You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধী-দালালদের বিচার- এক কোটি লােকের দেশত্যাগ - সংগ্রামের নোটবুক

যুদ্ধাপরাধী-দালালদের বিচার এক কোটি লােকের দেশত্যাগ, দু’লক্ষ মা-বােনের ইজ্জত, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। নিয়মিত ও অনিয়মিত লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে লড়াই করেছেন। স্বাধীনতা ছাড়া তাদের আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন মুক্তিবাহিনীকে নিরস্ত্র না করে সকলকে নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ঘােষণা দেন। ২ জানুয়ারি ১৯৭২ এজন্য তাকে চেয়ারম্যান করে ১১সদস্য বিশিষ্ট মিলিশিয়া বাের্ড গঠন। করা হয়। বাের্ডের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন ঃ ১. মাওলানা আবদুল হামিদ খান। ভাসানী (ন্যাশনাল আওয়ামী পটি-ভাসানী) ২. এ. এইচ,এম, কামারুজ্জামান ৩, মনােরঞ্জন ধর (কংগ্রেস) ৪, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিমােজাফফর) ৫. কমরেড মনিসিংহ (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি) ৬. তােফায়েল আহমদ (আওয়ালী লীগ) ৭. আব্দুর রাজ্জাক (আওয়ামী লীগ) ৮. রফিক। উদ্দিন ভূঁইয়া (আওয়ামী লীগ) ৯. গাজী গােলাম মােস্তফা (আওয়ামী লীগ) ও ১০. ক্যাপ্টেন সুজাত আলী (আওয়ামী লীগ)। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়নি। উপরন্তু ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সকল মুক্তিযােদ্ধাকে অস্ত্র জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়। সে মােতাবেক ২৪, ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি যথাক্রমে ‘বাঘা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী, কমরেড মােহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী ও শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) এবং অন্যান্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। বলা বাহুল্য, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এ সমর্পণের বাইরে রয়ে যায়। নিরস্ত্র ও বিচ্ছিন্ন করে মুক্তিযােদ্ধাদের যার যার বাড়ি/কাজে পাঠিয়ে দেয়ায় একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে সংশপ্তক মুক্তিযােদ্ধারা দেশ গড়ার যুদ্ধে অংশ না নিতে পেরে হতাশ হন। এর ফল হয় আত্মঘাতী। যা হােক, নানা টানাপােড়েন ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুজিব সরকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন :ত্রিশ লক্ষ শহীদের স্মরণে শােক দিবস পালন (১৬ জানুয়ারি ১৯৭২)।শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জাতীয় বীর ঘােষণা। ৫৮৯ জন বীর মুক্তিযােদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিতকরণ।নির্যাতিতা মা-বােনদের বীরাঙ্গনা পদবিতে ভূষিতকরণ ও তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ।

মুক্তিযােদ্ধা ফাউন্ডেশন গঠন। মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন। (ট্রাস্টের জন্য ৪ কোটি টাকার মূলধন নির্ধারণ। গুলিস্তান, নাজ, মুন সিনেমা হল, ফান্টা, কোকাকোলা, সিরকো সােপ ফ্যাক্টরি প্রভৃতি কল্যাণ ট্রাষ্টকে প্রদান)। চাকুরিতে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রাধিকার ও দু’বছরের জ্যেষ্ঠতা প্রদান। জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, শহীদ সেনানী স্মৃতিফলকের (ঢাকাসেনানিবাস) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। • রাজাকার-আলবদরদের হাতে নিহতদের পরিবারকে শােকবাণী ও নগদঅর্থসাহায্য প্রদান। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের পােষ্যদের মাসিক খােরাকি-ভাতা প্রদান। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার জন্য ১৩ সদস্যের কমিটি গঠন।প্রতিটি দেশেই জাতীয় চেতনাবিরােধী কিছু লােক থাকে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এরা ঘরশত্রু বিভীষণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমাদের দেশও এ-থেকে ব্যতিক্রম নয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ার পর প্রথম সুযােগেই কিছু লােক হানাদারদের সহযােগিতা করার জন্য এগিয়ে যায়। ওরা প্রথমে শান্তি কমিটি’ পরে আল-বদর, রেজাকার, আল-শামস প্রভৃতি ঘাতকবাহিনী গড়ে তােলে। এই ‘সহযােগীরা’ (কোলাবরেটর) সাধারণভাবে ‘দালালরূপে পরিচিতি পায়। মুক্তির উষালগ্নে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ বুদ্ধিজীবীদের নিধন ছিল ওদের বাংলাকে মেধাহীন করার কৌশল। স্বাধীনতাকামী প্রায় প্রতিটি পরিবার কোনাে না কোনােভাবে এদের নিগ্রহের শিকার হয়। যুদ্ধোত্তরকালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংগঠিত নজিরবিহীন গণহত্যার প্রতিবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শােকবার্তা পাঠায়। আফ্রো-এশীয় গণসংস্থার কায়রাে সম্মেলনে নিন্দা-প্রস্তাব গ্রহণ করা। হয়। দেশী-বিদেশী সর্বমহল থেকে মানবতার দুশমনদের এই দুষ্কর্মের তদন্ত ও বিচারের দাবি উঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নাৎসীদের বিচারের অভিজ্ঞতায় কেউ কেউ। বার্ট্রান্ড রাসেল, জ্যা পল সার্তে, আন্দ্রে মালরাে প্রমুখ বিশ্ববরণ্যে ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন। স্বয়ং শেখ মুজিব বলেন :পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। গঠনের আবেদন জানাচ্ছি। যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে, তাদের অবশ্যই বিচার হবে।

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৬-০৭আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃবৃন্দ এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা জেনেভা কনভেনশনের সুবিধা পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে বলেও মত প্রকাশ করেন। গণহত্যা তদন্ত কমিশন ১ জানুয়ারি ১৯৭২ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রি পরিষদের এক বৈঠকে হাইকোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোনাে বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোনাে মনােনীত ব্যক্তির নেতৃত্বে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিশন পাকবাহিনী ও তাদের দালালদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মৌখিক ও লিখিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ব্যাপক রিপাের্ট পেশ করবেন বলে ঘােষণা করা হয়। | পাকিস্তানি কারাগারের মৃত্যু প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে শেখ মুজিব দেশের দায়িত্বভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২ গণহত্যা ও সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি, ১ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ তদন্তের জন্যে একটি বিশেষ সংস্থা ও বিচারকার্যের জন্য ৬ সদস্যের একটি কাউন্সিল নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু এসব কমিটি, সংস্থা ও কাউন্সিল কোনাে প্রতিবেদন পেশ করেছিল কিনা এবং পেশ করে থাকলে তা প্রকাশ করা হয়েছিল কিনা কিংবা তদানুযায়ী কোনাে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা, তা জানা যায় নি।বুদ্ধিজীবী-নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটি তবে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ বুদ্ধিজীবীগণ উদ্যোগ নিয়ে একটি বুদ্ধিজীবী নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিলেন। জহির রায়হানের আহ্বায়কত্বে কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ হলেন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েতুল্লাহ খান, সৈয়দ হাসান ইমাম ও ড. সিরাজুল ইসলাম। এই কমিটি, বিশেষত এর আহ্বায়ক জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে অনেকদূর এগিয়ে যান। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি তিনি নিজেই রহস্যজনকভাবে মিরপুর থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলে এই উদ্যোগে ভাটা পড়ে এবং ইতােমধ্যে উদ্ধারকৃত তথ্য-প্রমাণাদি কলকাতার এক সাংবাদিক এসে নিয়ে যান বলে জানা যায়। মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১৩৪ আব্দুল হকের স্মৃতি-সঞ্চয়’র বর্ণনা মতে, ‘জহির রায়হানকে গত ২৯ জানুয়ারি (১৯৭১) থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা।

মিরপুরের কোথাও তার ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং তিনি গেলে তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এই মর্মে বিহারিরা তাকে সংবাদ দিয়েছিল। তিনি কিছু সশস্ত্র বাঙালি সৈন্য ও পুলিশ নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন, সেই সুযােগে সদলবলে তার উপর আক্রমন চালানাে হয়। তিনি এবং বেশ কিছু বাঙালি নিহত হন। আজকের (৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১) খবরের কাগজে সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।’ দ্রষ্টব্য : প্রথম আলাে, ১১ জুলাই ২০০৩ ১৯৭২ এর জানুয়ারিতে ভারতীয় সাপ্তাহিক ‘দি নিউ এজ পত্রিকা জহির রায়হানের বরাত দিয়ে জানায়।… আমাদের ধারণা ছিল যে, দখলদার পাকিস্তানি শাসকদের নিশ্চিত পরাজয় উপলব্ধি করে সশস্ত্র গোঁড়া ধর্মধ্বজী পশুরা ক্রোধান্ধ হয়ে কাপুরুষােচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি ঘটনা শুধুমাত্র তা ছিল না। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছেন তাঁরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিস্থানীয় এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধী মনােভাবের জন্য সুপারিচিত ছিলেন। | এরা নির্ভুলভার্দে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে। ‘এ’ থেকে একটা সিদ্ধান্তেই পৌছানাে যায় যে, আলবদরের এই স্বেচ্ছাসেবকরা অপরের ইচ্ছা কার্যকর করার বাহন ছিল মাত্র। কিন্তু কারা এই খুনীদের পেছনে ছিল? সংগৃহীত দলিল ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি থেকে জানা যায়, শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তানদের হত্যার। কাজে নিয়ােজিত অন্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত গুণ্ডাদেরকে আলবদর বাহিনীতে যারা সংগঠিত করে, তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে জড়িত।…উল্লেখ্য, রাও ফরমান আলীর ডায়রিতে Haight ও Daiespic নামে যে দু’জন সিআইএ এজেন্টের নাম পাওয়া গিয়েছিল, তারা ইন্দোনেশিয়াতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল এবং ইন্দোনেশীয় সরকার সেজন্য তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারও করেছিল।আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া যুদ্ধবন্দি এবং তাদের দেশীয় দোসরদের বিচারের সময় জেনেভা কনভেনশনের সুবিধাদানে সরকারকে প্রভাবান্বিত করার জন্যে আন্তর্জাতিক রেডক্রস, বিশ্বশান্তি পরিষদ, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসেন। দেশজুড়ে অসংখ্য বধ্যভূমিতে অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্নসহ। অজস্র বিকৃত মৃতদেহ এবং হাড়-কঙ্কালের স্থূপ দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে যান। তারা। নিজেরাই এদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিশ্বশান্তি পরিষদ দলনেত্রী মাদাম।

ইসাবেলা রুম বলেন :  শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমিতে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের যে লােমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষর দেখেছি-তাতে আমি শােকাভিভূত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গেছি। এই হত্যাকাণ্ড নাৎসী গ্যাসচেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়ে অনেক বেশি বীভৎস। ফিরে গিয়ে তিনি পরিষদ-সভাপতির কাছে এই গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানাবেন বলে জানান। দলের অপর এক সদস্য বলেন ,আমি যা দেখে এসেছি তা বিশ্বাস করতে চাই না। আমাকে আজীবন এই স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।৪. মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৯-১০০ দৈনিক আজাদ, ২২ জানুয়ারি ১৯৭২। উদ্ধৃত, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বুদ্ধিজীবী। হত্যাকান্ডের নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৪ দৈনিক আজাদ, ২২ জানুয়ারি ১৯৭২মার্কিন সিনেটের ডেমােক্রেট দলীয় সদস্য এ্যাডলাই স্টিভেনসন কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলাে দেখে এসে বলেন :বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নৃশংসতা ছিল ভয়াবহ এবং মানবজাতির ইতিহাসে তার কোনাে নজির নেই। এই বর্বরতা মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ মার্কিন সিনেটের অপর সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন : মানুষের মস্তিষ্কে এ ধরনের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে এ-কথা ভাবতেও কষ্ট কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসমাবেশে (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) শেখ মুজিব বলেন : যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, এদের ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিব বলেন : লােমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী আমি শুনেছি, তবু বাংলার মানুষ এত নীচে নামবে (প্রতিশােধপরায়ণ হবে না), বরং যা মানবিক তা-ই করবে। তবে অবশ্যই আইনানুযায়ী অপরাধীদের বিচার হবে।” দালালের সংজ্ঞা, দালাল আইন ও ট্রাইব্যুনাল গঠন। ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ দখলদার পাক-বাহিনীর সহযােগীদের দ্রুত সুবিচার করার জন্য বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’ জারি করা হয়। অধ্যাদেশে একজন সেশন জজ বা অতিরিক্ত সেশন জজকে নিয়ে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়। এই ট্রাইব্যুনালই কেবল দালালদের বিচার করতে পারবে বলে অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়।

