বাংলার জন্য কাঁদো
সুত্রঃ নিউ স্টেটসম্যান
তারিখঃ ২ এপ্রিল , ১৯৭১ , মারভেইন জোন্সঃ
নিউ স্টেটসম্যান , লন্ডন , বাঙ্গালির জন্য কাঁদো , সেন্সরশিপ এবং সরকারী মিথ্যাচারের স্বত্বেও রিপোর্টগুলি ঢাকা থেকে বেরিয়ে আসছে, এমনকি এমন সব খবর যা পাঠককে আতঙ্কিত করে তুলবে । ‘ নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ‘ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞের আদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কোনও বাধা নেই এবং আদেশগুলো কঠোর । তাদের যুক্তিতে , শত্রু গন্য করা হবে পুরো দেশের জনগন কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বশাসন দাবি করেছে ।
” এই মুহূর্তে, কাউকে না কাউকে এই ট্র্যাজেডির জন্য চিন্তা করতে হবে ,সৈন্যরা ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিচ্ছে , তাদের পেট্রোলের ক্যান হাতে সজ্জিত দেখা যাচ্ছে , যাদের সামান্য কিছু ছিলো তারা সব হারিয়ে ফেলেছে। হাজার হাজার লোক ট্যাঙ্কের এলোপাথারি গোলা থেকে বাচতে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু গ্রামঞ্চলে লোকজনেরা খুব কম সমই পেট ভরে আহার করতে পারে । । ক্ষুধা এবং রোগ হঠাৎ মৃত্যুর কারন হতে পারে । এবং, প্রায় ২00 বছর ধরে দরিদ্র থাকা মানুষদের ইতিহাসে এটি একমাত্র তিক্ত অভিজ্ঞতা । তারা নিপীড়ন ও শোষণ এর শিকার হয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের হাতে, উপমহাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে আসা ভুমিদস্যুদের কাছে এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের অহংকারী আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ।
নেহেরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ( যা কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি লিখেছিলেন ) বইয়ে প্রতিফলিত হয় , ভারতবর্ষের দারিদ্র্যকে মেনে চলার সময়কালের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে- বাংলায় গভীরতম দুর্দশা এবং পাঞ্জাবের একটি কার্যকর অর্থনীতির সবচেয়ে কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ যেখানে ব্রিটিশরা ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিখ শাসনকে পরাজিত করে রেখেছিলো ।অবশ্যই, অন্যান্য কারণও রয়েছে । তবুও, ইতিহাসের দুঃখ সময় সঙ্গে ভারী হবে এবং প্রতিটি প্রজন্ম শেষ পর্যন্ত তা বহন করে যাবে । এবং এটি পরিষ্কার করে বলা দরকার যে বাংলায় সাম্রাজ্যবাদের আদিম পর্যায়ের ডাকাতি এবং সেটার ধ্বংসাবশেষ সহ্য করেছিল ।
” দারিদ্র্যের চরম অবনমন বাংলার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি প্রধান বিষয় : মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা যা বাকি বিশ্ব আগেই জানতো , গ্রামাঞ্চলে হয় প্রান্তিক জীবিকা চাষ , ঢাকার বস্তিগুলোতে কলকাতা থেকে আসা অনেকে বসবাস করছিলো , ১৮৯১ ও ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয় । অন্য অভিজ্ঞতাটি ছিলো মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ।
