি ও অধ্যাপক খুরশিদ আলম অতিথি হয়ে আসেন।

খেলাশেষে মােশতাকের বাড়িতে চা-পানের সময় মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও শাহ মােয়াজ্জেম উচ্চকণ্ঠে মুজিবের বিভিন্ন পলিসি ও কর্মসূচির সমালােচনা ও বিদ্বেষমূলক কটাক্ষ করেন। এই সময়কালে গাজীপুরের শালনা হাইস্কুলে ঢাকা-বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন চলাকালে মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুক সহ ৪/৫ জন সেনা-অফিসার সেখানে উপস্থিত হন। মােশতাক তাদেরকে সমবায় মন্ত্রী সামসুল হক এবং তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাদের আন্দোলনের অবস্থা জানতে চান।১৯৭৫-এর জুন-জুলাই মাসে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে স্বাস্থ্য সচিব ডা. টি. হােসেন ও পরিকল্পনা সচিব ড. সাত্তার, খােন্দকার মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক খুরশিদ আলম, সাংসদ আলী আশরাফ, মাহবুব আলম চাষী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন চলাকালে আর্মির জিপে মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা প্রমুখ সেখানে আসেন এবং সম্মেলন শেষে তারা মােশতাক, ঠাকুর ও চাষী সমভিব্যাহারে মােশতাকের বাড়িতে যান। এছাড়া আইয়ুব আমলের জেনারেল এম আই করিম ও জনৈক জেনারেল চৌধুরীর সাথেও মােশতাকের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এবং তারা তার গুলশানস্থ বাসভবনে যাতায়াত করতেন। | এ সময় কালে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল একদিন রশিদকে তার অফিসে ডেকে জানালেন যে, তার রশিদের) নাম জড়িয়ে ঢাকায় একটি অভ্যুত্থানের কথা শােনা যাচ্ছে। রশিদ বিপদ আঁচ করতে পেরে বেপরােয়া হয়ে ওঠে এবং বলে : | যদি আমার ওপর কোনাে কিছু চাপানাে হয়, তাহলে আপনাকেও আমি ছাড়ছি ।… আমি বলব যে, আমি যা কিছুই করেছি সবই আপনার নির্দেশানুযায়ী। করেছি।… আমি বলব … আপনার কাজের সুবিধের জন্যই আপনি আমাকে। যশােরের বদলী বাতিল করিয়ে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ-কথা শােনার পর কর্নেল জামিল রশিদের সাথে এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করলেও রশিদ খুব কাছেই বিপদ-সংকেত দেখতে পাচ্ছিল।

ফলে সে-ও ফারুকের।৩১. ১৯৭৪ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির পরিচালক মাহবুব আলম। চাষীর উদ্যোগে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরে তা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে। ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে চালু হয়।৩২.  ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৯ ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০-৯১, ২১৯৩৩.  অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭মতােই মুজিবহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তার ভাষায়, ‘আমাদের আর পিছিয়ে আসার পথ ছিল না। হয় তার (মুজিবের) সমাধি রচিত হবে, না হয় আমাদের।’ ২ আগস্ট ১৯৭৫ সন্ধ্যে ৭ টায় রশিদ আগামসিহু লেনের বাড়িতে মােশতাকের সাক্ষাপ্রার্থী হয়। সবার দৃষ্টি এড়ানাে ও সন্দেহ দূর করার জন্য রশিদ বেসামরিক পােশাকে স্কুটার কেনার পারমিটের একটি দরখাস্তসহ উপস্থিত হয়। দোতলার একটি ঘরে প্রায় দু-ঘণ্টা তারা আলাপ করেন। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর মােশতাকের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে সাহস পেয়ে রশিদ জিজ্ঞাসা করেন : আওয়ামী লীগের প্রবীনতম সদস্য এবং শেখ মুজিবের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লােক। হিসেবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ কোনাে উন্নতি প্রত্যাশা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন কি? মােশতাক পরিষ্কার ভাষায় জবাব দেন : , জাতি তার নেতৃত্বে কোনাে উন্নতি প্রত্যাশা করতে পারে না। ‘এটাই যদি সত্যি হবে, তাহলে আপনারা তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন না কেন?’ রশিদের এ প্রশ্নের উত্তরে মােশতাক বলেন এটাও আসলে অতটা সহজ নয়। দেশের এ পরিস্থিতিতে কেউ যদি শেখ মুজিবকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তাহলে তা কি ঠিক হবে? রশিদের এ প্রশ্নের উত্তরে মােশতাকের জবাব : এটি একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে কেউ যদি তা করতে পারে তাহলে সম্ভবত সেটি হবে একটি মহৎকর্ম। | ১২ আগস্ট ১৯৭৫ ফারুক-ফরিদা দম্পতির তৃতীয় বিয়ে বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা গলফ ক্লাবে এক জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। রাতে প্রীতিভােজ শেষে অতিথিদের সবাই চলে যাওয়ার পর ফারুক-রশিদের পারিবারিক ছােট একটি দল লনে কফির সাথে সামান্য নাস্তা নিয়ে আলাপচারিতার জন্য মিলিত হয়। একসময় ফারুক রশিদকে একদিকে সরিয়ে এনে জানালেন, “আমি ১৫ তারিখেই তা ঘটাতে যাচ্ছি; শুক্রবার সকালেই আমি মুজিবকে জীবনের তরে সরিয়ে দিচ্ছি।’ এ কথা শুনে রশিদ চমকে উঠলেন এবং অনেকক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস করে বললেন ‘ এত তড়িঘড়িতে সব পণ্ড হতে পারে।…’ প্রত্যুত্তরে ফারুক বললেন : এটাই আমার সিদ্ধান্ত। রণকৌশলের পরিকল্পনা আমার কাছে তৈরি করা আছে।

আমি একা হয়ে গেলেও এগিয়ে যাব। তুমি ইচ্ছে করলে সরে দাঁড়াতে পারাে। তবে জেনে রেখাে, আমি ব্যর্থ হলে শাসকচক্র তােমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে।৩৫.  অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯।৩৬. উল্লেখ্য, ১৯৭৫ -এর আগস্টের প্রথম সপ্তাহের কোনাে একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গভর্নর। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা ফেরার পথে মােশতাক গভর্নর আলম সাহেবকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, : গভর্নর তাে হয়েছেন, কাজ শুরু করতে পারবেন তাে?’ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩রশিদ আবারও অনেকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে বললেন : ঠিক আছে! যদি করতেই হয়, তবে কর। কিন্তু আমাদের এ নিয়ে আরও আলােচনা প্রয়ােজন। আরও কিছু অফিসার আমাদের সঙ্গে রাখা উচিত। হাতে মাত্র দুদিন সময়। পরদিন ১৩ আগস্ট দুপুরে কোনােরূপ এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই রশিদ আগামসিই লেনস্থ মােশতাকের বাসায় উপস্থিত হন। মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী আলােচনার উদ্দেশ্য ছিল ১৫ আগস্ট তিনি ঢাকায় আছেন কিনা তা জানা। | কর্মরত অফিসারদের নিয়ে কোনাে ভরসা নেই বুঝতে পেরে রশিদ চাকরিচ্যুতির কারণে মুজিবের প্রতি বিক্ষুব্ধ আর্টিলারি অফিসার ডালিমকে তার সাথে গল্পের আমন্ত্রণ জানান। ১৩ আগস্ট সকাল ১০টায় ডালিম রশিদের ক্যান্টেনমেন্টের বাসায় উপস্থিত হন। রশিদ অল্প কথায় চক্রান্তের বিষয় জানিয়ে তাদের সাথে ডালিম যােগ দিতে রাজি কিনা জানতে চান। ডালিম তার বন্ধু মেজর নূরের সাথে আলােচনাসাপেক্ষে রশিদের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং রাত ১টায় নূরকে নিয়ে পুনঃ রশিদের বাসায় আসেন। পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তারিত আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবের স্থলে মােশতাককে বসালে পরিকল্পনা সফল হবে মনে করে নূরও তাদের সাথে থাকতে রাজি হয়ে গেল এবং মােশতাকের সম্মতির বিষয়ে বিশ্বাস জন্মানাের জন্য পরদিন (১৪ আগস্ট) বিকাল ৫টায় আনবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সম্মুখ থেকে। নূরকে সাথে নিয়ে রশিদ মােশতাকের বাড়িতে যাবে স্থির হল। যথাসময়ে প্রস্তাবিত স্থানে এসে রশিদ অপর একজন অফিসারসহ নূরকে দেখতে পেয়ে প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে তার সাথে পরিচিত হয়ে এবং নূর কর্তৃক বিশ্বস্ততার আশ্বাস পেয়ে মেজর শাহরিয়ারসহ তিনজনই আগামসিহ লেনে যান।

পূর্বনির্ধারিত কোনাে এপয়েন্টমেন্ট না থাকলেও মােশতাক তাদেরকে আন্তরিক স্বাগত জানান ও পরস্পরে পরিচিত হন। মেজর রশিদ একজন লােকের চাকরির সুপারিশ করেন এবং মােশতাক প্রার্থীকে পরদিন সকালে পাঠিয়ে দিতে বলেন। সম্ভবত এ কৌশলে পরদিন সকালে মােশতাকের বাসায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর সামান্য সরস-আলাপচারিতা শেষে তারা বেরিয়ে আসে। নূর ও শাহরিয়ার এর মাধ্যমেই সবকিছু বুঝে নেয় এবং যে-কোনাে সময়, যে-কোনাে ধরনের সহযােগিতা করার আশ্বাস দেয়। রশিদ রাতেই ডালিম, নূর আর শাহরিয়ারকে সামরিক প্রস্তুতি দেখা ও কৌশলগত পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে অধিকতর আলােচনার জন্য ক্যান্টনমেন্টে নৈশ-ট্রেনিং স্থলে মিলিত হতে বলে দেয়। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতির/পদত্যাগের পর লে, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ঢাকায় ‘মেরী এন্টারপ্রাইজ নামে পুরনাে টিভি, ফ্রিজ মেরামতের ব্যবসা শুরু করেন। চাকরিচ্যুত অফিসারদের মধ্যে ডালিম, নূর, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা প্রায়ই মেরী এন্টারপ্রাইজে আসতেন ও আওয়ামী লীগ, সরকার, শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে সমালােচনা করতেন।রাত অনুমান ১০টায় ডালিম, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা, নূর চৌধুরী। শাহরিয়ারের বাসায় যান। কিছুক্ষণ পর ডালিম গিয়ে রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে আসেন। সবাই মিলে শাহরিয়ারের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে। নানা ধরনের আলাচনার এক পর্যায়ে ডালিম বলেন যে, তিনি সিজিএসের কাছ থেকে এসেছেন। Army has been called on I.S. (Internal security) duty. Army will move out by first light মুক্তিযােদ্ধা অফিসার হিসেবে তিনি সহযােগিতা করার জন্য আমাদেরকে অনুরােধ করেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনার পর I.S. duty -তে সকলে অংশ। নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেজন্য নতুন এয়ারপাের্ট এলাকায় নাইট ট্রেনিংরত মেজর রশিদের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির টেকটিকেল হেডকোয়ার্টারে রাত (ভোের) ০১-০০ থেকে ০১-৩০টার মধ্যে পুনরায় একত্রিত হওয়া সাব্যস্ত হয়। হত্যা-অভিযান। পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ রাত ১০টায় (মতান্তরে ৮টায়)। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তরদিকে নতুন বিমানবন্দরের কাছে বালুরঘাট এলাকায় মেজর ফারুকের অধীনস্থ ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার (ট্যাঙ্কবাহিনী) ও মেজর রশিদের অধীনস্থ ২য় ফিল্ড আর্টিলারির (কামানবাহিনীর) যৌথ নৈশ-প্রশিক্ষণ শুরু হয়। উভয়। ইউনিটের প্রায় ৬০০ সৈন্য প্রশিক্ষণে অংশ নেয়।