দেশের প্রচলিত আইন এবং বিচারপদ্ধতি অনুসারে দালাল আইনে আটককৃত ব্যক্তিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগলাভ করে। প্রচলিত পেনাল কোড এবং মানবতা, মানুষের জান-মাল ও সম্মানহানির অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী দালালদের শাস্তির বিধান রাখা হয়। শাস্তির বিধানের মধ্যে ছিল ন্যূনতম তিন বছর থেকে বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ড। এই অধ্যাদেশে দালালদের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয় : ক, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে তাদের অবৈধ দখল টিকিয়েরাখার জন্য যারা সাহায্য, সহযােগিতা বা সমর্থন প্রদান করেছে। খ. প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে যেসব ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা দল দখলদার পাকবাহিনীকে বস্তুগত সহযােগিতা প্রদান করেছে অথবা কোন বক্তব্য, চুক্তি বা কার্যাবলির মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে সমর্থন যুগিয়েছে।৭. দৈনিক আজাদ, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক আজাদ, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক বাংলা, ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২গ. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করা বা যুদ্ধের প্রচেষ্টা গ্রহণকরেছে। ঘ, মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিকামী জনগণের কর্মকাণ্ডেরবিরুদ্ধে যে সব ব্যক্তি কার্যকর প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে অথবা ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। পাকবাহিনীর গণহত্যা, অবৈধ দখলের অনুকূলে কোনাে বিবৃতি প্রদান বা প্রচারণায় অংশ নিয়েছে এবং হানাদার বাহিনীর কোনাে প্রতিনিধিদল বাকমিটির সদস্য হয়েছে। চ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আয়ােজিত থাকেথিত উপনির্বাচনে যারা | অংশগ্রহণ করেছে।উক্ত দালাল আদেশের এখতিয়ার অনুসারে ২৯ মার্চ ১৯৭২ নিম্নোল্লিখিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালসমূহ” গঠন করা হয় : ঢাকা-১১ টি | ফরিদপুর -৩টিকুমিল্লা-২টি দিনাজপুর -২টিপাবনা – ৪টি বাকেরগঞ্জ -৬টি ময়মনসিংহ-৭টি চট্টগ্রাম (পার্বত্যসহ) -৬টি নােয়াখালী – ৩টি যশাের – ৪টিরংপুর -৪টি পটুয়াখালী -২টি টাঙ্গাইল -২টিসিলেট – ৫টি | রাজশাহী -২টি কুষ্টিয়া -২টিবগুড়া -২টিস্ক্রিনিং ও তথ্যানুসন্ধান কমিটি ১৭ জুন ১৯৭২ সরকার স্ক্রিনিং কমিটি গঠন করে একটি আদেশ জারি করে। হাইকোর্টের একজন জজ এর সভাপতি ও অন্য একজন জজ সদস্য হবেন। আদেশটির দুটি ভাগ; একভাগে রয়েছে দুর্নীতিবাজ ও ‘পাকিস্তানি’ মনােভাবাপন্ন অভিযুক্ত সরকারি কর্মরত চাকুরেদের বিচার করে ডিসমিস) করার বিধান, অন্যভাগে রয়েছে পাকিস্তানি মার্শাল ল’ আদেশে চাকুরিচ্যুত প্রার্থীদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করার ব্যবস্থা।”তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল ২০ এপ্রিল ১৯৭৩ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, চালু দালালি মামলা বাছাই ও তদন্ত এবং বাদ দেয়া মামলা পুনরায় পর্যালােচনা করার জন্য ৬০টি জেলা (মহকুমাকে জেলা গণ্য করে) স্ক্রিনিং বাের্ড গঠিত হবে।”

ডেপুটি কমিশনার এর আহ্বায়ক এবং পুলিশ সুপার,মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, পৃষ্ঠা ৭৪ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি দিনলিপি : ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ২৮ জুন ২০০২ কেউ কেউ দু’টি স্ক্রিনিং বাের্ড গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন। যা হােক, ৩ জুন ১৯৭৬ দুটি বাের্ড। ভাগকে একীভূত করা হয়। দৈনিক বাংলা, ২১ এপ্রিল ১৯৭৩ উদ্ধৃত : হালিম দাদ খান, মুক্তিযুদ্ধ ও গােলাম আযম, প্রকাশক হালিমুল্লাহ খদ্দর, ঢাকা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২ পৃষ্ঠা ৫৬সরকারি উকিল ও স্থানীয় সাংসদ সদস্য হবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত ও রিপাের্ট পেশের জন্য মহকুমা হাকিমকে আহ্বায়ক ও স্থানীয় সাংসদ, ওসি, এবং একজন গণপ্রতিনিধি নিয়ে প্রতিটি থানায় তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে। এই স্ক্রিনিং বাের্ড ও তথ্যানুসন্ধান কমিটি শেষপর্যন্ত গঠিত হয়েছিল কি না বা গঠিত হয়ে থাকলে কতদূর কার্য সম্পাদন করেছিল তার কোনাে বিবরণ জানা যায় নি।গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু ঢাকা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ শত্রুমুক্ত হলেও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়া শুরু হয় এবং সেই সাথে মুক্তাঞ্চলে দালালদের আটক করা শুরু হয়। এপ্রিলের (১৯৭৩) মাঝামাঝি সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে জানা যায়, সারাদেশে দালালির ১২ হাজার মামলার মধ্যে ৬ হাজার মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। এই ৬ হাজার মামলায় অভিযুক্ত ২৯ হাজার দালালের মধ্যে ৩১ মার্চ ১৯৭৩ পর্যন্ত আটক করা হয়েছে ১০,৪৪০ জন। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত চলছে এমন। আটক ব্যক্তির সংখ্যা ৫,২৬৯ জন। এ পর্যন্ত বিশেষ আদালতে ৫৯২ টি মামলার বিচার হয়েছে যার মধ্যে ৩১৩টিতে সাজা হয়েছে এবং বাকি ২৭৯টিতে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়েছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক (৪৭.১৩% ভাগ) মামলায় অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছিল। এই বিপুলসংখ্যক অভিযুক্তের ছাড়া পাওয়া এবং বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তক্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল বলেন : মামলার বিচার-অনুষ্ঠানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষি প্রমাণ যােগাড় করতেও সময় লাগে। সেজন্য সরকার সচেষ্ট। কাউকেই অকারণে সাজা দেয়া হবে না।”প্রথমদিকে গ্রেফতারকৃত কতিপয় দালাল১. মৌলভী ফরিদ আহমেদ, নেজামে ইসলাম। ২. ডা. এ এম মালিক, তাঁবেদার গভর্নর। ৩. ড. হাসান জামান, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

৪. খান এ সবুর, মুসলিমলীগ ও কেন্দ্রিয় মন্ত্রী। ৫. রাশিদুল হাসান, ডেপুটি কমিশনার, খুলনা । ৬. মাওলানা মাে. মাসুম, পিডিবি ও সদস্য, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি, ঢাকা। ৭, ডা. আব্দুর রহমান, জামায়াতে ইসলামী, বাগাবাড়ী, ফরিদপুর। ৮, মােহাম্মদ আলী, ইউপি সদস্য, জয়দেবপুর (গাজীপুর), ঢাকা।দৈনিক বাংলা ২১ এপ্রিল ১৯৭৩ দৈনিক বাংলা, ২১ এপ্রিল ১৯৭৩। উল্লেখ্য, কাউকে অকারণে সাজা না দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯। নভেম্বর ১৯৭২ যুদ্ধবন্দিদের পরিবারের বেসামরিক সদস্যদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দৈনিক বাংলা ৫.৭. ও ১৩-১৫ জানুয়ারি ১৯৮২ এবং মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৫৩,৫৬

  1. জ্ঞানপাপী ড. সাজ্জাদ হােসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ড. সাজ্জাদ হােসেন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। পরে গভর্নর টিক্কা খান তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে। | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকামী ৩০ জন শিক্ষক ও ২ জন অফিসারের একটি তালিকা তৈরি করে সামরিক হেডকোয়ার্টারে দাখিল করেন। তালিকায় অধ্যাপকদের ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে ৪-ধরনের শাস্তি যেমন :১. হত্যা ২. কারাদণ্ড ৩, চাকরি থেকে বহিষ্কার ও ৪, ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহারের সুপারিশ করা হয়। এসব অধ্যাপকদের অনেকেই আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত বা নির্যাতিত হন। স্বাধীনতার পর সাজ্জাদ হােসেন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এই তালিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তথ্যানুসন্ধান কমিটির হস্তগত হয়।বর্বর পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের (২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে) ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সামরিক কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক অবস্থা প্রদর্শনের উদ্যোগে ড. সাজ্জাদ হােসেন নিজেকে নিবেদন করেন। তার সময়ই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষকরা স্বাধীনতাবিরােধী ভূমিকায় বিশেষ তৎপর হয়। ৫ নভেম্বর ১৯৭২ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু বিচারকার্য। সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে তিনি সৌদি আরবে চলে যান এবং সেখানে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিযুক্ত হন।দালাল মন্ত্রী জসিমউদ্দিনের যাবজ্জীবন ২৫ নভেম্বর ১৯৭২ ঢাকার ২নং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দ সিরাজউদ্দিন আহমেদ মালিক-মন্ত্রিসভার আইন ও পার্লামেন্ট দফতরের মন্ত্রী জসিমউদ্দিন আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অভিযুক্ত আসামি ইচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্রিসভায় যােগদান করে দখলদার বাহিনীকে সাহায্য করেন ও নানা স্থানে সভা-সমিতি করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ঘৃণা সঞ্চার করেন। তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠক করে বাংলাদেশ-সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং রাজাকারদের সংখ্যা ১০ লক্ষে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একজন প্রবীন আইনজীবী ও বহুকাল সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