” পেছনের ছবিটিতে বাংলাকে অবশ্যই একটি জাতীয়তাবাদী চরিত্র হিসাব গ্রহণ করতে হবে । এবং কাউকে সাবধানতার সঙ্গেই এই ধারণাকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে । অবশ্যই, সম্মান এবং আত্ম সচেতনতা দুটোই বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া । এটাকে তারপর এভাবে সাধারণীকরণ করা যায় যেঃ বাঙ্গালিরা স্বতঃস্ফূর্ত ,কথাপ্রিয় , আবেগী , নির্দিষ্ট বিষয়ে সংবেদনশীল , কারো সাথে হাত মেলায় বা আলিঙ্গন করে দ্রুত কিন্তু সেটি ছুরি দিয়েও । মহিলাদের মধ্যে রয়েছে , মূল্যবোধ ও কবিতা এবং সঙ্গীত চর্চা , আলংকারিক শিল্পে দক্ষতা , মুখরোচক খাবার তৈরি , এবং সৌন্দর্য । বাইরের লোকেরা তাদের মজার বা যোদ্ধা হিসেবে গন্য না করে চিহ্নিত করে বিশৃঙ্খল হিসেবে (ব্রিটিশরা তাদের ‘মার্শাল রেস’ থেকে বাদ দেয় এবং নির্মাণ এবং খনির কাজের জন্য একটি রেজিমেন্টে নিযুক্ত করে )ঃ এইসব বিরক্তি থেকেই তারা বীরত্তের কাজ প্রদর্শনপ্রবন হয়ে উঠে । তারা দক্ষ এবং উদ্ভাবক কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আবার এই সবের বিপরীত । বর্বর পাকিস্তান রাস্ট্র হচ্ছে কিছুটা ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাজ্য ও ইতালির জোরপূর্বক গঠন করা ইউনিয়নের মতো ।
“পাকিস্তান একটি মুসলিম রাস্ট্র , । ইতিহাস বলে , পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমানরা আংশিকভাবে একটি গোস্টহির উত্তরাধিকারী, ইরানী ও আফগান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের দ্বারা সেখানে বসতি স্থাপন হয়েছে । বাংলায় ইসলামের রূপান্তর ছিল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে । বাংলায় ইসলামের রূপান্তর ছিল দরিদ্রদের বর্ণপ্রথা বিলোপের একটি মাধ্যমের ফলে । মুসলিম বা অমুসলিম , বাঙালিরা এখনও আবেগপূর্ণভাবে বাংলাকে অনুভব করে, যাতে তারা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে যখন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জোন প্রদেশকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত করার চেষ্টা করে। এটি একটি বিরল নিদর্শন ছিল যখন একটি ভাইসরয় তার পোষা প্রকল্প বাতিল করেছিলো । কিন্তু এভাবেই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে বিভাজ্য করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং তা ছিলো একপ্রকার ঐতিহাসিক বিদ্রুপ । জিন্নাহ , যিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি ছিলেন একজন উচ্চশ্রেনির বোম্বের মুসলিম যিনি অভ্যাসের ছিলেন ইংরেজ দের মতো এবং খুব ধর্মীয় ছিলেন না যেমনটি ছিলেন কারসন যিনি ছিলেন উচ্চ শ্রেণীর ডাবলিন প্রটেস্টান্ট । নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন একচেটিয়াভাবে হয় ভূস্বামী এবং স্যান্ডহুরস্ট এর মতো চিন্তাধারার জেনারেলদের দ্বারা যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তাণী এবং যাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোন অভিজ্ঞতা নেই। পাকিস্তানের এধরনের চিন্তাধারার কারনে , নেহেরুর মত ভারতীয়রা ত তাদের অপছন্দ করতো ।
শুরু থেকে, গণতন্ত্র তৈরির কোন উদ্দেশ্য তাদের ছিল না , যেমনটি ছিলো একই ভাবে রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের । এটি সত্য যে বাঙ্গালিরা ছিলো অধিকাংশ মুসলিম কিন্তু তাদের ভারতের সাথে আবার একাত্ত হবার কোন সম্ভাবনা ছিলোনা ( যদিও ভারা প্রতিবেশী দেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দাবি করে এবং কাশ্মিরের বিশৃঙ্খলা বিষয়ে তাদের কোন ইন্টারেস্ট ছিলোনা ) । উল্লেখ্য যে তারা ছিলো পশ্চিমাদের কাছে অবিশ্বস্ত , বিশ্বস্ততার বৃত্তর বাইরে। সিভিল সার্ভিসের প্রধান প্রধান পদ এবং পুলিশের চাকরি পশ্চিমের লোকরা পেয়েছিলো । অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোথাও খুব চিত্তাকর্ষক ছিলোনা যার প্রতি ইতিমধ্যে