মাঝরাতে মেজর ডালিম তার। চাকরিচ্যুত অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে নির্ধারিত স্থানে মেজর রশিদের সাথে মিলিত হন। রশিদ তার দল আর ১২টি ট্রাক বােঝাই ‘সশস্ত্র’ সৈন্য নিয়ে ট্যাঙ্ক গ্যারেজে ফারুকের সাথে যােগ দেয়। সেখানে প্রথমবারের মতাে সবাইকে অপারেশনের কারণ ও বিবরণ ব্যাখ্যা করে ফারুক উপস্থিত অফিসারদের (কর্মরত ও পদচ্যুত) যােগদানে রাজি কিনা জানতে চাইলে সকলেই সম্মতি জানায়। ফারুক ঢাকা শহরের একটি টুরিস্ট ম্যাপ টেবিলের উপর রেখে, যেসব স্থানে ব্লক স্থাপন করতে হবে সেসব স্থানে দাগ কেটে দেয়। তিনটি প্রধান টার্গেট ১. শেখ মুজিব ২. রব সেরনিয়াবাত ও ৩, শেখ মণির বাড়িতে আঘাতের দায়িত্ব যথাক্রমে ১, মেজর৩৮. পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে ফিরে এসে যােগদানকারী (সিনিয়র) মেজর মােমিনের নিকট ১ম বেঙ্গল ল্যান্ডার্সের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ফারুককে এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে হয়। এ সময় লে. কর্নেল মােমিন ছুটিতে থাকায় ফারুক ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ৩৯. হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২৬ দিন আগে মেজর রশিদ ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার হন। একত্রে একাধিক ইউনিটের নৈশ প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার নিয়ম ছিল না। রশিদের অনুরােধে সেনা সদর এর অনুমতি দেয়। এছাড়াও রশিদ জয়দেবপুরস্থ ১৬তম বেঙ্গল ইনফেন্ট্রির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর শাহজাহানকে এবং স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ও ৪৬-তম পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হাফিজকে অপারেশনে অংশ নেয়ার জন্য বারংবার অনুরােধ করে ব্যর্থ হন। সৈন্যরা ক্লান্ত’ অজুহাত দিয়ে শাহজাহান প্রশিক্ষণে অংশ নিতে অস্বীকার করায় ক্ষেপে গিয়ে ফারুক মন্তব্য করে, মনে হচ্ছে সব বেঙ্গল টাইগারই এখন পােষা বিড়ালে পরিণত হয়ে গেছে নূর চৌধুরী ও মহিউদ্দিন ২. মেজর ডালিম ও ৩. রিসালদার মুসলিমের (মুসলেহউদ্দিন) ওপর দেয়া হয়। রশিদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় ১, অভিযান শুরুর সাথে সাথে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে তার মিগ জঙ্গী বিমান নিয়ে প্রস্তুত রাখা-যাতে বাইরে। থেকে কোনাে সেনা-ইউনিট ঢাকায় আসার চেষ্টা করলে ঠৈকিয়ে দেয়া যায় ২. মােশতাককে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসা এবং মুজিবহত্যা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মােশতাকের নাম ঘােষণা করা ও ৩, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সমর্থন আদায় করা। রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরােধ করাসহ অপারেশনের সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ফারুক।

মুজিব-সেরনিয়াবাত-মণিকে হত্যা, জামাল-কামালকে বন্দি করা ছাড়া আর কাউকে কিছু করা বারণ করা হলাে। তবে, পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে এমন যে-কাউকে প্রয়ােজনবােধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল। শেষােক্ত নির্দেশটি বস্তুত হত্যাযজ্ঞের পরিধি প্রশস্ত করার পথ খুলে দেয়। অপারেশনে বেরােনাের আগে সৈনিকদের ব্রিফিং দেয়া হয়। সেনাবাহিনীতে অফিসারদের ব্রিফিং আদেশের সমতুল্য। ব্রিফিংকালে বলা হয় রক্ষীবাহিনী আর্মির উপর আক্রমণ করবে, প্রতিরােধ করতে হবে। এখন আমাদের একটি জরুরি কাজে অন্য জায়গায় যেতে হবে, পরবর্তী নির্দেশ সেখানে গিয়ে দেয়া হবে।’ যাকে যা অর্ডার করা হবে তা পুরােপুরি পালন করতে হবে, অন্যথায় কোর্টমার্শাল হবে। অর্ডারমতাে কাজ না করলে, ডিউটিতে শৈথিল্য দেখা দিলে, গুলি করে মেরে ফেলা হবে। পদচ্যুত অফিসারদেরকে সৈনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলা হয় আজকের এ জরুরি কাজে তারাও থাকবেন এবং তাদের নির্দেশও পালন করতে হবে। এভাবে প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা না বলে সৈনিকদের ধােকা দেয়া হয়। গভীর রাতে ফারুকের সই করা স্লিপ পাঠিয়ে অস্ত্রাগারের চাবি এনে ইচ্ছেমতাে অ্যামুনিশন সংগ্রহ করা হয়। সাক্ষি নায়েক ইয়াসিনের ভাষায় ‘অমন গােলাবারুদের স্তুপ আর বেহিসাবি গুলি নেয়ার ঘটনা জীবনে দেখিনি। ভাের পৌনে ৫টার দিকে ফারুকের বাহিনী সংগঠিত হয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়। রশিদের আর্টিলারি বাহিনী ৬টি ১০৫ মি.মি. যুগােশ্লাভ হাউইটজার (কামান) ও পর্যাপ্ত গােলাবারুদ নিয়ে নতুন বিমানবন্দরের প্রান্তে দণ্ডায়মান ছাড়াও আরাে ১১টি কামান ইউনিট হেডকোয়ার্টারে ক্রুসহ মােতায়েন রাখা হয়। ল্যান্সারপরবর্তী সময় মামলা চলকালে কয়েকজন সাক্ষি জানিয়েছেন যে, ব্রিফিংকালে শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘােষণা করতে যাচ্ছে, সরকার উৎখাত করা হবে’ প্রভৃতিও বলা হয়েছে। সৈন্যদের মুজিবের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে মেজর মহিউদ্দিন বলেন : ভেতরে গুলি হলে ভয় পেয়াে না, ওখানে আমাদের মেজর ডালিমের লােকজন আছে। এসব অস্পষ্ট কথায় রাস্তায় দাঁড়ানাে সৈন্যরা বুঝতেই পারেনি ভেতরে কী ঘটানাে হয়েছে। সকালে ডালিমের রেডিও ঘােষণায় তারা জানতে পারে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি অভিজ্ঞতায় কর্তৃপক্ষের ধারণা জন্মেছিল যে, বিপদ সবসময় সেনাপতিদের দিক থেকেই আসে। তাই জুনিয়ার অফিসারদের ষড়যন্ত্র গােয়েন্দাদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।গ্যারেজে সারিবদ্ধভাবে ২৮টি ট্যাঙ্ক, ২৯ ১২টি ট্রাক, ৩টি জিপ ও একটি কামান দণ্ডায়মান।

এছাড়া রয়েছে রণসাজে সজ্জিত বাছাইকরা ৪০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী দল। এদের দুই-তৃতীয়াংশই ছিল ল্যান্সারের কালাে উর্দি পরিহিত। মণি, মুজিব, সেরনিয়াবাত -এই তিনটি টার্গেটের উদ্দেশ্যে কালােবাহিনী’ তিনটি দলে ভাগ হয়ে যাত্রা শুরু করে। ভয়ঙ্কর এ মিশনের দুরন্ত যাত্রায় ফারুক ছিল সর্বাগ্রের ট্যাঙ্কটিতে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতেই ভেসে এল ফজরের সুমধুর আজানের ধ্বনি। শুক্রবার ফজরের আজানের সময়ই ফারুক ভূমিষ্ট হয়েছিল। আজানের ধ্বনি। তাকে জন্মদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। তার বিশ্বাস আজও সে, হয় নবজীবনের সূচনা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমােচনীয়ভাবে তার নাম অক্ষয় করে রাখবে, নাহয়, ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আগের দিন বিকেলে স্ত্রী ফরিদার মাধ্যমে প্রাপ্ত আন্ধা হাফিজ নির্দেশিত দুটি সুরা মনেপ্রাণে আর একবার তিনি পাঠ করে নিলেন। | ভাের সােয়া ৫ টার মধ্যে ঘাতকদলগুলাে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌছে যায়। রক্ষীবাহিনীর ব্যারাকের কাছে পৌছে ফারুক দেখতে পায় ৩,০০০ রক্ষীবাহিনীর পুরাে ব্রিগেডটি ৬টি সারিতে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে (মাথায় স্টিলের হেলমেট, হাতে রাইফেল, কাধে প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর বান্ডিল) দাড়িয়ে আছে। ভয়ে তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এখন আমি কী করব?’ ট্যাঙ্কের ড্রাইভারের এ-প্রশ্নের জবাবে ফারুক বললেন, ‘ তুমি তাদের নাকের ডগার মাত্র ছ’ইঞ্চি দূর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে।’ কামানগুলাে তাদের মাথা বরাবর তাক করে রাখার জন্য তিনি গানারদের নির্দেশ দিলেন এবং অন্যদেরকে ভাবভঙ্গিতে সাহসী ভাব ফুটিয়ে রাখতে বললেন। এ প্রসঙ্গে ফারুক আরাে বলেন :আমরা যখন ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, রক্ষীবাহিনীর লােকেরা তখন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আমরা তাদের দিকে তীক্ষভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে ছিল এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি ওরা কিছু৪২/১যান্ত্রিক গােলযােগের জন্য মিশর কর্তৃক উপহৃত ৩০টি টি-৫৪ ট্যাঙ্কের মধ্যে ২টি অকেজো ছিল।অভিযানে অংশগ্রহণকারী অবশিষ্ট ২৮টিও ছিল একেবারে গুলিশূন্য। ট্যাঙ্কের সকল গােলাবারুদ জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স ডিপােতে তালাবদ্ধ করে রাখা ছিল। এমনকি ট্যাঙ্কের মেশিনগানগুলােতেও কোনাে গুলি ছিল না। ফারুক ট্যাঙ্কগুলাে দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে কাজ হাসিল করে।