  2. অতীত রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য রেখে তার জীবনরক্ষা প্রয়ােজন বিধায় তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।২ জুন ১৯৭১ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আচরণের প্রশংসা করে একটি যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে।মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬ ওই দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ নভেম্বর ১৯৭২গ্রেফতারের পর খালেক মজুমদারের স্বাক্ষরকৃত ও পেশকৃত এক বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আরও ৯ জনের নাম পাওয়া গিয়েছিল। এদের অনেকেই সুপরিচিত হওয়ায় সংবাদপত্রগুলাে নাম প্রকাশে বিরত থাকে।”ড. আজাদ হন্তার মৃত্যুদণ্ড ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল সাড়ে ৮ টায় ঢাকা উচ্চতর বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যাপক ডক্টর এম.এ.কে. আজাদকে দুষ্কৃতকারীরা অপহরণ করে। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ রায়ের বাজার ডােবা থেকে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার বুকে, মাথায় ও শরীরের অন্যান্য স্থানে গুলি ও বেয়নটের খোচার চিহ্ন ছিল।৫ অক্টোবর ১৯৭২ ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য সৈয়দ সিরাজুদ্দিন আহমদ অঙ্কশাস্ত্রের পণ্ডিত ড. আজাদকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মকবুল, আইয়ুব আলী ও জুবায়েরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। আসামী জুবায়ের ওরফে আহমদউল্লাহ্ আজিমপুর শাহ সাহেব বাড়ির জনৈক শাহ ওয়ালিউল্লাহর পুত্র এবং অপর দুজন ময়মনসিংহের লােক বলে জানা যায়।তাঁবেদার গভর্নর মালিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ১৯ নভেম্বর ১৯৭২ ঢাকার ১নং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারক আবদুল হান্নান চৌধুরী পূর্ব-পাকিস্তানের শেষ গভর্নর ডা. আদম মােত্তালিব মালিককে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহদাহ, লুটতরাজ চালানাে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বানচাল করে দেয়ার ব্যাপারে দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সরাসরি সহযােগিতা করার দায়ে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১ ধারা মতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তার ৭০ বছরের বার্ধক্য এবং অতীত রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপ বিবেচনা করে এই দণ্ডাদেশ দেয়া হয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। মামলায় সরকারপক্ষে ছিলেন মেসার্স সিরাজুল হক, খখান্দকার মাহবুব হােসেন ও আব্দুর রাজ্জাক এবং বিবাদী পক্ষে ছিলেন মের্সাস আতাউর রহমান খান, খান বাহাদুর নাজিরউদ্দিন আহমদ, আমজাদ আলী, মনসুরুর রহমান, হাবিবুর রহমান ও কাজী শাহাদাত হােসেন।মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৭। ৩০ আগস্ট ১৯৭২ কুখ্যাত মােনায়েম খানের দু’পুত্র শাফিউজ্জামান ও খালেকুজ্জামানের জামিনের আবেদন নামজুর করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী শান্তিকমিটির সদস্য ও কর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। ২ অক্টোবর ১৯৭২ পর্যন্ত ২৭৫ জন পুলিশসহ ৪১ হাজার। দালাল গ্রেফতারের সংবাদ পাওয়া যায়।
  3. দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ অক্টোবর ১৯৭২। ইত্তেফাকের সকল উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে সাধু ভাষাকে চলতি রূপে। রূপান্তর করা হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ নভেম্বর ১৯৭২জ্ঞানপাপী ড. সাজ্জাদ হােসেনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ড. সাজ্জাদ হােসেন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। পরে গভর্নর টিক্কা খান তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে। | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকামী ৩০ জন শিক্ষক ও ২ জন অফিসারের একটি তালিকা তৈরি করে সামরিক হেডকোয়ার্টারে দাখিল করেন। তালিকায় অধ্যাপকদের ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে ৪-ধরনের শাস্তি যেমন :১. হত্যা ২. কারাদণ্ড ৩, চাকরি থেকে বহিষ্কার ও ৪, ধরে নিয়ে গিয়ে প্রহারের সুপারিশ করা হয়। এসব অধ্যাপকদের অনেকেই আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত বা নির্যাতিত হন। স্বাধীনতার পর সাজ্জাদ হােসেন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এই তালিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তথ্যানুসন্ধান কমিটির হস্তগত হয়।বর্বর পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের (২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে) ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সামরিক কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক অবস্থা প্রদর্শনের উদ্যোগে ড. সাজ্জাদ হােসেন নিজেকে নিবেদন করেন। তার সময়ই ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষকরা স্বাধীনতাবিরােধী ভূমিকায় বিশেষ তৎপর হয়। ৫ নভেম্বর ১৯৭২ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু বিচারকার্য। সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে তিনি সৌদি আরবে চলে যান এবং সেখানে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিযুক্ত হন।দালাল মন্ত্রী জসিমউদ্দিনের যাবজ্জীবন ২৫ নভেম্বর ১৯৭২ ঢাকার ২নং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দ সিরাজউদ্দিন আহমেদ মালিক-মন্ত্রিসভার আইন ও পার্লামেন্ট দফতরের মন্ত্রী জসিমউদ্দিন আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অভিযুক্ত আসামি ইচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্রিসভায় যােগদান করে দখলদার বাহিনীকে সাহায্য করেন ও নানা স্থানে সভা-সমিতি করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ঘৃণা সঞ্চার করেন। তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠক করে বাংলাদেশ-সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং রাজাকারদের সংখ্যা ১০ লক্ষে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেন।
  4. তিনি একজন প্রবীন আইনজীবী ও বহুকাল সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। অতীত রাজনৈতিক কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য রেখে তার জীবনরক্ষা প্রয়ােজন বিধায় তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।২ জুন ১৯৭১ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আচরণের প্রশংসা করে একটি যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে।মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬ ওই দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ নভেম্বর ১৯৭২‘রেজাকার বাহিনীর জনক মাওলানা ইউসুফের যাবজ্জীবন ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ ঢাকার ৩ নম্বর স্পেশাল জজ মি. এস.বি. বড়ুয়া বেআইনি ঘােষিত জাময়াতে ইসলামী নেতা (প্রাদেশিক সহকারী আমীর) ডা, মালিক মন্ত্রিপরিষদের রাজস্বমন্ত্রী মাওলানা এ কে এম ইউসুফকে দখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগে বলা হয়, আসামী ১৯৭১ সালে তথাকথিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দখলদার বাহিনীর দালালি করেন। ইয়াহিয়ার পুতুল সরকারকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি নানা স্থানে সভা করে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের খতম করে পাকবাহিনী, রেজাকার ও বদর বাহিনীকে সহযােগিতা করার জন্য জনগণকে আহবান জানান। উল্লেখ্য, তিনিই খুলনায় খান জাহান আলী রােডের আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে ১৯৭১ -এর মে মাসে প্রথম রেজাকার বাহিনী গড়ে তুলেন।দালাল মন্ত্রী সােলায়মান, ইসহাক, ওবায়দুল্লাহ গং-এর যাবজ্জীবন ৬ জানুয়ারি ১৯৭৩ সাংবাদিক নাজমুল হককে অপহরণের অভিযােগে জনৈক খলিলকে । যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি মালিক মন্ত্রিসভার সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী, কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ এস এম সােলায়মান এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী নেজামে ইসলাম নেতা মাওলানা মােহাম্মদ ইসহাককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২৪ এপ্রিল মালিক মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্য ও তথ্যমন্ত্রী (আওয়ামী লীগ। ছুট) ওবায়দুল্লাহ মজুমদারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ২৯ জুন সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হােসেনের অপহরণ মামলায় জনৈক রাজাকার খলিলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৩০ জুন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী হন্তা দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৪ জুলাই সাংবাদিক নিজামুদ্দিনকে অপহরণকারী দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৩১ আগস্ট ১৯৭৩ জনৈক রাজাকার মুন্না বিশেষ ট্রাইবুনালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।৪৩ দালালের নাগরিকত্ব বাতিল। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি করা হয় এবং পরে এর বিধান। বলে বেশকিছু দালালের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা। হয়, সরকার ৩৯ ব্যক্তিকে বাংলাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘােষণা করেছেন। এরা।দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ অক্টোবর ও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ মূল সংবিধানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত করা হয় (১২ অনুচ্ছেদ) এবং দালালদের। ভােটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার বাতিল করা হয় (৬৬ অনুচ্ছেদ)। পরে ১৫ জুলাই ১৯৭৩ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের প্রথম সংশােধনীতে যাদের ক্ষেত্রে ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফা প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে ৩১,৩৫ ও ৪৪ অনুচ্ছেদ অপ্রযােজ্য করা হয় এবং তারা আটকাদেশ চ্যালেঞ্জে করে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবেনা বলা হয়।
  5. এদের বয়স হয়েছে। রাজনৈতিক ঝামেলায় নতুনভাবে জড়ানাের ইচ্ছে এদের অনেকেরই নেই। জনসাধারণের ঘৃণা আর ক্রোধ এদের জীবন অভিশপ্ত করে তুলেছে। কী হবে এদের আরাে জেল খাটিয়ে?”মুজিব তখনই প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ফোনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন।” কিন্তু সবুর খানেরা মৃত মুজিবের লাশের ওপর দিয়ে আবার রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। জীবনে স্বাভাবিক পথে এরা কোনােদিন রাজনীতি করেননি। এদের যাতায়াত সকল সময় চক্রান্তের রাজনীতির পেছনের অন্ধকার গলিপথ দিয়ে।মাহমুদ আলী স্বাধীনতার পর ঘােষিত ফেরারদের অন্যতম মাহমুদ আলী। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের কিছুকাল আগে তিনি পাকিস্তানে আশ্রয় নেন এবং দালালির পুরস্কারস্বরূপ একটি গুরুত্বহীন মন্ত্রীর পদে আসীন হন। অন্যান্য ফেরারদের মতাে তার সম্পত্তি ক্রোক করা হয় এবং তাকে আত্মসর্পণের আহ্বান জানানাে হয়। | রাজনীতিতে তিনি চিরকালই মুজিব-বিরােধী এবং ক্ষমতালােভী। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধার জন্য গণতন্ত্রী দল, ন্যাপ, পিডিপি প্রভৃতি বহু দলে তিনি যােগ দিয়েছেন এবং ছেড়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জুড়ে যখন বর্বর গণহত্যা চলছে, তখন মাহমুদ আলী ছিলেন পাকিস্তানিদের সবচাইতে বড় দোসর। তার এক মেয়ে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে যে অশালীন ভাষায় স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুজিববিরােধী প্রচারণা চালিয়েছে, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যা সম্পর্কে জাতিসংঘে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিরা অভিযােগ উত্থাপনের চেষ্টা কালে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতিনিধি মাহমুদ আলী (প্রতিনিধি দলের তিনি ছিলেন নেতা এবং শাহ আজিজুর রহমান উপনেতা, দুজনই বাঙালি!) প্রসঙ্গটি যাতে না উঠে তজ্জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান।তিনি দেশ ছেড়ে পালালেও তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা তখনও ঢাকায়। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, ক্রোধান্ধ জনতার হাতে তারা লাঞ্ছিত হবেন অথবা তার কন্যারত্মটিকে কোলাবরেটর হিসেবে জেলে পাঠানাে হবে। কিন্তু মুজিব দেশে ফিরে কিছুই হতে দেন। নি । উপরন্ত পুলিশকে মাহমুদ আলীর পরিবারের কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য আদেশ দেন এবং গােপনে দেশত্যাগের জন্য বিশ হাজার টাকা ও পাসপাের্ট দেন । তারপর সকলের অগােচরে পুলিশবাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে গিয়ে মাহমুদ আলীর সাথে মিলিত হন। বিষয়টি জানাজানি হলে।আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্ত পলাশ, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গােষ্ঠী, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৮২৮৩।ড, মােহাম্মদ হাননান বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পৃষ্ঠা ৯১-এ উল্লেখ করেছেন, সবুর খান জেল থেকে মুজিবকে লিখিত এক চিঠিতে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ভবিষ্যতে আর রাজনীতি করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