ধনী হয়ে যাওয়া পশ্চিমা প্রদেশেগুলো পক্ষপাতী ছিলো । দুই অংশে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা ছিলো হতাশাজনক । যখন সরকার খোলাখুলিভাবে স্বৈরশাসক ছিল না, তখন সীমিত লোকজন , ১০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৮০০০০ জন নাগরিক রাষ্ট্রপতির পক্ষে ভোট দিতে পারত । ভয়ভীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সব নিয়ন্ত্রিত হতো । কিছু ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানে ঘটেছিলো যখন আইউব খান পুনরায় নিরবাচিত হন । যখনই আমরা নতুন মোটরসাইকেলে চড়ে কাউকে যেতে দেখছিলাম আমাদের আমেরিকান বন্ধু চিৎকার করে বলছিলো সেখানে একজন ভোটার আছে ।
যখন সত্যিকারের নির্বাচন হয় , শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ পূর্ব পাকিস্তানে জয়লাভ করে যা শুধুমাত্র ১৮১৮ এর সিনফিনির প্রলয়ংকারী ঝড়ের সাথেই তুলনা করা চলে । পার্থক্য হলো যে তিনি শুধুমাত্র সায়তবশাসন দাবি করেছিলেন । তিনি সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং এর কঠোর ভয়ঙ্কর পরিণতি উভয় সম্পর্কেই অবগত ছিলেন ।যদি একটি স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি হতাশ হতে হবে যদি তা অর্জন করা যায়, তা হবে তার দারিদ্র্য । জনপ্রিয়তা এবং ইয়াহিয়া খান এর হঠকারিতা তাকে সঙ্কটের মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষনা করতে বাধ্য করেছিলো । আমি আন্দাজ করতে পারি যেকেউ একটি আকর্ষণীয় বিতর্ক শুনতে হবে সন্দেহ নেই যদি সে ওয়াশিংটনে টেবিলের নীচে ইঁদুর হয়ে অবস্থান নেয় । গ্রীস থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত অনুরূপ শাসনব্যবস্থার সমতুল্য “স্বতন্ত্র ব্যক্তি” হিসাবে অলিগার্চারের পক্ষে প্রচারিত হবে । তর্ক হতে পারে যে বাংলাকে দাবিয়ে রাখা যাবেনা এবং মুজিব একজন জনপ্রিয় নেতা কিন্তু বিল্পবী নয় – কিন্তু তিনি একটি অনিয়ন্ত্রিত বাহিনীর বিপক্ষে সেরা বীমা ।
যদিও সেনাবাহিনী নিছক নৃশংসতায় ভর করে প্রথম রাউন্ড জিতেছে ৭৩ মিলিয়ন মানুষের উপর ঘৃণ্য অভিশংসন বজায় রেখে । পূর্ব সীমান্ত ব্যতীত বাংলায় কোন বড় বন বা পাহাড় নেই কিন্তু তা সত্তেও এটি অদ্ভুত ভাবে এটি সূক্ষ্ম গেরিলা যুদ্ধ করার মতো দেশ । গ্রেট গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ডেল্টা থেকে যে কোনো সময় পানি ছড়িয়ে পড়ে যখন মৌসুমি বায়ু বয় জুনের প্রথমদিকে। বিশাল জালাধারের উপরে প্রধান সড়কগুলো বাঁধের মতো জেগে থাকে । আমি কেবল শুষ্ক মৌসুমেই ছিলাম, কিন্তু আমি দেখেছি গ্রীষ্মের সূর্যের মধ্যে নৌকাগুলোর ডুবিয়ে রাখা নাক যা ইঙ্গিত দেয় বৃষ্টি শুরু হলে এগুলোই চলাচলের একমাত্র উপায় । যুদ্ধের উষ্কানি দেয়ার ফলে ইহায়হিয়া যে অপরাধ করেছে তা হয়তো এখন নয় ,তবে কিছু সময় পরে তার জন্য আতঙ্কের কারন হবে । আমরা কঙ্গো ও বিফ্রফার কাছ থেকে জানি যে ক্ষুদ্র জীবনযাত্রার সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বীজ বপনের সম্পর্ক এবং শস্য বপন , বিপনন ও ক্রয়ের কোন ঝামেলার ফলে কোন দেশ দুর্ভিক্ষের তলদেশে নিমজ্জিত হতে পারে । গত বছর টাইফুনে যেখানে রয়েল নেভী ছুটে গিয়েছিলো এবং সেখানে প্রায় ২০০০ জন মৃত্যুবরণ করেছিলো । একটি যুদ্ধ লক্ষ লোকের প্রান নিতে পারে । একটি ক্ষুধার্ত শিশু এর ফল কম ভোগ না কারণ সেও নিরাপদ নয় কারন যুদ্ধের শেষে তার দেশের সম্পদ্গুলোর সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা হয়না ।