তার ভাষায়, “ট্যাঙ্কগুলাে যে নিরস্ত্র তা জেনারেল হেডকোয়ার্টারের মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র অবগত ছিল। কিন্তু তারাও পুরােপুরি নিশ্চিত ছিল না। বাকি সকলের কাছেই ট্যাঙ্ক অত্যন্ত মারাত্মক অস্ত্র, এর সামনে যা পড়ে সবই উড়িতে দিতে পারে।… ট্যাঙ্ক দেখে জীবনের ভয়ে পালাবার চেষ্টা করবে, এমন সাহসী লােক খুবই কম পাওয়া যাবে। … মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসাবে ট্যাঙ্ক যে কতটা কর্যকরী তা খুব কম লােকই জানে। তাছাড়া, কে-ই বা আমাকে অতটা পাগল ভাববে যে, আমি জিএইচকিউ আর রক্ষীবাহিনীর মােকাবেলা করার জন্য একেবারে ফাকা ট্যাঙ্ক নিয়ে এতবড় ভয়ঙ্কর অভিযানে পা বাড়াব!’ (অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭২) । অধিনায়কদের ছাড়া প্রতিটি ইউনিটে মাত্র ৪ জন করে অফিসার উপস্থিত ছিল। পুরােপুরি বিশ্বাস করতে না পারায় দু’জন অফিসার ও কিছু সৈন্যকে মহড়ী থেকে বাদ দেয়া হয়। মতান্তরে সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ জন। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪করতে শুরু করে অমনি আর দেরি না করে ওদের উপরই ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেবে। তার আর দরকার হয়নি। দূর থেকে ভেসে-আসা গুলির আওয়াজ তাদের কানে বাজতে লাগলাে। তদুপরি, নিজেদের সামনে হঠাৎ ট্যাঙ্ক দেখে, ওরা গায়ের মশা পর্যন্ত নাড়াবার সাহস পেল না। রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনােরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে ফারুক নিশ্চিত হয়। তার বিপদের সম্ভাবনা কেটে গেছে এবং বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ঐ অবস্থায় রক্ষীবাহিনীকে পাহারা দেয়ার জন্য একটি ট্যাঙ্ক রেখে সে ধানমণ্ডির দিকে রওয়ানা হয়। | অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভাগ্য মুজিবের, তার পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে। কাজ করছিল। ১০ আগস্ট ছিল মুজিবের ছােটবােনের মেয়ের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তার আত্মীয়স্বজন ঢাকায় জড়াে হয়েছিল। ১৪ আগস্ট ছিল সেরনিয়াবাতের মায়ের চেহলাম। সেজন্য অতিথিদের অনেকেই ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন এবং টার্গেটকৃত | তিন পরিবারের সবাই ধানমণ্ডির সন্নিহিত স্বল্প দূরবর্তী এলাকায় অবস্থান করছিলেন।  মুজিবের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ, বিদ্যু, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রি। তাঁর মন্ত্রিপাড়াস্থ বাসভবনে মাত্র একজন পুলিশ পাহারারত ছিল। মেজর ডালিমের নেতৃত্বাধীন আক্রমণকারীরা পৌছেই প্রহরীকে গুলি করে। গুলির শব্দে সবাই জেগে ওঠে। সেরনিয়াবাত ফোনে মুজিবকে সাহায্য পাঠানাের কথা বলতে গিয়ে তার বাড়িও আক্রান্ত জেনে আর একটিও কথা না বলে, ফোন নামিয়ে বিছানার উপর বসে পড়েন।

তার ৩০ বছর বয়সী ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ্ ওঠে জানালার পাশ দিয়ে আগত কালাে উর্দিপরা সৈন্যদের লক্ষ্য করে তার কাছে থাকা স্টেনগান দিয়ে ম্যাগজিন শূন্য না হওয়া পর্যন্ত গুলি ছুড়তে থাকে। গুলি ফুরিয়ে গেলে আরাে গুলির জন্য বাড়ির উপরতলায় আসে। ততক্ষণে সৈন্যরা উপরে ওঠে আসার বুটের আওয়াজ পেয়ে সে লাফ দিয়ে চিলেকোঠার মেঝেতে/চালে বসে পড়ে। আর সৌভাগ্যক্রমে এতেই সে বেঁচে যায়। | সৈন্যরা মুহূর্তের মধ্যে শয়নকক্ষে ঢুকে, বিছানায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। থাকা সেরনিয়াবাতকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তারা বাড়ির সবাইকে ধরে নিয়ে। ড্রইংরুমে জড়াে করে। মিনিট বিশেক ধরে থেমে থেমে চলছিল গুলির আওয়াজ আর কানফাটা চিকার। একসময় দূরে রাস্তায় সৈন্যদের বুটের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। এরপর দু-একটি গােঙানির শব্দ ছাড়া সবই নিস্তব্ধ। আক্রমণকারীরা চলে গেছে বুঝতে৪৫. এ সময় রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান বিদেশে এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল সাবিহ উদ্দিনও ছুটিতে (বিদেশে) ছিলেন। একটি বাহিনীর প্রধান দুই কর্মকতা কীভাবে । একই সাথে ছুটিতে থাকতে পারে-তা বােধগম্য নয়। তাছাড়া, ফারুকের বাহিনী বেরিয়ে আসার সময় ৪র্থ ও ১ম বেঙ্গল পদাতিকবাহিনীর পিটিরত সৈনিকদের সাথে দেখা হয়। তারা সকলেই। ড্রিল বন্ধ করে ট্যাঙ্ক বহরকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার যে, ট্যাঙ্কের। অতবড় বহর তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে দেখেও কারাে মনে কোনাে। সন্দেহ জাগে নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারানহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৮-৮০পেরে হাসনাত অতি সন্তর্পণে নিচে নেমে এসে দেখে ড্রইংরুম কসাইখানায় পরিণত হয়ে গেছে। চতুর্দিকে কেবল রক্ত, মৃতদেহ আর ভাঙাচূড়া আসবাবপত্রের স্থূপ। তার স্ত্রী, মা আর বিশ বছরের একটি বােন গুরুতর আহত। দুই কন্যা সােফার পেছনে পালিয়ে অক্ষত অবস্থায় কাঁপছে। তার পিতা, পাঁচ বছরের ছেলে, দশ ও পনেরাে বছরের দুটি বােন, এগারাে বছরের ছােটভাই, চাচাত ভাই শহীদ, আয়া, কাজের ছেলে ও বরিশাল থেকে আগত জনৈক বন্ধুর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। | রিসালদার মােসলেহউদ্দিন দু’ট্রাক সৈন্য নিয়ে পৌছামাত্রই শেখ মণি শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তারা তার বাড়ি পাহারা দিতে এসেছে কিনা জানতে চান এবং অনুরুদ্ধ হয়ে নিচে নেমে এলে মােসলেহ উদ্দিন তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। শশারগােল শুনে ঐ মুহূর্তে তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি স্বামীকে বাঁচানাের জন্য লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আর অমনি স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে উভয়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাড়ির আর কাউকে স্পর্শ না করে সংক্ষিপ্ত অথচ নৃশংসভাবে ‘মিশন সম্পন্ন করে মােসলেহ উদ্দিন মুজিবের বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি চালিয়ে দেয়।মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বাধীন প্রধান ঘাতকদলটি ধানমণ্ডির তদানিন্তন ৩২ নম্বর সড়কে পেীছে মুজিবের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে, পূর্ব ও পশ্চিম প্রবেশমুখে এবং আশেপাশের বাড়ির ছাদে সৈন্য মােতায়েন করে। বাড়িটির চতুর্দিক ঘিরে ফেলে মিরপুর রােডে লেকের পাড়ে মুজিবের বাড়ির মুখােমুখি বসানাে হয় একটি হাউইটজার। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে পূর্বাকাশে উদিত হয় লাল সূর্য। বিউগলের সুরে জাতীয় সংগীতের মূর্ঘনার সাথে উত্তোলিত হয় জাতীয় পতাকা। আর্মি গার্ডদের কালভােরের পালাবদলের সময় ঘটে জঘন্য আক্রমণ। | বাড়ির এলাকার বাইরের প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশ ভারি অস্ত্রে সজ্জিত উর্দিপরা সৈন্য দেখে ভড়কে যায় এবং কোনাে প্রকার বাদানুবাদ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। গেটে প্রহরারত ল্যান্সার প্রহরীরা তাদেরই কিছু সহকর্মী আর অফিসার দেখে প্রভাবিত ৪৮ হয়ে৪৭ মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ির অন্যতম আর্মি গার্ড কমান্ডার আব্দুল গণি হত্যা মামলায় তার সাক্ষ্যেবলেন যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ বিকাল অনুমান ৪টা ও ৫টায় যথাক্রমে ডালিম ও হুদা মােটর সাইকেলযােগে মুজিবের বাড়ি রেকি করে যায়। ১৯৭৫ সালের জুলাই পর্যন্ত মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ি ও গণভবনের প্রহরার দায়িত্ব ছিল ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের। জুলাইয়ের শেষদিকে তা পরিবর্তন করে কুমিল্লা থেকে ১ম ফিল্ড আর্টিলারির একটি ব্যাটারি এনে তাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। মেজর ডালিম, পাশা ও হুদা ঐ আর্টিলারির অফিসার ছিল। গার্ড কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল গণির মতে, তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ারদার ১৫ আগস্ট ভাের অনুমান সােয়া ৪টার দিকে এসে তাদের গার্ড চেক করেন। এবং নতুন গুলি দেবে বলে পুরনাে গুলি নিয়ে নতুন গুলি না দিয়েই গাড়িতে উঠে চলে যায়। ফলে তাদের পক্ষে ঘাতকদের চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়নি, বরং প্রাণভয়ে তারা গার্ড রুমে আশ্রয় নেয়। তবে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে হত্যা মামলায় জোয়ারদারের বিরুদ্ধে গুলি নিয়ে নেওয়ার অভিযােগ সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত হয়নিপড়ে, তাদের কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল’ ভেঙে পড়ে এবং তারা ঘাতকদের হুকুম তামিল করতে বাধ্য হয়।

সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণের সংবাদ পেয়ে মুজিব ইন্টারকমে তার রিসেপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ মহিতুল ইসলামকে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে টেলিফোন লাগাতে বলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দোতলা থেকে নিচে নেমে আসেন। পুলিশ কন্ট্রোলরুম না পেয়ে মহিতুল গণভবন এক্সচেঞ্জ পায় কিন্তু সেখানেও কেউ উত্তর দেয় না। মুজিব মহিতুলের হাত থেকে রিসিভার নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’ বলার সাথে সাথেই একঝাক গুলি দক্ষিণদিকের জানালার কাঁচ ভেঙে অফিস কক্ষের দেয়ালে এসে লাগে। মুজিব টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। অল্পক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে তিনি উঠে বারান্দায় এসে আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তােমরা কী কর?’ বলে উপরে ওঠে গেলেন। আব্দুর রহমান রমার ডাকে ঘুম থেকে ওঠে হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরিহিত শেখ কামাল এ সময় নিচে বারান্দায় এসে ‘আমি ভাই, পুলিশ ভাই, সবাই আমার সাথে আসুন” বলার সাথে সাথে কয়েকজন কালাে ও খাকি-পপাশাকধারী সশস্ত্র লােক সামনে এসে তাকে গুলি করে। বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত ডিএসপি নূরুল ইসলাম পুলিশকে পাল্টা গুলি চালাবার নির্দেশ দেন। ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল’-আশ্চর্য ও দ্বিধা মিশ্রিত কণ্ঠে এ-কথা উচ্চারিত হওয়ামাত্র বজলুল হুদা হ্যান্ডস আপ’ বলেই কামালকে গুলি করে হত্যা করে। গুলিতে মহিতুল এবং নূরুল ইসলামও আহত হন। এরপর ঘাতকরা ফাঁকা গুলি করতে করতে দোতলায় যায়, আর এদিকে আরাে ২০/২৫ জন সেনা বাড়ির ভেতর ঢােকে। অন্যদিকে, তাদের সাপাের্ট দিতে মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে হাউইটজার থেকে নিক্ষেপিত হয় রকেট। রকেটের প্রথম দু’টি ধানমণ্ডি লেকের দু’পাশে গিয়ে পড়ে। এরপর তারা কামান উচিয়ে আরও কয়েক রাউন্ড গােলা নিক্ষেপ। করে যার একটি প্রায় ৬ কি.মি. দূরে মােহাম্মদপুরে এক বিহারীর বাড়িতে পড়ে দু’ব্যক্তি নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।  বাড়ির ভেতর ঢুকেই তারা নিচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাশী করে এবং মহিতুল, ডিএসপি নূরুল ইসলাম, টেলিফোন মিস্ত্রি আব্দুল মতিন, রাখাল আজিজ, কাজের বুয়া, এসবি’র অফিসার সিদ্দিকুর রহমান ও অন্যান্য পুলিশদের গেটের পাশে এনে লাইন করে দাঁড় করায়। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবি’র অফিসারকে গুলি করে এবং কয়েকজন আর্মিকে সেখানে প্রহরায় রেখে বাকিরা মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে ফায়ার করতে করতে দোতলায় উঠে যায়।৪৯.

সম্ভবত সেরনিয়াবাতের ফোন পেয়ে মুজিব ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। অ্যান্থনি ম্যাসকারনাস উল্লেখ করেছেন যে, শেখ কামাল এবং জামাল তাদের স্টেনগান নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দু’জন সৈন্যকে আহত করে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সিঁড়ির গােড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)।এদিকে দোতলায় ওঠে মুজিব আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রথমেই রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে ফোন করেন। রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও টুআইসি কর্নেল সাবিহউদ্দিন উভয়েই তখন দেশের বাইরে। অন্যকোনাে সিনিয়র অফিসারকেও মিলাতে না পেরে তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, তার (মুজিবের) সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক ও সামরিক গােয়েন্দাবিভাগের পরিচালক কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে ফোন করে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। জেনারেল শফিউল্লাহ কোনাে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি বা গ্রহণে ব্যর্থ হন। ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক ফোন পেয়ে মুজিবের এডিসিদ্বয় ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ ও কমান্ডার গােলাম রব্বানীসহ ছুটে আসেন এবং মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি এসে ঘাতকবাহিনীর হাতে বন্দি হন (পরে ফারুক তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে)। কর্নেল জামিল সংবাদ পাওয়ামাত্র ফোর্সকে দ্রুত তৈরি হয়ে মুজিবের বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গাউন পরিহিত অবস্থায়ই নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হন এবং মিরপুর রােডে সােবহানবাগ মসজিদের কাছে (মতান্তরে মুজিবের বাড়িতে ঢােকার প্রাক্কালে) ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন। | এরই মধ্যে ঘাতকরা বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুজিবের সন্ধানে প্রতিটি কামরা তন্নতন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ, অপ্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন তাকে দোতলার সিঁড়ির গােড়ায় দাঁড়ানাে দেখতে পায়। মুজিবের ব্যক্তিত্ব এত প্রবল ছিল যে, মুখােমুখি হতেই মহিউদ্দিন মনােবল হারিয়ে নতজানু হয়ে পড়ে এবং আমতা-আমতা করে বলে স্যার, আপনি আসুন।’ এমতাবস্থায় ধমকের সুরে মুজিব বলেন : তােমরা কী চাও? তােমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও! পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি।

তােমরা কি মনে করাে-তা করতে পারবে? এমন সময় মেজর নূর সেখানে পৌছে এক-মুহূর্তও দেরি না করে চিৎকার দিয়ে মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে আবােলতাবােল বকতে বকতে কাধের স্টেনগান দিয়ে৫১ জেনারেল শফিউল্লাহ দাবি করেন, ঘাতকদের আক্রমণের সংবাদ পেয়েই তিনি কর্নেল শাফায়াত জামিলকে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে নিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন এবং খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে শাফায়েত জামিলকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। কিন্তু শাফায়াত জামিল এ দাবি অস্বীকার করে বলেন : সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এই বিদ্রোহ সম্পর্কে সংবাদ পেয়ে অপর দুই বাহিনী প্রধান ও সেনানিবাসে অবস্থানরত ইউনিট কমান্ডারদের সাথে যােগাযােগ করা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তিনি কাউকে প্রতিরােধ-উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বা নির্দেশ দেননি। অধিকন্তু, সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস খালেদ মােশাররফ শাফায়াতের কমান্ড অধিগ্রহণ করায় তার (শাফায়াত) উদ্যোগে সম্পন্নপ্রায় বিদ্রোহ দমন প্রস্তুতি’ আর কার্যকরী হওয়ার। সুযােগ পায়নি। অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নস্যাতে নিবৃত্তিমূলক হামলা করার জন্য দু’ঘণ্টা সময় প্রয়ােজন। সেনাপ্রধান উদ্যোগ নিলে মুজিবকে বাঁচাতে না পারলেও ফারুক-রশিদ-মােশতাকের কু-কে প্রতিহত করা সম্ভব হত।ব্রাশ ফায়ার করে। গুলির আঘাতে তার দেহ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে সিঁড়ির মাথায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে যায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করার কথা ছিল।  মুজিবকে হত্যা করে নূর, হুদা, মহিউদ্দিন সবাই নিচে নেমে গেটের সামনে রাস্তায় চলে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ জামাল পরিবারের সকল সদস্যদের মুজিবের শয়নকক্ষে এনে জমায়েত করেন। এমন সময় মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মােসলেহ উদ্দিন তাদের ফোর্সসহ গেটের সামনে আসে। আজিজ পাশা তার ফোর্স নিয়ে দোতলায় ওঠে এসে শয়নকক্ষের দরজা খুলে দিতে বলে এবং না-খােলায় দরজায় গুলি করে।

বেগম মুজিব তখন দরজা খুলে সামনে এসে তাদের না মারার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। কয়েকজন সৈনিক বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও একজন চাকরকে (রমা) সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। সিড়িতে স্বামীর রক্তাক্ত লাশ দেখে বেগম মুজিব থমকে দাঁড়ান এবং বুকফাটা চিষ্কার করে বলতে থাকেন, ‘আমি আর কোথাও যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলাে।’ ঘাতকরা তখন নাসের, রাসেল ও চাকরটিকে নিচে নিয়ে গেটের পাশে লাইনে দাঁড় করায় এবং বেগম মুজিবকে পুনরায় শয়নকক্ষে নিয়ে যায়। এরপর আজিজ পাশা ও মােসলেহ উদ্দিন শয়নকক্ষের সকলকে অত্যন্ত কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। ওরা তখন মেতে ওঠে রক্তের হুলি খেলায়। গুলি করে বােল্ট উড়িয়ে দিয়ে একের পর এক দরজা খুলে৫২. মুজিবহত্যার বর্ণনাটি অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের পূর্বোক্ত গ্রন্থের ৭৭ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া। তবে, হত্যা মামলার ৮ নং সাক্ষী মেজর শাহাদাত হােসেন খান, মেজর হুদার জবানিতে বলেন : “আমি যখন দলবলসহ বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই, তিনি তখন বলেন : “তােমরা কেন আমার বাসায় এসেছে? কে তােমাদের পাঠিয়েছে? শফিউল্লাহ কোথায়? -এই বলিয়া আমাকে ঝটকা মারে। তখন আমি পড়ে যাই। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করি।’ (ড, মােহাম্মদ হাননান, পূর্বোক্ত, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৬৫)। মুজিবের বুকে, পেটে, হাতে ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে ২৯টি (মতান্তরে ৫টি) গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। একটি বুলেট পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরের অংশ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং শাহাদাত অলিটি ছিল গুলির আঘাতে ছেড়। দু’পায়ের গোড়ালির রগ ছিল কাটা। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের চেক লুপ্তি, গায়ে শাদা গেঞ্জি ও শাদা পাঞ্জাবি। সবই রক্তমাখা। ‘ডানহাতে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ ও বামহাতে ম্যাচ (?)’ পাশেই পড়ে ছিল কালাে ফ্রেমের চশমা একজোড়া স্যান্ডেল ও একটি তােয়ালে। হত্যা করেও ঘাতকদের পৈশাচিকতা প্রশমিত হয়নি। এদের একজন (ঘাতক মােসলেহ উদ্দিন?) কাছ থেকে মুজিবকে দেখার সুযােগ না পাওয়ায় তার পায়ের বুট নিষ্প্রাণ-দেহের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে অত্যন্ত বর্বরােচিতভাবে হেচকা টানে মৃতদেহকে উল্টিয়ে সে সাধ পূরণ করে। এর প্রায় ৪ ঘন্টা পর কর্নেল মশিউদ্দৌলা ও কর্নেল মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে তথ্য দফতরের জনৈক ফটোগ্রাফার ঐ অবস্থায় তার ছবি ওঠায়। বিলেতের স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে সদ্য বিবাহিত জামাল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সেনাবাহিনীতে কাজ করছিলেনব্রাশ ফায়ার করে ঘরগুলােকে ঝাঝড়া করে দেয়-যেন একটা প্রাণীও বেঁচে না থাকতে পারে।শেখ নাসেরের হাতে আগেই গুলি লেগেছিল এবং বেগম মুজিব তার শাড়ির পাড় ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়েছিলেন। জনৈক সেপাই তাকে গেটের পাশের লাইন থেকে বের করে অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে তিনি যখন কাতরকণ্ঠে পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন তখন একজন সেপাই অপর একজনকে বলে : ‘যা পানি দিয়ে আয়। দ্বিতীয় সেপাইটি তখন সেই বাথরুমে গিয়ে নাসেরকে পুনঃ গুলি করে চিরতরে তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়।সুলতানা কামাল, রােজী জামাল, মুজিবের সদ্য বিবাহিতা দুই পুত্রবধূ ১০ বছরের শিশু রাসেলের গলা জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছিল। সেপাইরা তাদেরকে জঘন্যভাবে টেনে আলাদা করে। রাসেল তখন আলনা ও অন্যান্য আসবাবপত্রের আড়ালে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। সেপাইরা তাকে খুঁজে বের করে নিচে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করায়। অবােধ শিশু তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ‘আকুলি বিকুলি করে। মেজর নূরের নির্দেশে এক হাবিলদার ওকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ওপরে শয়নকক্ষে নিয়ে গুলি করে। মাথার মগজ ও চক্ষু বের হয়ে যাওয়া রাসেলের দেহ লুটিয়ে পড়ে তার মায়ের মৃতদেহের কাছে।সেনাদের লুটপাট কিছুক্ষণ পর ইউনিফরম পরিহিত ডালিম ও ফারুক মুজিবের বাড়ির গেটের সামনে আসে। ফারুকের খবর কী’ জিজ্ঞাসার জবাবে হুদা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় ‘অল আর ফিনিশড’।