  6. মুজিব তাদের শান্তকণ্ঠে বললেন :মাহমুদ আলীকে হাতে পেলে হয়তাে বিচার করতাম। কিন্তু তার ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর কোনাে ক্ষতি হােক তা আমি চাই না।স্ত্রী ছেলেমেয়েকে আটক করে তিনি মাহমুদ আলীকে শিক্ষা দিতে চাননি। অথচ সেই মাহমুদ আলী মুজিব-হত্যার পরই লন্ডন গিয়ে সেখান থেকে মােশতাকের সাথে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করে, পাকিস্তানের পুনঃএকত্রীকরণ’, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানকে এক নামে এক পতাকাতলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করণ’, কনফেডারেশন গঠন’ প্রভৃতি কাপালিক চেষ্টা চালান।”শাহ আজিজ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদারদের বিরুদ্ধে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক উত্থাপনেয় গণহত্যা সম্পর্কিত অভিযােগের বিরােধিতা করার জন্য পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের উপনেতা হিসেবে শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে গিয়েছিলেন (দলনেতা ছিলেন মাহমুদ আলী)। স্বাধীনতার পর দালালির অভিযােগে তিনি গ্রেফতার হন। | বেগম আজিজুর রহমান স্বামীর মুক্তির জন্য মুজিবকে অনুরােধ করলে তিনি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’ বললেও মামলা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারের ভরণপােষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে প্রতিমাসে ৫০০.০০ টাকা দেয়ার নির্দেশ দেন।রাজিয়া ফয়েজ মিসেস রাজিয়া ফয়েজ একজন অন্যতম মুসলিম লীগ নেত্রী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে পাকিস্তানী প্রচারণায় অংশ নেন। স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক কারণেই তাকে আটক করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় নেতা ড. এ আর মল্লিক দালাল রাজিয়া ফয়েজের মুক্তির জন্য সুপারিশ করে বলেন যে, তখন গর্ভবতী থাকায় হানাদারদের প্রস্তাবে রাজি হতে তিনি বাধ্য হন। ফলে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।”আবদুল গাফফার চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮১ অ্যাস্তনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, ১৯৮৮ পৃষ্ঠা ৯৫-৯৭ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৭-২৮ যদিও ৩১ মার্চ ১৯৭২ খুলনায় এক জনসভায় মুজিব বলেছিলেন, যদি কেউ দালালদের জন্য। সুপারিশ করতে আসে, তবে তাকেই দালাল সাব্যস্ত করা হবে। দালালদের কখনই ক্ষমা করা হবে। (দৈনিক পূর্বদেশ, ১ এপ্রিল ১৯৭২)৯ মাসে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা মাত্র শতকরা ৭.৬ ভাগ! এক সূত্রে জানা যায়, ৩১ অক্টোবর ১৯৭৩ পর্যন্ত দালাল অধ্যাদেশে অভিযুক্ত মােট ৩৭,৪৭১ জনের মধ্যে ২,৮৪৮ জনের মামলার নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল ৭৫২ জন। বাকি ২,০৯৬ জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। অর্থাৎ দীর্ঘ ৯। মাসে অভিযুক্তদের অতি নগণ্য সংখ্যক শতকরা ৭.৬ ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং এদের শতকরা ২৬.৪ ভাগের শাস্তি হয় ও শতকরা ৭৩.৬ ভাগ খালাস পায়। এই গতিতে বিচারকার্য অগ্রসর হলে উক্ত অভিযুক্তদের বিচার নিষ্পত্তি করতে ৮৪ বছরেরও অধিক সময় প্রয়ােজন। ততদিন কি এরা রায় শােনার জন্য বেঁচে থাকবে? বলা বাহুল্য, বহু দালাল আত্মগােপন ও অন্যান্য কারণে উপযুক্ত অভিযুক্তদের বহির্ভূত রয়ে গেছে। অথচ হানাদর পাক-বাহিনী ও তাদের দালালরা ৯ মাসেই লক্ষ লক্ষ লােককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অভিযুক্তদের প্রদত্ত দণ্ড স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন মেয়াদের । পর্যালােচনা করে দেখা যায়, উঁচু পর্যায়ের অর্থাৎ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তদের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সংখ্যা আরও স্বল্পাতি স্বল্প ।
  7. হাইকোর্টে আপিলের পর শেষ পর্যন্ত কেউ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে এমন তথ্য জানা যায়নি। ফলে অনেকেই একে প্রহসনের নামান্তর মনে করেন।দালাল আইন সংশােধন ২৩ জুলাই ১৯৭২ সরকারি দৈনিক বাংলায় ‘দালাল আইনের সংশােধন প্রয়ােজন শিরােনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে প্রচলিত আইনটির নানা সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হয়। সপ্তাহান্তে (৩১ জুলাই) আওয়ামী লীগও উক্ত আইন সংশােধনের সুপারিশ করে। এসবের ফলে ২৯ আগস্ট সরকার দালাল আইন সংশােধন করেন। সংশােধনী সম্পর্কে বলা হয় :৪৪রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, তৃতীয় সংশােধনী) আদেশ ১৯৭২ জারি করেছেন। এ আদেশ সারা দেশে সাথে সাথে বলবৎ হবে এবং ১৯৭২ সালের ২৪ শে জানুয়ারি থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। এ আদেশে কোনাে ব্যক্তি বিচারে দালাল প্রমাণিত হলে তাকে ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।এ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন :দালাল আইন সংশােধনের পর ফৌজদারী বিধি অনুযায়ী স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দালালদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন।৪৩মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসপি, বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৭। প্রদত্ত শান্তির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ৫৭ জনের সম্পত্তি ক্রোক, ১৭ জন সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীকে বরখাস্ত/অপসারণ, ৪৩ জনের নাগরিকত্ব বাতিল, ১৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দৈনিক বাংলা, ৩০ আগস্ট, ১৯৭৩তিনি আরাে বলেন : যেহেতু দালালদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধমূলক কাজ দখলদার আমলেই সাধিত হয়, ফলে বর্তমানে এদের অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত চালাতে গিয়ে কতকগুলাে অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দেয়। সেজন্যই তা সংশােধন করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। দালাল আইন সংশােধিত হওয়ায় বিচারকার্য পূর্বের তুলনায় কিছুটা সহজ হয়। তবু হাজার হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকে। অন্যদিকে আইন সংশােধনের ফলে পাঁচ বছরের অধিক কারও সাজা হওয়ার সুযােগ ছিল না। যারা সাজা পাচ্ছিল তারাও ‘বিশেষ’ ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করার সুযােগ ব্যবহার করছিল। সব মিলিয়ে দালালদের সাজাও খুব হচ্ছিল না এবং মামলার নিম্পত্তিও খুব হচ্ছিল না।
  8. প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এক চিকন আলী ছাড়া কারও মৃত্যুদণ্ড হয়নি। শহীদুল্লাহ কায়সারের মামলার আসামি ঢাকা শহর জামায়াতে ইসলামীর তকালীন দপ্তর সম্পাদক খালেক মজুমদারের মাত্র সাত বছর জেল হয়। ‘ওকে ধরিয়ে দিন’ বলে যার সম্পর্কে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল, সেই মাওলানা মান্নানের কোনাে শাস্তিই হয়নি।” ১৮ ধরনের অপরাধী ব্যতীত অন্যদের মুচলেকার শর্তে ক্ষমা প্রদর্শন মুজিব-সরকার প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মাধ্যমে দালালদের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছেন, যেখানে বিচারকের নিকট অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের দাবি। রাখে। বিচারকের পক্ষে সন্দেহাতীত হওয়ার বিষয়টি খুব সহজ নয়। সকল ম্যাজিস্ট্রেটই যে স্বাধীনতার চেতনায় সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ছিলেন এমনও নয়। সর্বোপরি ছিল আত্মীয়-স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অনুরােধ ও চাপ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নানা মহল থেকে প্রকাশ্যে দালাল আইন তুলে দেয়া ও মানবিক কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার জন্য প্রস্তাব আসে। এমনকি বিদেশী প্রভাবশালী শক্তির পক্ষ থেকেও চাপ আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি স্বাধীনতার পরপরই কোনাে বিপ্লবী ধরনের সরকার গঠন করে বা বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে সংক্ষিপ্ত আদালত স্থাপন করে দ্রুত এই বিচার কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিত তাহলেই হত সর্বোত্তম। কিন্তু তা না-করায় এবং সময় গড়িয়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ১৯৭৩ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুচলেকা দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে সরকার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বলে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত কতিপয় ক্যাটেগরির লােককে ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘােষণা করেন।সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, যারা এই ক্ষমা ঘােষণার সুযােগ নিতে ইচ্ছুক তারা যদি জেলে কিংবা আটক থাকেন, এই ঘােষণা জারির তিন সপ্তাহের মধ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে হবে বা হাজির করতে হবে। যাদের এরশাদের আমলে মাওলানা মান্নান মাদ্রাসা শিক্ষকদের নেতা, মন্ত্রী ও ইনকিলাব পত্রিকার মালিক তিনি আরাে বলেন : যেহেতু দালালদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধমূলক কাজ দখলদার আমলেই সাধিত হয়, ফলে বর্তমানে এদের অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত চালাতে গিয়ে কতকগুলাে অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দেয়।
  9. সেজন্যই তা সংশােধন করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। দালাল আইন সংশােধিত হওয়ায় বিচারকার্য পূর্বের তুলনায় কিছুটা সহজ হয়। তবু হাজার হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকে। অন্যদিকে আইন সংশােধনের ফলে পাঁচ বছরের অধিক কারও সাজা হওয়ার সুযােগ ছিল না। যারা সাজা পাচ্ছিল তারাও ‘বিশেষ’ ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করার সুযােগ ব্যবহার করছিল। সব মিলিয়ে দালালদের সাজাও খুব হচ্ছিল না এবং মামলার নিম্পত্তিও খুব হচ্ছিল না। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এক চিকন আলী ছাড়া কারও মৃত্যুদণ্ড হয়নি। শহীদুল্লাহ কায়সারের মামলার আসামি ঢাকা শহর জামায়াতে ইসলামীর তকালীন দপ্তর সম্পাদক খালেক মজুমদারের মাত্র সাত বছর জেল হয়। ‘ওকে ধরিয়ে দিন’ বলে যার সম্পর্কে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল, সেই মাওলানা মান্নানের কোনাে শাস্তিই হয়নি।” ১৮ ধরনের অপরাধী ব্যতীত অন্যদের মুচলেকার শর্তে ক্ষমা প্রদর্শন মুজিব-সরকার প্রচলিত ফৌজদারি আইনের মাধ্যমে দালালদের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছেন, যেখানে বিচারকের নিকট অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের দাবি। রাখে। বিচারকের পক্ষে সন্দেহাতীত হওয়ার বিষয়টি খুব সহজ নয়। সকল ম্যাজিস্ট্রেটই যে স্বাধীনতার চেতনায় সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ছিলেন এমনও নয়। সর্বোপরি ছিল আত্মীয়-স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অনুরােধ ও চাপ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নানা মহল থেকে প্রকাশ্যে দালাল আইন তুলে দেয়া ও মানবিক কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার জন্য প্রস্তাব আসে। এমনকি বিদেশী প্রভাবশালী শক্তির পক্ষ থেকেও চাপ আসতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি স্বাধীনতার পরপরই কোনাে বিপ্লবী ধরনের সরকার গঠন করে বা বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে সংক্ষিপ্ত আদালত স্থাপন করে দ্রুত এই বিচার কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিত তাহলেই হত সর্বোত্তম। কিন্তু তা না-করায় এবং সময় গড়িয়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ১৯৭৩ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুচলেকা দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে সরকার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বলে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত কতিপয় ক্যাটেগরির লােককে ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘােষণা করেন।সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, যারা এই ক্ষমা ঘােষণার সুযােগ নিতে ইচ্ছুক তারা যদি জেলে কিংবা আটক থাকেন, এই ঘােষণা জারির তিন সপ্তাহের মধ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে হবে বা হাজির করতে হবে।
  10. যাদের এরশাদের আমলে মাওলানা মান্নান মাদ্রাসা শিক্ষকদের নেতা, মন্ত্রী ও ইনকিলাব পত্রিকার মালিকনামে গ্রেফতারি পরােয়ানা বা হুলিয়া জারি আছে এবং যারা পলাতক রয়েছেন, তারা ক্ষমা ঘােষণার সুযােগ গ্রহণে আগ্রহী হলে তাদেরও এই ঘােষণার তিন সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হতে হবে। সরকার আরাে ঘােষণা করেন যে : ১. চার নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিদের মামলা এবং অপরাধ ছাড়া বাংলাদেশ দালালআদেশে বর্ণিত অন্য কোনাে অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শাস্তি মাফ হবে এবং তাদের জেল থেকে ছেড়ে দিতে হবে অবশ্য যদি তারা বর্ণিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনাে আইনের বিচারযােগ্য এবং শাস্তিযােগ্য অপরাধের কারণে পুলিশের অভিযুক্তের তালিকায় না থাকেন। শুধু তাই নয়, তাদের সদাচরণের মুচলেকাদিতে হবে এবং লিখিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করতে হবে। ২. চার নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তি এবং অপরাধ ছাড়া, বাংলাদেশ দালালআদেশবলে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলাে প্রত্যাহার করা হবে এবং হাজতে আটক এসব মামলায় জড়িত ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে। অবশ্য যদি তারা বর্ণিত আদেশ ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার ও শাস্তিযােগ্য অপরাধে অভিযুক্ত না হন। এদেরও সদাচরণের সুচলেকা দিতে হবে। এবং লিখিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করতে হবে। চার নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মামলায় জড়িত ব্যক্তি অথবা অপরাধ ছাড়া অন্য অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা তদন্ত পরিত্যক্ত হবে। এদের বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেফতারী পরােয়ানা বা হুলিয়া বাতিল হবে এবং বর্ণিত আদেশ বলে এসব লােকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ (যার ক্ষেত্রে যেমন) আদেশ প্রত্যাহার বা বাতিল করা হবে এবং এরূপ ব্যক্তি জেলে থাকলে তাদের মুক্তি দেয়া হবে। অবশ্য যদি তাদের বিরুদ্ধে বর্ণিত আদেশ ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার ও শাস্তিযােগ্য অপরাধের অভিযােগ না থাকে। এদেরও সদাচরণের মুচলেকা দিতেহবে এবং লিখিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করতে হবে। ৪. উপরের ১, ২ ও ৩ নম্বর প্যারায় যাদের ক্ষমা লাভের যােগ্য ঘােষণা করা হয়েছেতারা ছাড়া নিম্নোক্ত ক্যাটেগরির অপরাধের অভিযােগে অভিযুক্ত লােকজন ক্ষমারআওতায় পড়বে না।
  11. ক. যারা বর্ণিত আদেশের নিম্নোক্ত ধারাসমূহে শাস্তিযােগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবাযাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মােতাবেক কোনােটি অথবা সব অপরাধের অভিযােগ থাকবে : ১. ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানাে অথবা চালানাের চেষ্টা)। ২. ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানাের ষড়যন্ত্র)। ৩. ১২৪ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা)। ৪. ৩০২ (হত্যা)। ৫. ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা)।৬. ৩৬৩ (অপহরণ)। ৭. ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ)। ৮, ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ) ৯. ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা)। ১০. ৩৭৬ (ধর্ষণ)। ১১, ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি)। ১২. ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত)। ১৩, ৩৯৫ (ডাকাতি)। ১৪. ৩৯৬ (খুন সহ ডাকাতি)। ১৫, ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি)। ১৬. ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন)। ১৭. ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার) এবং ১৮, ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোনােজলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহদান। খ, দখলদার আমলে উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধে যারা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন অথবা যাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট।অভিযােগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে। গ. দেশে অথবা বিদেশে দখলদার বাহিনীর পক্ষে প্রচারণা অথবা পাকিস্তানিপ্রতিনিধিদল অথবা কমিটির সদস্য হিসেবে এ-ধরনের প্রচারণা চালানাের জন্য | বিদেশে গিয়ে হানাদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগরয়েছে। ঘ, দখলদার আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান অথবা পাকিস্তানের গভর্নর, মন্ত্রী অথবাউপদেষ্টার পদ গ্রহণ করে হানাদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে। ঙ. আল-বদর অথবা আল-শামস বাহিনীর সদস্য হয়ে দখলদার বাহিনীর সাথেসহযােগিতা করার অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগ আনা। হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে।
  12. চ, রাজাকারদের কম্যাণ্ডার হয়ে দখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধেসাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোেগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে। ছ, দখলদার আমলৈ থানা, মহকুমা অথবা জেলা শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট,চেয়ারম্যান, আহ্বায়ক অথবা সম্পাদক হয়ে দখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা। করার অপরাধে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোেগ আনা হয়েছে। অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে।জ, দখলদার আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটির কর্মকর্তা হয়েদখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ রয়েছে। ঝ, মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ও সংগঠন দমনের উদ্দেশ্যে এবং এর বিনিময়ে ফায়দা গ্রহণ করে দখলদার বাহিনীর সাথে সহযােগিতা করার অপরাধে দপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোেগ রয়েছে। এ ঘােষণার আওতায় অনুকম্পা প্রার্থনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণ যারা জেলে বা হাজতে আছে অথবা মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যাদের হাজির করা হয় বা হাজির হওয়ার জন্যে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা বা হুলিয়া জারি হয়েছে এবং যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদান এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ও বাধ্যতা স্বীকার করার জন্য এ ঘােষণা প্রকাশের তিন সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলাপ্রয়ােজনীয় ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদান এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত্য ও বাধ্যতা স্বীকার ঘােষণার পর অনুরূপ মুচলেকা প্রদানকারী ও ঘােষণাকারী ব্যক্তিদের, তারা যদি দপ্রাপ্ত হয় তবে ৪০১ নং ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় তাদের বিরুদ্ধে। আনীত দণ্ডাদেশ মওকুফের যথাযথ নির্দেশ অনুযায়ী জেল হতে খালাস করা হবে, অথবা তারা যদি বিচারাধীন থাকে তবে ৪৯৪/এ ফৌজদারি কার্যবিধির আওতাধীনে চলতি মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অথবা বিশেষ মাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে প্রত্যাহারের পর হাজত হতে মুক্তি দেওয়া হবে। অবশ্য মুক্তির শর্ত হচ্ছে। তারা যদি উপরােক্ত আদেশের বাইরে বিচারযােগ্য ও শাস্তিযােগ্য অন্য কোনাে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকে, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের জন্যে জারিকৃত সকল পরােয়ানা ও হাজির হওয়ার জন্যে সকল ঘােষণা এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করার আদেশ বাতিল ও প্রত্যাহার করা হবে এবং ফিরিয়ে দেওয়া হবে।৬সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা এইসব শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা প্রদর্শনেও পরিস্থিতির খুব ইতরবিশেষ ঘটেনি। শর্তভুক্ত আঠারটি অপরাধে অভিযুক্ত হাজার হাজার লােক বলা চলে বিনাবিচারে আটক হয়ে রইল। আটককৃত লােকদের পােষ্যরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছিল। দেশের পত্রপত্রিকায় এ-সম্পর্কে বিরূপভাবে লেখা হচ্ছিল। বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, চোরাচালান রােধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শিল্প-কলকারখানায় অন্তর্ঘাতদৈনিক বাংলা, ১৭ মে, ১৯৭৩ অন্তর্ঘাতের বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ৭ পড়ুনসব মিলিয়ে সরকারের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তাছাড়া এক দিকে আইনের জটিলতার কারণে আটক দালালদের বিচারকার্য দ্রুততর করা সম্ভব হচ্ছিল না অন্যদিকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রায় সবাই ছাড়া পেয়ে যেতে থাকে। | বাংলাদেশের সমাজ যৌথ পরিবার ভিত্তিক। দেখা গেছে, কোনাে কোনাে পরিবারের এক ভাই মক্তিযােদ্ধা, অন্য ভাই বা আত্মীয় শান্তিকমিটির নেতা। পরিবারের বিভিন্ন ভাইয়েরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুক্ত।
  13. তদুপরি সুযােগসন্ধানী কিছু স্বাধীনতাবিরােধী লােক স্বাধীনতার পর সরকারি বা বিরােধীদলে কৌশলে ঠাই করে নেয় এবং এদের অতীত কার্যকলাপ আড়াল করার প্রয়াস পায়। | মাওলানা শামছুল হক (পাঁচবাগী) ও মাওলানা ভাসানীও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করেন। সাপ্তাহিক হলিডে সহ বেশকিছু পত্রিকায় এ নিয়ে লেখা হয়। দালাল মশিউর রহমান যাদু মিয়া হাজত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে প্রদত্ত এক সংবর্ধনা সভায় বিপ্লবী রাশেদ খান মেনন প্রমুখ পর্যন্ত তাকে আটক রাখার জন্য। মুজিব-সরকারের সমালােচনা করেন। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, পিছু হটতে। হটতে আওয়ামীলীগ সরকার পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় এবং ৩০ নভেম্বর। ১৯৭৩ নরহত্যা ও ধর্ষণকারী প্রভৃতি ব্যতীত সকল দালালদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা। ঘােষণা করে। সাধারণ ক্ষমার ফলে ৩৬,৪০০ দালাল মুক্তিলাভ করে।”নরহত্যা ও ধর্ষণকারী সাধারণ ক্ষমার বহির্ভূত ৩০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে এক ঘােষণায় বলা হয় :সরকার নরহত্যা, নারীধর্ষণ এবং অগ্নিসংযােগ অথবা বিস্ফোরকের সাহায্যে ঘরবাড়ি অথবা জলযান ধ্বংসের অভিযােগে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২ (পিও নং ৮, ১৯৭২) বলে যারা আটক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা অথবা হুলিয়া রয়েছে এবং যারা এইআইনে সাজা ভােগ করছেন তাদের সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেছেন। সরকারের ঘােষণায় বলা হয়েছে,১. দু’নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিদের ও অপরাধ সমুহের ক্ষেত্র ছাড়া ক. ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০১ নং ধারা অনুযায়ী উল্লিখিত আদেশ বলে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রেহাই দেয়া হচ্ছে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অপর কোনাে আইন বলে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ না থাকলে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হবে। খ, কোনাে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে অথবা কোনাে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটেরআদালতে উক্ত আদেশবলে বিচারাধীন সকল মামলা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল ও ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে প্রত্যাহার করা হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া। অপর কোনাে আইনে তাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন কোনাে মামলা বা অভিযােগ থাকলে তাদের হাজত থেকে মুক্তি দেয়া হবে।৭ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪০গ, কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে উল্লিখিত আদেশবলে আনীত সকল মামলা ও তদন্ততুলে নেয়া হবে এবং উল্লিখিত আদেশ ছাড়া অপর কোনাে আইনে বিচার ও দণ্ডযােগ্য আইনে সে অভিযুক্ত না হলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। উল্লিখিত আদেশবলে ইস্যু করা সকল গ্রেফতারি পরােয়ানা ও হাজির হওয়ার নির্দেশ অথবা কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে হুলিয়া কিংবা সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেয়া।