হুদার এ সর্বনাশা উক্তির নিদর্শনস্বরূপ নূরের কপালে তখনাে লেগেছিল তাজা রক্তের দাগ। হত্যাযজ্ঞের পুরস্কার হিসেবে ফারুকের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে লেন্সরের একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদাকে মেজরের ব্যাজ এবং হুদা সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারদারকে অনারারি লেফটেন্যান্টের ব্যাঙ্ক পরিয়ে দেয়। এরপর ডালিম ও ফারুক বেরিয়ে পড়ে যথাক্রমে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ ও ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। আর এদিকে আক্রমণকারীরা মেতে ওঠে লুটপাটে। আর্টিলারি আর ল্যান্সারের অফিসার, জোয়ান আর এনসিওরাও বাদ যায়নি। যে যেভাবে পেরেছে, দুহাতে লুটেছে। বাড়ির প্রতিটি কামরার প্রতিটি আলমারি, ড্রয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র ভেঙে/খুলে মূল্যবান সামগ্রী হ্যাভারসেকে ঢুকায়, বাকি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে তছনছ করে। ওয়াহাব জোয়ারদার” আলমারি থেকে একটি ব্রিফকেস বের করে এর মধ্যে ভরে নেয়৫৬.  সঠিক অর্থেই তাদের হাতের বিয়ের মেহেদির রঙ তখনও মুছে যায়নি ৫৭ ওয়াহাব জোয়ারদারকে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার কাজে অবস্থানরত সেনাদের বেতন বিলি করতেএকদিনের জন্য ঢাকায় পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকান্ডের অনেকদিন পর সে তার কর্মস্থল কুমিল্লায় ফেরে এবং নিজমুখে হত্যাকান্ডের পর লুপাটের কথা বিবৃত করে।স্বর্ণালঙ্কার আর বিদেশী মুদ্রা। রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি ভারি মালামাল তারা রাস্তার পাশে দণ্ডায়মান একটি জিপে উঠিয়ে নিয়ে যেতেও ভােলেনি। ক্ষমতা দখল এদিকে সকলকে প্রলয়ঙ্করী মিশনে পাঠিয়ে দিয়ে রশিদ সােজা চলে যায় স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের বাসায়। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে পূর্বপরিকল্পনামতাে মিগ নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেন। কিন্তু লিয়াকত বিমানবাহিনীর প্রধানের নির্দেশ ছাড়া কিছু করতে পারবে না জানালে রশিদ সাথে সাথে ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেডের মেজর হাফিজের কাছে যায়। ১৬তম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর শাহজাহান জয়দেবপুর থেকে এসে আক্রমণকারীদের সাথে মিলিত হতে অস্বীকার করায় রশিদ হাফিজকে দিয়ে ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে তাদের সাথে জড়িত করার চেষ্টা করে। তার প্রত্যাশা ছিল, অভিযান শুরু হয়ে গেছে’ জানলে হাফিজ যােগ দিতে ইতস্তত করবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাফিজও রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্রিগেড কমান্ডার বা সেনাপ্রধানের নির্দেশ ছাড়া কিছু করতে পারবে না। বলে জানায়।

সশস্ত্র রশিদ তখন হাফিজকে নিয়ে তার কমান্ডিং অফিসার শাফায়াত জামিলের উদেশ্যে রওয়ানা হয়। কর্নেল আমিন আহমদ (সেনাসদর) ও মেজর হাফিজসহ রশিদ যখন শাফায়াত জামিলের বাসার কম্পাউন্ডে ঢােকে তখনই ধানমণ্ডির দিকে হাউইটজারের গােলা নিক্ষেপের আওয়াজ ভেসে আসে। দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে রশিদ শাফায়াতকে বলে : উই হ্যাভ ক্যাপচারড স্টেট পাওয়ার আন্ডার খন্দকার মােশতাক। শেখ ইজ কিন্ড। ডােন্ট টুই টু টেক এনি একশন এগেইনস্ট আস্। শুনে শাফায়াত ক্রুদ্ধ, শােকাভিভূত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ তাকে মুজিবের বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর জানান (মতান্তরে ব্রিগেড নিয়ে মুজিবের সাহায্যে যেতে নির্দেশ দেন)। রশিদ তখন জিপ নিয়ে। ধানমণ্ডির দিকে ছুটে যায়। মুজিবের বাড়িতে পৌছে রশিদ দেখতে পায় সবকিছুই নীরব, নিস্তব্ধ। সৈন্যরা। বাড়ির বাইরে টহল দিচ্ছে। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনী ফারুকের ট্যাঙ্কের কাছে পরাস্ত। জেনারেল হেডকোয়ার্টার শােকে মুহ্যমান। অভিযানের সাফল্যে রশিদ এতই প্রলুব্ধ হয়ে৫৮. কুর পর ডালিম, নুর, শাহরিয়ার, মাজেদ ও ইঞ্জিনিয়ার্সের কিছু সৈন্য বাংলাদেশ বেতার ভবনের অভ্যন্তরে অবস্থান করতাে এবং ঢাকা ও আশেপাশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ধরে এনে জোর করে। টাকা-পয়সা আদায় করতাে (কর্ণেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৮)। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। প্রচুর টাকা বানিয়েছেন বলে রশিদ নিশ্চিত করে বলেছেন (অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮)। ফারুকের বিপ্লব-সরকারি শাসনযন্ত্র নির্মল করার মহান” অভিযান-বিশেষ করে শেখ মুজিবকে। হত্যা করার আসল উদ্দেশ্য-তার মতে এজন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।পড়ে যে, নিজেরাই ক্ষমতা দখলের কথা ভাবতে শুরু করে। কিন্তু রেডিওতে ডালিমের ঘােষণা” শুনে রশিদের ভাবনায় ছেদ পড়ে। প্রথমত ডালিমের মতাে একজন চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার কর্তৃক ঘটানাে অভ্যুত্থান সম্পর্কে ঢাকার বাইরের ব্রিগেডগুলােতে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়ত মুজিবের পুরাে পরিবার খতম করা হয়েছে জানতে পারলে জনসমর্থন তাদের বিপক্ষে চলে যাবে এবং এজন্য আন্তর্জাতিকভাবেও তারা নিন্দিত হবে। ফলে নিজেদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলে রশিদ একটি ট্যাঙ্ক পেছনে নিয়ে দ্রুত আগামসি লেনের দিকে তার জিপ ছুটিয়ে দেয় এবং মােশতাককে নিয়ে রেডিও অফিসে পৌছে। এরপর তিন বাহিনী প্রধানকে এনে আনুগত্য প্রকাশের মােশতাককৃত প্রস্তাবকে রশিদ উত্তম’ বিবেচনা করে ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা হয়।

মুজিব নিহত নিশ্চিত হয়ে ফারুক রাজধানীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য তার বহর থেকে ১০টি ট্যাঙ্ক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে যায়। সারিবদ্ধভাবে সাজানাে ট্যাঙ্কগুলাে দেখে রক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। বিনাযুদ্ধে জয়লাভ করে ফারুক রক্ষীবাহিনীকে সে-মুহূর্ত থেকে সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত ঘােষণা করে বলে যে, তাদেরকে এখন থেকে সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একই সাথে সে ফোন উঠিয়ে এ বিষয়ে মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক কর্নেল নুর উদ্দিনের সাথে আলাপ করে নিয়ে। ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। সেখানে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে ঢােকার মুখে রাস্তায় অবস্থান। নিয়ে সে সাপ্লাই এ্যান্ড ট্যান্সপাের্ট কোম্পানির সারিবদ্ধ গাড়িগুলাের উপর হেভি মেশিনগান দ্বারা ফায়ার করে। এতে কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও কয়েকজন সৈনিক আহত হয়।রশিদ চলে যাওয়ার পর দ্রুত ইউনিফরম পড়ে শাফায়াত জামিল ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার পথে উপ-সেনাপ্রধান জিয়ার বাসায় যান। জিয়া তখন সেভ৫৯. হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পরপরই ডালিম তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রেডিও অফিসে গমন করে। সশস্ত্র। সৈন্যদের দেখে প্রহরারত পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী দল আত্মসমর্পণ করে। অস্ত্রের মুখে ট্রান্সমিটার অন করিয়ে ডালিম ঘােষণা দেয় : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। কার্টু জারি করা হয়েছে।’ ঘােষণায় আরো বলা হয় : দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত হবে।’ (ড. মােহাম্মদ হাননান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৪ ও অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৪) ।৬০.  রশিদ পূর্ববর্তী তিনটি আলােচনায় মােশতাককে মুজিবের স্থলাভিষিক্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং ইতােমধ্যে রেডিওতে ‘ডালিমের ঘােষণা শুনে দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য মােশতাক প্রস্তুত হয়েই ছিল। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের বর্ণনামতে, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে সবগুলাে ট্যাঙ্ক পার্ক করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফারুক বলে, “আমরা আমাদেরকে আপনাদের কমান্ডে ন্যস্ত করলাম’। অফিসাররা স্পষ্টতই বিক্ষুব্ধ ছিল। শাফায়েত জামিলের সাথে ফারুক সবিনয়ে কথা বলতে চাইলেও জামিল তাকে কে তােমাকে উপদেশ দিতে বলেছে? বন্ধ কর তােমার মুখ -বলে ধমক। দেন (এন্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৩)।করছেন। রশিদের কথা আর শফিউল্লাহর ফোনের বর্ণনা দিয়ে শাফায়াত জিয়ার নিকট করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা চান।

প্রতিউত্তরে শান্তকণ্ঠে জিয়া বলেন : প্রেসিডেন্ট যদি বেঁচে না থাকেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট তাে আছেন। তােমরা হেডকোয়ার্টারে যাও এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করাে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকালে ধাক্কার শব্দ পেয়ে দরজা খােলে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ। তার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাউদ্দিনের নিকট আমার ও আর্টিলারি শহরে (রেডিও সেন্টার, গণভবন, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডে) যাচ্ছে জানতে পেয়ে শঙ্কিত হয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে শাফায়াত জামিলকে (সালাউদ্দিনের মাধ্যমে ও ফোনে) তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে তাদের প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর মুজিব নিহত শুনে তিনি অপর দু’বাহিনীর প্রধান এবং সেনা-উপপ্রধান ও সিজিএসকে তার বাসায় আসতে বলেন। ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে নাইট ড্রেসে সিজিএস খালেদ মােশাররফ, প্যান্ট-শার্টে বিমানপ্রধান আব্দুল করিম খন্দকার, ক্লিন-সেভড ধােপদুরস্থ ইউনিফরমে সেনা-উপপ্রধান জিয়াউর রহমান ও নৌ-প্রধান মােশাররফ হােসেন খান এসে পৌঁছান। সংক্ষিপ্ত আলােচনায় জানা যায়, মাত্র গুটিকয় কর্মরত ও প্রাক্তন জুনিয়র অফিসার দুটি ইউনিটের কিছু সৈন্যসহযােগে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই এটি যেন পুরাে আর্মিতে ছড়িয়ে না পড়ে বা পুরাে আর্মি যেন উদ্ধৃঙ্খল না হয়ে পড়ে তার ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সফিউল্লাহ শাফায়াত জামিলকে সাহায্য করার জন্য খালেদ মােশাররফকে ৪৬তম ব্রিগেডে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু জিয়া এর বিরােধিতা করে শফিউল্লাহকে বলেন ‘Don’t send him, he is going to spoil it.’ কিছুক্ষণ পর রেডিওতে মুজিবহত্যার ঘােষণা শুনে শফিউল্লাহ স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। এ সময় জিয়া শফিউল্লাহকে আবার বলেন : সিজিএস খালেদ মােশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না। তাকে বলে Ops order তৈরি করতে। কারণ, ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন-ইন দিস প্রিটেক্ট। এমন সময় ইউনিফরম পরিহিত ডালিম ১০/১৫ জন সৈন্যসহ সশস্ত্র অবস্থায় দরজা ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে বলে : ‘President wants you in the radio station.’ প্রেসিডেন্ট তাে মারা গেছেন। সফিউল্লাহর এ-কথার পিঠে utiera ‘Sir, you should know Khandaker Mostaque is the president now.’ উত্তরে শফিউল্লাহ বলেন ‘Khandaker Mostaque may be your president, not mine.’ প্রত্যুত্তরে ডালিম বলে, ‘Sir, don’t make me do something for which I did not come.’ ‘তােমার যা খুশি করতে পারাে, আমি আমার টুপসের কাছে যাচ্ছি’৬২. শাফায়াত জামিল মুজিব হত্যা মামলায় তার সাক্ষ্যে বলেছেন, জিয়ার প্রতিক্রিয়া ও উক্তি ছিল।

নিম্নরূপ: ‘তাতে কী, রাষ্ট্রপতি নিহত, উপরাষ্ট্রপতি আছেন, সংবিধান সমুন্নত রাখাে” ৬৩. সেনাপ্রধান বা উপপ্রধান কেউই এরূপ নির্দেশ দেননি বলে শাফায়াত জামিল জানানবলে শফিউল্লাহ অফিস থেকে বের হয়ে ৪৬ ব্রিগেডে রওয়ানা হন। ডালিম তার সশস্ত্র সৈন্য-সামন্তসহ তাকে অনুসরণ করে।কিছুক্ষণ পর নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়ও সেখানে আসেন। রশিদ তিন বাহিনী প্রধানকে তাদের কৃতকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে সহযােগিতা কামনা করে বলে : আমরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তা করেছি। আমরা আপনাদের ত্যাগ করছি না এবং আমরা ক্ষমতায়ও যেতে চাচ্ছি না। আমরা বরং আপনাদের নেতৃত্ব চাই। সুতরাং আপনারা রেডিও স্টেশনে আসুন এবং যা কিছু করণীয় তা করুন। কোনােরূপ কাউন্টার অ্যাকশনে রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে এবং চাপের মুখে তারা তখন রেডিও সেন্টারে যান। ডালিম তাদের এসকর্ট করে। উপ-সেনাপ্রধান জিয়াও তাদের পেছনে পেছনে রেডিও সেন্টারে যান। তারা রেডিও সেন্টারে ঢােকার পর মােশতাক বলেন ‘Shafiullah, congratulation; your troops have done an excellent job, now do the rest.’ ‘what rest?’ শফিউল্লাহর এ প্রশ্নের জবাবে মােশতাক বলেন : ‘You should know it better’, ‘In that case, leave it to me’ বলে শফিউল্লাহ বের হতে উদ্যোগী হলে ডালিম-রশিদ প্রমুখ পথ আগলে তাকে অন্য একটি কামরায় নিয়ে যায়।”কিছুক্ষণ পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কর্তৃক মুসাবিদাকৃত মােশতাক-সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ঘােষণা পর্যায়ক্রমে তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান (মে.জে. খলিলুর রহমান), রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, পুলিশ প্রধান (নূরুল ইসলাম) প্রমুখের৬৩. রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের চেয়েও তাদের কাছে নিজেদের ক্ষমতা বা প্রাণহানির আশঙ্কা সম্ভবত বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিমানপ্রধানের ভাষায় সেখানে সম্পূর্ণ Indiscipline ও Chaotic অবস্থা বিরাজ করছিল। some of the armed officers were on the edge of irrationality and tension; minimum confrontation or disagreement could have lead to spree of killing.’ এবং ফারুকের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে মুজিবের মৃত্যুসংবাদ শুনে জেনারেলরা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। মেজরদের বিরুদ্ধে কোনাে পদক্ষেপ নেয়ার সাহস কেউ দেখায় না। এ সময় ওসমানী ও কর্নেল তাহের রেডিওতে উপস্থিত ছিলেন মােশতাক তখন শাদা প্রিন্সকোট ও মাথায় কালাে (নেহেরু) টুপি পরিহিত ছিলেন।

এ পােশাককে পরে তিনি রাষ্ট্রীয় পোশাক হিসেবে ঘােষণা করেন। মতান্তরে, ধুরন্ধর উকিল মােশতাক ফাঁদে ফেলার জন্য শফিউল্লাহকে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন : “আমাকে বলুন, এ কাজ কি আপনি করেছেন? তার সামনেই ছিল হত্যাকারী মেজরবৃন্দ। তাই বেকায়দায় পড়ে জীবনের ভয়ে আস্তে আস্তে শফিউল্লা বলেন হ্যা আমরাই তা করেছি।’ অন্য দু’প্রধানও একই উত্তর দিলেন। আপনারা আমাকে দিয়ে কী করাতে চান? মােশতাকের এ প্রশ্নের জবাবে ভীত-সন্ত্রস্ত প্রধানত্রয় বললেন, “আপনি দয়া করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। এখন বাংলাদেশে আপনিই একমাত্র গ্রহণযােগ্য ব্যক্তিত্ব’ । হত্যাকাণ্ডের পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর পশ্চিমা এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষৎকারে বলেছিল যে, মুজিবহত্যার পরিকল্পনাটি তার বাড়িতেই মাত্র দুই রাত আগে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি মােশতাকের প্রথম বেতার ভাষণটি তাহেরউদ্দিন ঠাকুর লিখেছিলেন। পরিষ্কার বােঝা যায় যে, এটা বেশ সময় ধরে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে লেখা হয়ে ছিল। উদ্ধৃত অ্যান্থনি, ম্যাসকারনহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০প্রত্যেকের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় ও বেতারে বারবার প্রচার করা হয়। এরপর তাদের এসকট করে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় (এবং সভা-সম্মেলন-আলােচনা প্রভৃতি বিভিন্ন অজুহাতে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেখানে আটকে রাখা হয়)। সেখানে সকলকে অভ্যর্থনা জানান মিসেস যােবায়দা রশিদ। জুম্মার নামাযের আগেই মােশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বিকালে তার মন্ত্রিরা শপথ গ্রহণ করেন। সন্ধ্যায় মােশতাক জাতির উদ্দেশে রেডিওটিভিতে ভাষণ দেন। আল্লাহর নামে শুরু ও বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে শেষ করা এই ভাষণে তিনি কুদেতাকে সমর্থন করে বলেন : সকলেই এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব। ছিল না বলেই সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়। …ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে সেনাবাহিনী জনগণের জন্য সুযােগের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট হয়েই মােশতাক গাজী গােলাম মােস্তফাকে রেডক্রস প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দান করেন এবং মাহবুব আলম চাষীকে তার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােগদান করেন।৬৯. ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানাে হয়েছে, জনমনে এমন একটি ধারণা দেয়ার উদ্দেশ্যে মোশতাক জুম্মার নামাজের জন্য দুপুরে ৩ ঘন্টার জন্য কার্য শিথিল করেন। মুজিবের রক্ত মাড়িয়ে মােহাম্মদউল্লাহ উপরাষ্ট্রপতি এবং ১. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী । ২. অধ্যাপক ইউসুফ আলী ৩, ফণীভূষণ মজুমদার।৪. মনোরঞ্জন ধর।