  14. থাকলে তা প্রত্যাহার বলে বিবেচিত হবে এবং গ্রেফতারি পরােয়ানা অথবা হুলিয়ার বলে কোনাে ব্যক্তি ইতিপূর্বে গ্রেফতার হয়ে হাজতে আটক থাকলে তাকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে। অবশ্য সে ব্যক্তি উল্লিখিত দালাল আদেশ ছাড়া বিচার ও দপ্তযোগ্য অপর কোনাে আইনে তার বিরুদ্ধে যদি কোনাে মামলা না থাকে তবেই। যাদের অনুপস্থিতিতেই সাজা দেয়া হয়েছে অথবা যাদের নামে গ্রেফতারি পরােয়ানা বা হুলিয়া ঝুলছে তারা যখন উপযুক্ত আদালতে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণী করবে কেবল তখনই তাদের বেলায় ক্ষমা প্রযোজ্য হবে। দণ্ডবিধির নম্বর ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা, ৩৭৬ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (গুলি অথবা বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্ষতি সাধন) এবং ৪৪৬ ধারা (ঘর জ্বালানাে) এবং ৪৪৮ ধারায় (নৌযানে আগুন বা বিস্ফোরণ) অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্তগণ এক নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ক্ষমার আওতায় পড়বে না।ক্ষমাপ্রাপ্তদের সম্পর্কে মুজিবের প্রত্যাশা। উক্ত ঘােষণাবলে ক্ষমাপ্রাপ্তদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন :এসব লােক দীর্ঘদিন ধরে আটক রয়েছেন… এতদিনে তারা নিশ্চয়ই গভীরভাবে অনুতপ্ত। তারা নিশ্চয়ই তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্য অনুশােচনায় রয়েছেন।… মুক্ত হয়ে দেশগঠনের পবিত্র ও মহান দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ণ সুযােগ তারা গ্রহণ করবেন এবং তাদের অতীতের সকল তৎপরতা ও কার্যকলাপ ভুলে গিয়েদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। উল্লেখ্য, মুজিবের এই আশাবাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মুক্তি পেয়েই তারা পুরনাে খেলায় মেতে উঠে।১৯৫ পাক-সেনা ও তাদের সহযােগীদের বিচার। ১৭ এপ্রিল ১৯৭৩ সরকারি এক প্রেস-বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের ৩নং ধারা লঙ্ঘন, নরহত্যা, বলাকার ও বাড়িঘর পােড়ানাের অভিযােগে ১৯৫ জন (প্রথমে এ-সংখ্যাটি নির্ধারণ৪৮ দৈনিক বাংলা, ডিসেম্বর, ১৯৭৩করা হয়েছিল ১,৫০০ জন) পাক-সেনা ও তাদের সহযােগীদের বিচার হবে। এজন্য মে মাসের শেষদিকে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতির মর্যাদাসম্পন্ন বিচারকদের নিয়ে ঢাকায়। একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠেয় বিচার কার্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিশারদদের আমন্ত্রণ জানানাে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পক্ষ সমর্থনের জন্য বিদেশীসহ পছন্দমতাে আইনজীবী নিয়ােগ করতে পারবেন।*
  15. ১৭ জুলাই ১৯৭৩ জাতীয় সংসদে এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) বিল ১৯৭৩ পাস হয়।২৮ আগস্ট ১৯৭৩ ভারতের সিমলায় জুলফিকার আলী ভূট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর। মধ্যে ভারতে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি° ও পাকিস্তানে আটকে পড়া ৫ লক্ষ বাঙালি নিজ নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।কিছুদিন পর জুলফি ভুট্টো অতীতের ভুল ভুলে গিয়ে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করার আবেদন জানালে বাংলাদেশ তাতে সাড়া দেয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ড. কামাল হােসেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ ও ভারতের প্রতিনিধি পি এন হাকসার দিল্লীতে আলােচনায় মিলিত হন। শেখ মুজিব চিকিৎসাশেষে মস্কো থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর সাথে অনুষ্ঠিত আলােচনায় ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার না-করার বিষয়ে সম্মত হন। ৯ এপ্রিল ১৯৭৪ পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বিচারের হাত থেকে রেহাই পায়।”সাধারণ ক্ষমার অসাধারণ প্রতিক্রিয়া। দালাল ও যুদ্ধবন্দিদের (১৯৫ জন) ক্ষমা করাকে কেন্দ্র করে দুটি বিপরীত মতামতের সৃষ্টি হয়। একদল একে ‘বিপর্যয় এবং অন্যদল মহত্ব” বলে অভিমত দেন। মহত্ত্ব বাদীরা হযরত মুহম্মদ (স.) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের পর প্রদত্ত ক্ষমা ঘােষণার উদ্ধৃতি দিয়ে একে তার শিক্ষা বলে অভিহিত করেন এবং এজন্য মুজিবের সংবেদনশীল মহানুভব হৃদয়ের প্রশংসা করেন। অন্যপক্ষ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মুজিব ব্যক্তিগতভাবে জড়িত নাথাকায় এবং তার পরিবারের কেউ নিহত না-হওয়ায় তিনি ‘ওদের নৃশংসতা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে এরূপ ‘অমার্জনীয় ভুল’ করা সম্ভব হয়েছে। ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন :গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যায় যাদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পরপরই তাদের ফাসি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সাধারণ ক্ষমার জন্য তাদৈনিক বাংলা, ১৮ এপ্রিল ১৯৭৩ আত্মসমর্থনকারী পাকিস্তানি সকল সৈন্যদের ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ এর মধ্যে ভারতে স্থানান্তর করে। আটক রাখা হয়েছিল। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫৮হয়নি। তৎকালীন সরকারের সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক একটি ভুল। সেদিন ক্ষমা ঘােষণা না করা হলে ঘাতকরা নিজেদেরকে সমাজে পুনর্বাসিত করারসুযােগ পেত না। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের সহধর্মিনী অধ্যাপিকা পান্না কায়সার বলেন :বর্তমানে রাজাকার আল-বদরদের যে দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমারই ফল। ওই ক্ষমা ছিল বিচার-বুদ্ধি হীন। সেদিন সরকার যদি ঘাতকদের বিচার করে সাজা দিত, তাহলে আজ এ অবস্থা হতাে না ।… তারা আপনজন হারান নি। ফলে স্বজন হারানাের ব্যথা তাদের জানা ছিল না। ঘাতকদেরতারা সহজেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ আলবদরের হাতে একত্রে শহীদ তিন ভাইয়ের (বদিউজ্জামান, শাহজাহান ও করিমুজ্জামান ওরফে মুলুক জাহান) পরিবারের অভিভাবক মুক্তিযােদ্ধা শামসুল হুদা বলেন :রাষ্ট্রপ্রধান কাউকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু যারা লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী লােককে হত্যা করেছিল তাদের ক্ষমা করে দেয়া অমার্জনীয় অপরাধ ছিল। ছিল একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত।… শুধু ক্ষমা নয়, ঐ সরকার শহীদ-পরিবারগুলাের প্রতি ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেনি। এই দেশ যদি সত্যিই স্বাধীন হয়ে থাকে তাহলে এই স্বাধীন দেশে ঘাতকদের রাজনীতি করার অধিকার বন্ধ করে দিতে হবে।শহীদ বদিউজ্জামানের পুত্র তুরানুজ্জামান বলেন, ‘আমার পিতার হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় আমি ক্ষুদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার শহীদ ডা. মর্তুজার স্ত্রীর ভাষায় :যাদের প্রাণ গেছে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই বুঝতে পেরেছেন শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমার মর্মান্তিক মর্মটা।‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি’র অমর সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা মাহমুদ বলেন :সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা কোনােভাবেই উচিত হয়নি।…
  16. ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি। সৈন্যদের সাথে মিলে যারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তারা আজ সমাজেপ্রতিষ্ঠিত হয়ে একইভাবে কাজ করছে। আর এটা ঐ সাধারণ ক্ষমারই ফল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হােসেনের পুত্র শাহীন রেজা বলেন :শুধু সাধারণ ক্ষমা নয়, এর আগে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সুকৌশলে রেহাই দেয়া হয়। অথচ যাদের বিরুদ্ধে। হত্যাকাণ্ডের কোনাে প্রমাণ ছিল না তাদের জেলে ঢােকানাে হয়। এ ছাড়াও যারা হত্যার মূল পরিকল্পনা করেছিল তারাও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সকল দায়দায়িত্ব। থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এরকম প্রহসনমূলক বিচারের পর আবার আসলাে সাধারণ। ক্ষমা।…মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৩৯সরকার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছিল বলেই আজ তারা সমাজ ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে।… এটা অত্যন্ত সাধারণ বিষয় যে, যারা হত্যা করে-তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। আর এই না-হওয়াটা অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে।কেন এই মা? রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অনেকে বারংবার প্রতিশ্রুতি-প্রত্যয় ঘােষণা করলেও দালাল ও যুদ্ধবন্দিদের বিচার-প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। ১৬ মে ১৯৭৩ সরকার ১৮ ধরনের অপরাধের (পূর্বে বর্ণিত) সাথে যুক্ত নয় এরূপ অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত দালালদের মুচলেকা দেয়ার শর্তে ক্ষমা প্রদর্শনের ঘােষণা দেন এবং ৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ নরহত্যা, নারীধর্ষণ এবং অগ্নিসংযােগ অথবা বিস্ফোরকের সাহায্যে ঘরবাড়ি অথবা জলযান ধ্বংসের অভিযােগে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ, ১৯৭২ (পিও ৮, ১৯৭২) বলে যারা আটক হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা অথবা হুলিয়া রয়েছে এবং যারা এই আইনে সাজা ভােগ করছেন তাদের সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করেছেন। এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বিজয় দিবসের মধ্যে ক্ষমাপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা আটক রয়েছে। তাদের সকলকে মুক্তি দেয়ার ঘােষণা দেয়া হয়। তথ্যাভিজ্ঞ মহল নিয়ােক্ত বিষয়সমূহকে সাধারণ ক্ষমার কারণ স্বরূপ মনে করেন : ১. দালাল আইনের অপব্যবহার স্বাধীনতার পর পর দেশে কিছু স্বাভাবিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একদল সুযােগসন্ধানী ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা রাজনৈতিক শত্রুতা চরিতার্থ করার জন্যে প্রতিপক্ষকে ‘দালাল’ প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পায়। জনৈক ভুক্তভােগীর ভাষায় ;সারাদেশে এই এক নতুন অত্যাচার ও একধরনের সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। কারাে বিরুদ্ধে শত্রুতা উদ্ধার করতে হলে, সে একজন ‘কোলাবােরেটার এই অপবাদ দেওয়াই যথেষ্ট।
  17. একাত্তরের রাজাকাররাই এখন কোলাবােরেটার খুঁজে বেড়াচ্ছে।… বহু নির্দোষ লােককে হেনস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু আসল কোলাবােরেটার যারা, তারা দিব্যি, সামান্য কয়েকজন ছাড়া শুধু নিরাপদে নেই, সরকারের কাছাকাছি চলেগেছে। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস এ প্রসঙ্গে বলেনএ আইনও দেশে গােলযোেগ আর গণমানুষের হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হল। বহু সক্রিয় হানাদার বাহিনীর দালালও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্ব পেল। অন্যদিকে বহুসাধারণ ক্ষমার প্রতিক্রিয়া সমূহের জন্য দেখুন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি, বুদ্ধিজীবী। হত্যার নেপথ্যে, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৮-৪১ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি দিনলিপি ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ১৪ জুন ২০০২নির্দোষ ব্যক্তিও ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত রােষানলে পড়ে সর্বস্ব হারাল। এমনকি যে কোর্টে দালালির অভিযােগে রাজাকার আলবদর প্রভৃতির বিচার ও দণ্ডাদেশ প্রদান করা হত, সে-কোর্টের হাকিম নিয়ােজিত হয়েছিলেন রাজাকার-সর্দার।২. আন্তরিকতার অভাব দালালদের বিচার করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব ছিল। আটক বেশিরভাগ লােকের বিরুদ্ধে ছিল খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ ও নির্যাতনের অভিযােগ; যেগুলাে দেশের সাধারণ আইনেই শাস্তিযােগ্য। কিন্তু এ বিষয়ে ইচ্ছা ও চেষ্টার অভাব পরিলক্ষিত হয়।স্বাধীনতার পরপরই ৩০ হাজার লােককে দালাল হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়; যা ছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। তাদের মধ্যে শত শত লােককে কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের খোঁজার জন্য কোনাে কঠোর প্রচেষ্টাও চালানাে হয়নি। তাছাড়া কোনাে অবস্থাতেই তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও বিচারের এমন কোনাে অর্থবহ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা বহু আগেই চলে গিয়েছিল নাগালের বাইরে। কাজী ফজলুর রহমানের ভাষায় ;তাদের (হানাদারদের) অপকর্মের কোনাে দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টাও হয়নি। এটা বােধহয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা চেষ্টার এই অভাবের সুযােগ নিয়ে রাজাকার দিইল্লা’ (মাওলানা। আল্লামা দেলােয়ার হােসেন সাঈদী) ১৪ বছরের অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে বলছে :আমি মানুষ মেরে থাকলে আমার বিরুদ্ধে কোনাে মামলা হল না কেন?”
  18. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার টানমান্দাইল গণহত্যা সম্পর্কে ঘাতক বইজ্যা (বজু মিয়া) বলে : ‘এসব সঠিক হলে আমাকে ছাড়ল কেন?’৩. দালালদের আত্মগােপন ও খােলস বদল : পরাজয়ের পূর্বাহ্নে পাকবাহিনীর পশ্চাদপসারণের সাথে সাথে দালালরা নিজ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বিশেষ করে ঢাকা সহ বিভিন্ন বড় শহরে আত্মগােপন করে। আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে এরা অনেকস্থানে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বাড়িতেও আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ নিজেদের খােলসও বদলে ফেলে। যেমন, চট্টগ্রাম জেলার রাজাকার প্রধান মীর কাসেম আলী (পরে রাবেতার কান্ট্রি ডিরেক্টর) মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মগােপন করে বদলে ফেলে নিজের নামটি। মীর কাশেম হয়ে যায় মিন্টু। তার পরিচিত সকলেই এ-নামটি জানে। মাথাভর্তি চুল রেখে চলাফেরা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের মতাে সােন্ডার লাগানাে শার্ট পরা শুরু করে। এরপর চট্টগ্রাম থেকে চলে আসে ঢাকায়। মিশে যায় হাজারাে মানুষেরঅ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ (অনুবাদ, মােহাম্মদ শাহজাহান), হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০০, (পুনর্মুদ্রণ) পৃষ্ঠা ২১ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি, দিনলিপি ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ৯। আগষ্ট ২০০২ সেই রাজাকার, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, ২০০১, পৃষ্ঠা ১৭৯ভিড়ে। অনেকে বলেছেন, সে-সময় মীর কাশেম নিজেকে মুক্তিযােদ্ধা বলেও পরিচয় দিত। এক সময় ঘাতক মঈনুদ্দিনের সাথে লন্ডনে পালিয়ে যায় মীর কাশেম আলী। | জানা যায়, পঞ্চগড়ের রাজাকার আনােয়ার কসাই’ মুক্তিযােদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট যােগাড় করে পুলিশবাহিনীতে যােগ দেয়। সে পঞ্চগড় শহরের সিংপাড়াস্থ শহীদ মুক্তিযোেদ্ধা হবিবর রহমানের পরিবারের জমি জোরপূর্বক গ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।৪, রাজনৈতিক পুনর্বাসন : স্বাধীনতার পর বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নেতৃত্বের। সুবিধাবাদিতা, অদূরদর্শিতা, সাময়িক ফায়দা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক দলসমূহে কৌশলে দালালদের কেউ কেউ বা তাদের সন্তানেরা ঢুকে পড়ে। মাওলানা মতীনের মতাে লােক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পার্টি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থান পায়। আটক অবস্থা থেকে সাজাপ্রাপ্ত দালাল মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে ‘বীর’ আখ্যা দিয়ে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেন মুক্তিযােদ্ধা ও বিপ্লবী’ কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। মাওলানা ভাসানী ও হলিডে’ দালাল আইন বাতিলের আহ্বান জানায়। নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের চেষ্টায় সর্ষিনার পীর-খ্যাত দালাল আবু জাফর সালেহ” রক্ষা পায়।
  19. ত্রাণতহবিল তসরূপ ও দালালদের আশ্রয় দেয়ার অভিযােগে আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ থেকে (১৯৭২ সালে) ওবায়দুর রহমানকে বহিষ্কার করার হয়। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইলের শহীদুল্লা, নান্দাইলের (ময়মনসিংহ) আব্দুল মতিন ভূইয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওয়ালিউর রহমান, চট্টগ্রামের সেলিম হায়দার, বাঘারপাড়ার (যশাের) জল্লাদ খালেক, কুমিল্লার শামসুল হক মােল্লা, মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ও নূরুল হক সানু প্রভৃতি রাজাকার আওয়ামী লীগের নেতা হয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়া দালাদের মধ্যে দু’একজন এমপিও বনে যায়। ৪জিয়ার বিএনপি পাকিস্তানি দালালদের জন্য তার সবগুলাে দরজা খুলে দেয়। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে পদপ্রার্থীদের মধ্যে ২৫০জনই ছিল ঐ দালালগােত্রের রাজনীতিবিদ। দল হিসেবে বিএনপির জন্ম পরে হলেও ১৯৭২ সাল থেকেই দালালরা গােপনে নানাভাবে নানা উপদলে সংগঠিত হচ্ছিল। স্বাধীনতার ঘােষক’ ও তার স্ত্রীর কল্যাণে দেশের মন্ত্রী তাে বটেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদেও দালালদের২৮ সেই রাজাকার, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, ২০০১, পৃষ্ঠা ৮১-৮৪সেই রাজাকার, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, ২০০১, পৃষ্ঠা ১২৩-২৫ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯১ সেই রাজাকার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪২-৪৩। জিয়া ও এরশাদ উভয়ই তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে ঐ পদকের অমর্যাদা করেছেন এ এল খতিব কারা মুজিবের হত্যকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪ সেই রাজাকার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩,৫৩,৬৪,৭৭,১১৭ ও ২৮৩ এ এল খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪২ভিড়ে। অনেকে বলেছেন, সে-সময় মীর কাশেম নিজেকে মুক্তিযােদ্ধা বলেও পরিচয় দিত। এক সময় ঘাতক মঈনুদ্দিনের সাথে লন্ডনে পালিয়ে যায় মীর কাশেম আলী।  জানা যায়, পঞ্চগড়ের রাজাকার আনােয়ার কসাই’ মুক্তিযােদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট যােগাড় করে পুলিশবাহিনীতে যােগ দেয়। সে পঞ্চগড় শহরের সিংপাড়াস্থ শহীদ মুক্তিযোেদ্ধা হবিবর রহমানের পরিবারের জমি জোরপূর্বক গ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।৪, রাজনৈতিক পুনর্বাসন : স্বাধীনতার পর বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নেতৃত্বের। সুবিধাবাদিতা, অদূরদর্শিতা, সাময়িক ফায়দা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক দলসমূহে কৌশলে দালালদের কেউ কেউ বা তাদের সন্তানেরা ঢুকে পড়ে। মাওলানা মতীনের মতাে লােক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পার্টি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থান পায়।
  20. আটক অবস্থা থেকে সাজাপ্রাপ্ত দালাল মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে ‘বীর’ আখ্যা দিয়ে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেন মুক্তিযােদ্ধা ও বিপ্লবী’ কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। মাওলানা ভাসানী ও হলিডে’ দালাল আইন বাতিলের আহ্বান জানায়। নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের চেষ্টায় সর্ষিনার পীর-খ্যাত দালাল আবু জাফর সালেহ” রক্ষা পায়। ত্রাণতহবিল তসরূপ ও দালালদের আশ্রয় দেয়ার অভিযােগে আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ থেকে (১৯৭২ সালে) ওবায়দুর রহমানকে বহিষ্কার করার হয়। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইলের শহীদুল্লা, নান্দাইলের (ময়মনসিংহ) আব্দুল মতিন ভূইয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওয়ালিউর রহমান, চট্টগ্রামের সেলিম হায়দার, বাঘারপাড়ার (যশাের) জল্লাদ খালেক, কুমিল্লার শামসুল হক মােল্লা, মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ ও নূরুল হক সানু প্রভৃতি রাজাকার আওয়ামী লীগের নেতা হয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়া দালাদের মধ্যে দু’একজন এমপিও বনে যায়। ৪জিয়ার বিএনপি পাকিস্তানি দালালদের জন্য তার সবগুলাে দরজা খুলে দেয়। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে পদপ্রার্থীদের মধ্যে ২৫০জনই ছিল ঐ দালালগােত্রের রাজনীতিবিদ। দল হিসেবে বিএনপির জন্ম পরে হলেও ১৯৭২ সাল থেকেই দালালরা গােপনে নানাভাবে নানা উপদলে সংগঠিত হচ্ছিল। স্বাধীনতার ঘােষক’ ও তার স্ত্রীর কল্যাণে দেশের মন্ত্রী তাে বটেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদেও দালালদের২৮ সেই রাজাকার, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, ২০০১, পৃষ্ঠা ৮১-৮৪সেই রাজাকার, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, ২০০১, পৃষ্ঠা ১২৩-২৫ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯১ সেই রাজাকার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪২-৪৩। জিয়া ও এরশাদ উভয়ই তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে ঐ পদকের অমর্যাদা করেছেন এ এল খতিব কারা মুজিবের হত্যকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪ সেই রাজাকার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩,৫৩,৬৪,৭৭,১১৭ ও ২৮৩ এ এল খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪২বসানাে হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে বিরােধিতার জন্য যেসব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেসব সাম্প্রদায়িক দলের উপর থেকে তারা নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে এবং জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছে।  ৫. আমলাতন্ত্র : স্বাধীনতার পর পরই মুজিবনগর সরকার কন্টিনিউয়েন্স অব সার্ভিসেস অর্ডার জারি করে পাকিস্তানের পরাজিত প্রশাসনের অংশ এবং পাকিস্তানমেইড’ আমলাতন্ত্রকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করেন। এটি ছিল একটি মস্ত ভুল সিদ্ধান্ত। এদের অনেকই জাতীয় নীতি প্রভাবিত করার মতাে গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষপদ দখল করে।
  21. কেউ কেউ আশঙ্কা করেন, কিছু উচ্চপদস্থ বাঙালি ছিলেন যারা ওই বিচারে ফেঁসে যাবার ভয়ে ভীত ছিলেন। ফলে তাদের কুকর্ম প্রকাশিত হবার আগেই তারা এ বিচারানুষ্ঠান বন্ধ করতে সচেষ্ট হন।৬. বিচার পদ্ধতি ও দালাল আইনে ত্রুটি : ২৩ জুলাই ১৯৭২ দৈনিক বাংলায়। ‘দালাল আইন সংশােধনের প্রয়ােজন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লেখা হয় :দেশ স্বাধীন হবার পর দালাল বলে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের শতকরা ৭৫ জনেরই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনাে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের সংখ্যা এমনিতেই অপ্রতুল। তদুপরি কোলাবরেটর অ্যাক্টে অভিযােগ তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে শুধু থানার ওসিকে। কিন্তু ওসির পক্ষে একা অসংখ্য মামলা তদন্ত করা একপ্রকার অসম্ভব।… এছাড়া দালাল আইন সম্পর্কেও আইন বিশেষজ্ঞদের কিছু মন্তব্য রয়েছে। তারা বলছেন, দালাল আইন করা হয়েছে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য। কাজেই সে-অপরাধ প্রমাণের জন্য থাকতে হবে সাক্ষ্যপ্রমাণের বিশেষ ধরন। কিন্তু বর্তমান আইনের সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য অনুসরণ করতে হয় একশ। বছরের পুরনাে ‘ইভিডেন্স এ্যাক্ট’।… ইভিডেন্স এ্যাক্ট অনুসরণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নানা জটিলতা। ফলে অপরাধ প্রমাণ করা হয়ে উঠেছে অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য।… একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার রূপে বােঝা যাবে। ধরা যাক একজন রাজাকার কোনাে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে, তারপর থেকে সে ব্যক্তির আর কোন সন্ধান মেলেনি। এই অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়েছে এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই করা যায়। কিন্তু যদি সেই রাজাকারটির বিরুদ্ধে মামলা চলে দালাল আইনে, তবে তার বিরুদ্ধে আনা যাবে না হত্যার অভিযােগ। অভিযােগ আনা হবে হত্যার জন্য অপহরণ করা হয়েছে। কারণ ইভিডেন্স এ্যাক্টে হত্যার চাক্ষুষ সাক্ষ্যপ্রমাণ না এনে খুনের অভিযােগ প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং এক্ষেত্রে যদিও লােকটি খুন হয়েছে, তবু আইনের মারপ্যাচে আসামীকে খুনী প্রমাণ করা যাবে না।