৫. আব্দুল মােমিন৬. আসাদুজ্জামান খান ৭, ড, এ আর মল্লিক৮, ড, মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী ৯, আব্দুল মান্নান১০. সােহরাব হােসেন মন্ত্রী ও ১. তাহেরউদ্দিন ঠাকুর২. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ৩, দেওয়ান ফরিদ গাজী৪. শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ৫. কে.এম, ওবায়েদুর রহমান ৬, মােসলেম উদ্দিন খান ৭. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল৮. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ৯, সৈয়দ আলতাফ হােসেন১০. মােমিন উদ্দিন আহমদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। (ক্রমিক নম্বর ৬১০ এই ৫ জন প্রতিমন্ত্রী ২০ আগস্ট শপথ গ্রহণ করেন) নিজেকে খাটি মুসলমান প্রমাণ করার জন্য পীরপুত্র মােশতাক সেদিন থেকে দাড়ি রাখতে শুরু করেন চুয়াত্তরের জানুয়ারিতে লেডিস ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গাজীপুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) ও ডালিমের মধ্য সংঘটিত অনাকক্ষিত এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে শৃঙ্খলার প্রশ্নে ডালিমসহ কয়েকজন সেনা অফিসারের চাকরিচ্যুতি ঘটে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক চাষীকে তার সচিব নিয়ােগ করেছিলেন এবং উভয়ে মিলে আমেরিকার সহযােগিতায় পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়েন। চাষী তাৎক্ষণিক ও মােশতাক বিজয়ের পরপরই পররাষ্ট্র মনন্ত্রীর দায়িত্ব হারান।এদিকে বিভিন্ন আলােচনা, সভা, কনফারেন্সের অজুহাতে বাহিনীপ্রধানদের এক কাপড়ে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়। তবে সমস্ত কিছু লক্ষ্য করে বিবেকপীড়িত হয়ে এই অন্যায় ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা অনুচিত ভেবে ১৭ আগস্ট কাউকে কিছু না বলে এ.কে. খন্দকার বঙ্গভবন থেকে চলে আসেন ও পরদিন সকাল ১০টায় পুন: বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এ.কে. খন্দকার জানান, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার খবরে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা ছিল মর্মাহত।

দুটি ইউনিটের গুটিকয় অফিসার-সৈন্য ছিল বিশৃঙ্খল। গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থাকায় উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষ ওদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনের কোনাে নির্দেশ দিতে পারেনি, তাই সামরিকবাহিনী কোনাে এ্যাকশনে যায়নি। বঙ্গভবন থেকে মুক্তি পেয়ে ১৮ আগস্ট রাতেই সফিউল্লাহ একটি কনফারেন্স ডাকেন। বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানসহ বেশকিছু উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা এতে উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হয় যে, কিছু উচ্ছল চাকরিচ্যুত ও চাকরিরত সামরিক অফিসার ও সৈনিক দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যার সঙ্গে (পুরাে) সামরিকবাহিনীর কোনাে সম্পর্ক নেই। এসব উদ্ধৃঙ্খল অফিসারদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরদিন শৃঙ্খলাভঙ্গকারী অফিসারদের সেনানিবাসে (চেইন অব কমান্ডে) ফেরত আনার উদ্দেশ্যে ফরমেশন কমান্ডারদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলেও প্রকারান্তরে এটি ব্যর্থ হয়। একই উদ্দেশ্যে ২২ আগস্ট সফিউল্লাহ্ বঙ্গভবনে গিয়ে মােশতাককে টুপস’ ফিরিয়ে নিয়ে রিগ্রুপিং-এর প্রস্তাবের জবাবে মােশতাক wait and see’ বলায় কার্যত তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শফিউল্লাহ্র এই উদ্যোগ সঙ্গতকারণে ঘাতকরা পছন্দ করেনি। দু’দিন পর (২৪ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে একটি নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্তির ঘােষণা দেয়া হয়। এদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় মােশতাক সফিউল্লাহকে বঙ্গভবনে যেতে বলেন। যথাসময়ে বঙ্গভবনে প্রবেশের মুখে তিনি জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খলিলকে বের হতে দেখেন। ওসমানী ও মােশতাক উভয়ই তার অনেক প্রশংসা করে বলেন, ‘তুমি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছ, এখন তােমার সার্ভিস দেশের বাইরে দরকার। ওসমানীর এই উপদেশ’-এর অর্থ উপলব্ধি। করেও সফিউল্লাহ ‘বিদেশে যেতে রাজি নন’ জানিয়ে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু৭৪। পরে মেজর রশিদকে পাঠিয়ে জার্মানি থেকে তাওয়াবকে এনে এই শূন্যপদ পূরণ করা হয়। গ্রুপ। ক্যাপ্টেন তাওয়াব ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে সবরকম। বেনিফিটসহ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জার্মানিতে অবস্থান ও ব্যবসা করছিলেন। তিনি পরে বাংলাদেশে সিরাতুন্নবী (স.) কালচারের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। জনাব খন্দকার আরও জানান, তাওয়াব বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে যােগ দেবার পর তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় হাই কমিশনার পদে নিয়ােগ করা হয়।ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে দেখেন, জেনারেল জিয়া ইতােমধ্যেই ‘চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে’ অফিসারদের সঙ্গে সভা করছেন।

জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার সঙ্গে সঙ্গে বিধি লঙ্ঘন করে তিনজন সিনিয়র। অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে দিল্লীতে সামরিক কোর্সে অংশগ্রহণকারী ব্রিগেডিয়ার হাে. মাে. এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে প্রমােশন দিয়ে ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়। জেনারেল খলিলুর রহমানকে করা হয় চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ। জেনারেল দস্তগীরকে করা হয় বিডিআর চিফ। অপরদিকে সফিউল্লাহকে বদলি করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সফিউল্লাহ মনে এই দুঃখ নিয়ে বিদায় নিলেন যে, সময়ের অভাবে ঘাতকদের তিনি কোর্ট মার্শালের আদেশ দিতে পারেননি। তার ভাষায় : বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় স্থম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। সে-সময় খুনিচক্রের হাতে জিম্মি হয়ে যা করেছি, বাধ্য হয়েই করেছি। তিনি আরও বলেন : খুনিরা ছাড়া পুরাে সেনাবাহিনী ছিল আমার কন্ট্রোলে। ইচ্ছে করলে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হতে পারতাম। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে যুক্ত করে ধ্বংস করতে চাইনি বলেই তা করিনি। অথচ জিয়া-এরশাদ ওই কাজটিই করেছে। বলাবাহুল্য, মেরুদণ্ডহীন’ সফিউল্লাহর স্থম্ভিত হয়ে পড়ার সুযােগে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের ক্ষমতা সংহত করার সুযােগ পায় । নিহতদের শেষকৃত্য। ১৬ আগস্ট সকালে বাড়ি নম্বর ৬৭৭, সড়ক নম্বর (তদানীন্তন) ৩২, ধানমণ্ডি থেকে । মুজিব ও এএসআই সিদ্দিকুর রহমান ব্যতীত অন্যদের এবং ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে আব্দুর রব সেয়নিয়াবাত ও শেখ মণির পরিবারের ৯টি সহ মােট ১৮টি লাশ লে, কর্নেল আবদুর রবের তত্ত্বাবধানে ‘হাইয়েস্ট অথরিটি বঙ্গভবনের নির্দেশে বনানী কবরস্থানে মাটিচাপা দিয়ে ‘ডিসপােজ’ করা হয়। লাশগুলাে থেকে তখন প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। গােসল, কাফন, জানাজা প্রভৃতি কোনাে ধর্মীয় আচার পালিত হয়নি। যে যে-কাপড়ে ছিল, তাকে সে-কাপড়েই সমাহিত করা হয়। একের পর-এক কবর খোড়া আর একের পর-এক লাশ মাটি চাপা দেয়া। লাশগুলাের কোনাে ময়না তদন্তও হয়নি। | পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের নিহত এএসআই মাে. সিদ্দিকুর রহমানের জানাজা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অনুষ্ঠিত হয় এবং মিরপুর ১নং শহীদ বুদ্ধিজীবী গােরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।১৬ আগস্ট অনুমান বিকাল ২টায় গােপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া থানার মাঠে।

হেলিকপ্টারে মুজিবের লাশ নেয়া হয়। সঙ্গে যাওয়া ১৫/১৬ জন সেনা হেলিকপ্টার৭৬.  ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮, ১৯৮-৯৯, ২০৩-০৪থেকে লাফিয়ে নেমে মাঠের চারদিকে অবস্থান নেয়। আর্মি কর্তৃক লাশ ‘যে-অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় মাটি দেয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করে উপস্থিত লােকজন বলেন, মুসলমানের লাশ বিনা গােসলে, বিনা কাফনে, বিনা জানাজায় দাফন করা যায় না।’ ফলে বাধ্য হয়ে তারা এজন্য ১০ মিনিট সময় দেয়। গােসল করানাের আগে এএসপি। শেখ আবদুর রহমানের সুরতহাল করানাের চেষ্টা দুজন আর্মি অফিসারের বাধার কারণে ভন্ডুল হয়। স্থানীয় রেডক্রস হাসপাতাল থেকে তিনটি শাদা শাড়ি ও পাশের দোকান থেকে ২টি ৫৭০ সাবান সংগ্রহ করে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মৌলভী আব্দুল হালিম শেখের তত্ত্বাবধানে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানাে হয়। জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য হাজার হাজার লােক হেলিপ্যাডের চারপাশে সমবেত হয়। কিন্তু সৈন্যরা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, জানাজায় শরিক হতেও দেয়নি। ২০/২৫ জন লোেক যারা গােসল-কাফনের কাজে যুক্ত হওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন, তাদের নিয়েই উক্ত ইমাম সাহেব জানাজা পড়ান এবং পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পশ্চিমপাশে তাকে দাফন'”করেন। নিহতদের শেষকৃত্যের সাথে জড়িত ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেডকোয়ার্টারের স্টেশন স্টাফ অফিসার মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ (আটিলারি) ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিঃ ১৫ আগস্টের ঘটনায় নিহতদের অবস্থা ও দাফন-কাফন এবং ঘটনা সম্পর্কে নিম্নরূপ পরিস্থিতি প্রতিবেদন পেশ করেন : ১৯৭৫ -এর ১৬ আগস্ট ভাের ৩টায় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডারের আদশে আমি প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি যাই। স্টেশন কমান্ডার আগেই পেীছে গিয়েছিলেন। মেজর বজলুল হুদা ও তার লােকজন পাহারা দিচ্ছিলেন বাড়িটি। হুদা আমাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরে ঢােকার অনুমতি দেন। ১. সড়ক নম্বর ৩২, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি : সবগুলাে লাশ সিঁড়ির গােড়ায় আনা হলাে। রাখা হলাে কাঠের কফিনে। বরফ আনা হয়েছিল। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রথম তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলােও ঝাঝরা হয়ে যায়। খােসাগুলাে মেঝেতে পড়া ছিল। কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙে গুড়িয়ে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনসপত্র, গিফটবক্স ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিয়েগুলাের উপহারের প্যাকেট। পবিত্র কোরআন শরিফও মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। ক. শেখ মুজিবের বাড়িতে নয়জনকে হত্যা করা হয়েছিল।

লাশগুলাে (প্রদত্তরিপাের্ট মতে) যে অবস্থায় পাওয়া যায় : ১. শেখ মুজিব : প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানটায় যে সমতল অংশটি তারতিন-চার ধাপ ওপরে। চশমার ভাঙা কাঁচ ও একটি পাইপ সিঁড়িতে পড়ে ছিল।৭৭. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৯, ৫৩, ৯১, ৯২, ১৫৯৬১২. শেখ কামাল : অভ্যর্থনা কক্ষে। ৩. টেলিফোন অপারেটর : অভ্যর্থনা কক্ষে। ৪. শেখ নাসের : নিচতলার সিড়িসংলগ্ন বাথরুমে। ৫. বেগম মুজিব : মূল বেডরুমের সামনে। ৬. সুলতানা কামাল : মূল বেডরুমে।৭. শেখ জামাল : মূল বেডরুমে। ৮, রােজি জামাল : মূল বেডরুমে।৯. শিশু রাসেল : মূল বেডরুমে, তার দুই ভাবীর মাঝখানে। ২. বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের সবাই তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারান। শেখ মুজিব : প্রথম তলার সিড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা তার তিন-চার ধাপ ওপরে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে শেখ মুজিবকে খুন করা হয়। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। শেখ মুজিব সব সময় চশমা পরতেন এবং তার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তার চশমা ও তামাকের পাইপটা সিড়িতে পড়া ছিল। পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস ভাঙা। রক্তে পাঞ্জাবির রঙ ছিল গাঢ় লাল। একটি বুলেট তার ডান হাতের তর্জনিতে গিয়ে লাগে এবং আঙুলটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শেখ কামাল : কামালের বুক ও তলপেটে তিন থেকে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। তার পরনে ছিল ট্রাউজার। নিচতলায় তাকে খুন করা হয়। টেলিফোন অপারেটর : তাকে নিচতলায় খুন করা হয়। শেখ নাসের : শেষ নাসেরকে খুন করা হয় বাথরুমের কাছে। তার হাত উড়ে গিয়েছিল। গুলিতে তার দেহের বেশ কিছু স্থান ছিল ক্ষত-বিক্ষত। তার গায়ে কোনাে পােশাক ছিল না এবং লাশ বিছানার চাদরে মােড়ানাে ছিল। বেগম মুজিব : বেগম মুজিবকে বুকে ও মুখমণ্ডলে গুলি করা হয়। তার পরনে ছিল। সুতি শাড়ি এবং কালাে রঙের ব্লাউজ। গলায় মাদুলি বাঁধা একটি সােনার নেকলেস। কনিষ্ঠা আঙুলে ছােট্ট একটি আঙটি। তখনাে তার পায়ে ছিল একটি বাথরুম স্লিপার। সুলতানা কামাল : সুলতানা কামালের বুকে ও তলপেটে গুলি লাগে। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ। শেখ জামাল : শেখ জামালের মাথা চিবুকের নিচ থেকে উড়ে গিয়েছিল। পরনে ট্রাউজার। ডান হাতের মধ্যমায় ছিল একটি মুক্তার আঙটি। সম্ভবত এটি ছিল তার বিয়ের আঙটি। রােজি জামাল তার মুখটি দেখাচ্ছিল বিবর্ণ, মলিন। মাথার একাংশ উড়ে গিয়েছিল। তার তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয়। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ।

শিশু রাসেল : সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে যায়। মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। লাশ একটি লুঙ্গিতে মােড়ানাে ছিল। ৩, মেঝেতে ছড়ানাে-ছিটানাে ছিল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জামাল ও কামালের বিয়ের অনেক উপহার সামগ্রী ও গিফট প্যাকেট। কিছু বাক্স ছিল ফাকা। কামালের কক্ষে রূপার তৈরি অনেক জিনিসপত্র দেখা যায়। সিড়িটি ছিল আল্পনা আঁকা। অভ্যর্থনা কক্ষটি ছিল নােংরা। আমি ওপরতলা থেকে শুনলাম নিচতলায় হুদা চিৎকার করছেন। তিনি এ বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করায় কয়েকজন সিপাহিকে গালাগাল দিচ্ছিলেন। ৪, সড়ক নম্বর ১৩/১, ধানমন্ডি, শেখ মণির বাড়ি মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তাদের এই বাড়িতে খুন করা হয়। তাদের বাড়ির দিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি আসতে দেখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব ছেড়ে সরে যায়। বাড়িটি ছিল আংশিক তছনছ করা। মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ। মাঝের টেবিলে একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু ভেজানাে চিড়া। ৫. ৩৭ মিন্টু রােড, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি মন্ত্রীর বাড়িটি ছিল ফাঁকা। ড্রয়িংরুমজুড়ে দেখা গেল জমাটবাধা রক্ত। বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশ আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ৬. সেরনিয়াবাত ও শেখ মণি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। লাশগুলাে ছিল বিকৃত। তাপ ও আর্দ্রতা লাশের ক্ষতি করে। লাশ থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। বনানী গােরস্থানে দাফনের জন্য আমরা লাশগুলাে সেনানিবাসে নিয়ে এলাম। শেখ মুজিবের লাশ ছাড়া ৩২ নম্বর সড়কের অন্য সবার লাশও আরেকটি ট্রাকে করে সেখানে আনা হয়। দাফন-কাফন সম্পর্কে প্রতিবেদন। ১. মৃতদেহ সংগ্রহ : ১৫ আগস্ট ঘটনায় নিহতদের লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দুটি ট্রাকে করে ১৮টি লাশ দাফনের জন্য আনা হয়। বনানী গােরস্থানে দাফনের জন্য গুলশান মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। এএসসি (আর্মি সার্ভিসেস কোর) সিপাহিদের একটি প্লাটুন গােরখােদকের কাজ করে। স্টেশন কমান্ডার আগেই আমাকে বলেছিলেন, ১৬ আগস্টের দিনের প্রথম আলাে ফোটার আগেই যাতে দাফনের সব কাজ শেষ হয়ে যায়। ২. দাফন : আগস্ট মাসের তাপ ও আর্দ্রতায় কিছু লাশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কোনাে ফ্যান ছিল না।

৩২ নম্বরের লাশগুলােতে বরফ দেওয়া ছিল। ফলে সেগুলাের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালাে। সিপাহিদের কয়েকজন, খুবই গলা চড়িয়ে কথা বলছিল। তারা শেখ মুজিব বিরােধী মনােভাব প্রকাশ করছিল। ফলে আমাকে গােটা পরিস্থিতিকেই সতর্কতার সঙ্গে। সামাল দিতে হয়। অবশ্য কোনাে লাশেরই যাতে অমর্যাদা না হয় আমি সেটি নিশ্চিত করেছিলাম। সিপাহিদের কয়েকজন কবর খুঁড়তে অনীহা প্রকাশ করে, লাশের খারাপ অবস্থার কারণে কয়েকজন এমনকি ছুঁতে পর্যন্ত রাজি ছিল না। আমি নিজে প্রথম মৃতদেহটি (বেগম মুজিবের) ওঠাই এবং চিরশয্যায় শায়িত করি। শেখনাসেরের দেহাবশেষ একইভাবে দাফন করি। এরপর আর আমার সমস্যা হয়নি। চার নম্বর ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলাে কবর ঠিকভাবে খোঁড়া হয়। কারণ আমরা সূর্যোদয়ের আগেই সব সেরে ফেলার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলাম। গােরস্থানমুখী সড়কগুলােয় আমরা আগেই সিপাহি মােতায়েন এবং গােরস্থান এলাকায় কার্য্য জারি করি। ভােরে ঘুমভাঙা কিছু লােক ও পথচারী কী ঘটছে বােঝার চেষ্টা করলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ৩. (গােরস্থানের) ৭ নম্বর সারির চারপাশে বেড়া দেওয়া হয় এবং অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য গােরস্থানটিতে দাফন কাজ বন্ধ ও দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ৪, মৃতদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র : কয়েকটি লাশের সঙ্গে কিছু গহনা পাওয়া যায়। একটি তালিকা তৈরি করে গহনাগুলাে স্টেশন কমান্ডারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৫. শেখ মুজিবের দাফন : ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ বেলা ১১টায় শেখ মুজিবের লাশ সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে করে ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। কাফন কেনা হয় সিএসডি (ক্যান্টিন স্টোরস ডিপার্টমেন্ট) থেকে। এটি কেনা হয়েছিল বাকিতে। অর্ডন্যান্সের জিডিও (গ্যারিসন ডিউটি অফিসার) মেজর মহিউদ্দিন আহমেদকে লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একটি বিএএফ (বাংলাদেশ এয়ারফোর্স) হেলিকপ্টারযােগে লাশ দাফনের জন্য টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃতদেহের গােসল ও জানাজা দেওয়া হয়। জানাজায় শেখ মুজিবের চাচাসহ ডজনখানেক লোক শরিক হন। একটি অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে কবরটি পাহারার জন্য রক্ষী মােতায়েন করা হয়। জিডিও টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশনসের ডিরেক্টরের কাছে তার রিপাের্ট পেশ করেন। ৬. নিহতদের বাড়িগুলাে সিল করা হয় : শেখ মুজিব, শেখ মণি ও সেরনিয়াবাতের বাড়ি তালাবদ্ধ করে সিলগালা করা হয় এবং চাবি স্টেশন সদর দপ্তরে রাখা হয়। ৭, অনেক বাধাবিপত্তি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সাধ্যমতাে সর্বোচ্চ যত্ন ও মর্যাদার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করি। বনানী গােরস্থান ; সারি নম্বর ৭-এ যাদের করব দেওয়া হয় : ১. বেগম মুজিব, ২, শেখ নাসের, ৩, শেখ কামাল, ৪. সুলতানা কামাল, ৫. শেখ জামাল, ৬, রােজি জামাল, ৭. শিশু রাসেল, ৮. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি বালক, ৯, ফাকা, ১০, অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১১. গৃহপরিচারিকা, বয়স ৪৫, ১২. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা, ১৩. শেখ মণি , ১৪, মিসেস মণি, ১৫, অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক, ১৬, অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১৭, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ১৮, অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক। নােট : ৯ নম্বর কবরের নাঈম খানের লাশ লে. আবদুস সবুর খানের (এনওকে) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।৭৮ প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০৩

 

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!