  22. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯ ৬৭ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৪দালাল আদেশ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করার অধিকার আসামীর থাকলেও ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধের জন্য অন্য কোনাে আদালতে বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে ফরিয়াদিকে বঞ্চিত করা হয়।বিশেষ পরিস্থিতির বিশেষ আইন এবং পুরননা এভিডেন্স অ্যাক্ট -এর সম্মিলনে সৃষ্ট ‘মৎস্যকন্যা’ মানুষের আশাভঙ্গের কারণ হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রয়ােজন ছিল বিশেষ সংক্ষিপ্ত আদালত যা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সারা দেশে বিশেষ নীতিমালা অনুসরণ করে বিচারকার্যের সমাপ্তি ঘটাতে। ন্যূনতম শাস্তি পাওয়ার জন্য শান্তি কমিটি বা রাজাকার প্রভৃতি বাহিনীর সদস্য প্রমানিত হওয়াই যথেষ্ট ছিল। এরপর কর্ম অনুযায়ী ফল ভােগ করতাে। তাছাড়া ওসিকে ‘তুষ্ট’ করে ফুটো চার্জশিট বা ফাইনাল রিপাের্ট সংগ্রহের সুযােগ বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে।৭. মুজিবের সামন্তবাদী মানসিকতা : নিজের প্রতিপক্ষ এমনকি শত্রুপক্ষের লােককেও ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শনে মুজিবের অকুণ্ঠ আগ্রহ তার ফিউডাল চরিত্র বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট করে তুলে। এই ফিউডাল চরিত্রবৈশিষ্ট্য ছিল ফজলুল হকেরও। অল্পতেই শত্রুপক্ষকে ক্ষমা করতেন। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে এই দুই নেতারই আবির্ভাব হওয়ার এঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র এবং রাজনৈতিক আচরণে ফিউডাল বৈশিষ্ট্য সবসময়ই ছিল প্রকট। মুজিব চরিত্রের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই সবুর খান, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজ, খাজা খয়েরউদ্দিন, মশিউর রহমান, রাজিয়া ফয়েজ সহ অনেকেই মুক্তি পাওয়া সহ নানা অপ্রাপ্য সুবিধা ভােগ করেছেন। এ এল খতিবের ভাষায়,মুজিব মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয় দ্বারাই বেশি চালিত হতেন। তিনি রেগে গেলেও শীঘ্রই ক্ষমা করতেন এবং কারাে উপর রাগ করলেও, তিনি দয়া দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতেন।… মুজিবকে যারা বােঝানাের সঠিক পন্থাটি জানতেন তারা প্রায়ই যেকোনাে কাজ তার কাছ থেকে হাসিল করাতে পারত। ভূট্টোও বলেছিল যে, ইমােশনাল এপ্রােচে মুজিবকে কাবু করা যায়।মুজিব হয়তাে চেয়েছেন, দেশ যেহেতু স্বাধীন হয়েছে সেহেতু সব নাগরিকই। সবরকম বিভেদ ভুলে এক হয়ে দেশগড়ার কাজ করুক। তিনি বলতেন :যদি এক ভাই দালাল তাে আর এক ভাই মুক্তিযােদ্ধা। প্রত্যেক পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত।আমি তাদের ক্ষতি বাড়াতে চাই না।” ৮. বহিঃশক্তির চাপ শেখ মুজিব ও গাফফার চৌধুরীর মধ্যে অনুষ্ঠিত এক। সাক্ষাৎকারের বর্ণনায় জানা যায়, অন্তত দালালদের ‘পালের গােদাদের ছেড়ে নাআবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮০ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৭-২৮ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪২ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৯দেওয়ার জন্য জনাব চৌধুরীর অনুরােধের জবাবে মুজিব হেসে বলেন :, তা হয় না।
  23. সকলকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমার এ আসনে বসলে তােমাকেও তা-ই করতে হত। আমি তাে চেয়েছিলাম নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে অন্তত ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধী অফিসারের বিচার করতে। তাও পেরেছি কি? আমি একটা ছােট অনুন্নত দেশের নেতা। চারিদিকে উন্নত ও বড় শক্তির চাপ। ইচ্ছা থাকলেই কি আর সব কাজ করা যায়?১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’ পত্রিকায় লুইস এম সাইমন্স লেখেন : | মার্কিন যুক্তরঃ ও বৃটেন মুজিবকে এই মর্মে উপদেশ দিয়েছে যে, ৭৩ হাজার। সামরিক ও ২০ হাজার বেসামরিক ব্যক্তির বিচার হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো নীতিভ্রষ্ট পাকিস্তানি জনগােষ্ঠী নিয়ে মহাসমস্যায় পড়ে যাবেন এবং এটি উপমহাদেশের শান্তি আলােচনাকে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করবে।শুধু তাই নয়, মুসলিম দেশসমূহ যারা কিনা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও অপরাধকর্ম চলাকালীন সময়ে সান্ত্বনার স্বরটুকু পর্যন্ত। বের করেননি, তারা ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির ভাগ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেনযাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন অপরাধের অভিযােগ ছিল। এর চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলাে পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের ভাগ্য যুদ্ধবন্দির ভাগ্যের সাথে সমন্বিত হয়ে পড়ে ।২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত এক ভাষণে অত্যন্ত ব্যথিত কণ্ঠে মুজিব বলেন :আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমি তাদের বিচার করিনি। আমি তাদের ক্ষমা করেছি। কেননা আমি এশিয়া এবং বিশ্বের বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম।”প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে ১৯৭২ সালের ২৬ এপ্রিল দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুজিব বলেছিলেন :আমরা যদি খুন ধর্ষণ এবং লুটতরাজের মতাে অপরাধের শাস্তি প্রদান না করি তবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের কখনও ক্ষমা করবে না।অথচ সেই মুজিবই ‘চারিদিকে উন্নত ও বড় শক্তির চাপে’র সম্মুখীন হয়ে এশিয়া ও বিশ্বের বন্ধুত্বের আশায় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।৯. পাকিস্তানে আটক বাঙালি প্রত্যর্পণ : সামরিক-বেসামরিক চাকুরি ও অন্যান্য প্রয়ােজনে বিপুলসংখ্যক বাঙালি পরিবার রাজধানীসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানেআবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪ প্রসঙ্গক্রমে, সর্বত্রই আত্মসমর্পনকারী সেনার সংখ্যা ৯৩ হাজার এবং যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা ১৯৫ উল্লিখিত এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯২ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯২বসবাস করত।
  24. যুদ্ধের কারণে তাদের অনেকই আটকা পড়েন। ভুট্টো সরকার এদের প্রত্যর্পণের বিষয়টি তাদের ৯৩ হাজার সৈনিকের প্রত্যর্পণের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে। এজন্যেও যুদ্ধবন্দিদের বিচারের বিষয়ে ছাড় দিতে হয় বলে বলা হয়ে থাকে। বিষয়টি হয়তাে সত্য, কিন্তু প্রতিটি লেনদেনেই সাধারণত ভারসাম্য রক্ষা করে সম্পন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে কী তা হয়েছে?১০. যুদ্ধবন্দিদের ভরণ-পােষণ ব্যয় : আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের ভারতে আটক রাখা হয়। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভারত-সরকার আর্থিক-সামাজিক চাপের সম্মুখীন হয়। ১৯৭২ -এর খরায় ভারতে শস্যের উৎপাদন (১৫ মিলিয়ন টন) হ্রাস পায়। তাছাড়া তেলের মূল্যবৃদ্ধি ভারতকে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন করে। সব মিলে যুদ্ধবন্দিদের। ভরণ-পােষণ ভারতের জন্য অসহ-বােঝা হয়ে দাড়ায়। নিজ দেশে ইন্দিরা এজন্য সমালােচনার শিকার হন। তাই ভারত বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি কামনা করছিল।দালাল ও যুদ্ধবন্দিদের ক্ষমা করার পেছনে হয়তাে আরও কারণ আছে যা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। আশা করি গবেষকগণ ভবিষ্যতে তা খুঁজে বের করবেন। কিন্তু কারণ যা-ই থাক, বিশেষ করে ওদের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা কোনােদিনই তা সহজভাবে নেবে না। প্রতিটি ২৫ মার্চ বা ১৪ ডিসেম্বর এদেরকে অশ্রুসিক্ত করবে। পতাকার লাল রং সর্বদা এদের শােক-বিহ্বল করবে। দালাল ও দালালদের উত্তরসুরীদের (বংশগত ও রাজনৈতিক) বাড়ি-গাড়িতে যতদিন জাতীয় পতাকা উড়বে ততদিন ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর তাদের কাছে আনন্দের দিন হবে না। বাংলাদেশ যতদিন স্বাধীন থাকবে ততদিনই রাজাকার আলবদরদের প্রশ্নটি আসবে। এদের বিচার করে পরে যদি উদারতা দেখিয়ে ক্ষমাও করা হত তবুও সান্ত্বনার একটা। বিষয় থাকত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালের অপরাধীরা যদি আজও বিচারের সম্মুখীন হয় তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ায় কথা নয়। দালাল বা দালালদের বিচার প্রসঙ্গটিকে কেউ কেউ জাতীয় ঐক্যের বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে সমালােচনা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে শুধু এতটুকু বলা-ই যথেষ্ট যে, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোেগ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে গড়ে উঠা ঐক্যই প্রকৃত জাতীয় ঐক্য। মুষ্টিমেয় দালাল যেমন এর বিরুদ্ধে ছিল, আজও তাই থাকবে। জাতি, স্বাধীনতা, উন্নয়ন বিষয়ে ‘ওদের’ কোন ভূমিকা থাকতে পারে না। ওদের বাদ দিয়েই প্রকৃত জাতীয় ঐক্য। এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন, স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার সমান অপরাধ।ক্ষমা ঘােষণার পরও সরকারি গেজেটে আত্মগােপনকারী দালালদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ অন্যথায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুশিয়ারি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি-করা সমন প্রকাশিত হতে থাকে।
  25. ১৯ জুলাই ১৯৭৪ দালালির অভিযােগে সুপ্রিমকোর্ট জনৈক হাফিজ শাহ মােহাম্মদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১১ আগস্ট ১৯৭৫ একই অভিযােগে ৬ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এতে বুঝা
  26. সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান