You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র

ভারতীয় বিমান ছিনতাই ও ধ্বংস যে এক গভীর ষড়যন্ত্র প্রসূত এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। উপরন্ত ছিনতাইকারীদের ভারত সরকারের নিকট সমপর্ণ করতে পাকিস্তান সরকারের অস্বীকৃতি পূর্বকল্পিত ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বেরই স্বীকৃতি। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা ও সংবাদপত্রসমূহের এই অভিযােগ অত্যন্ত সঠিক বলেই আমরা মনে করি।
এই ষড়যন্ত্র কেবল ভারতের বিরুদ্ধে নয়, খােদ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দ্রুত অগ্রগতির বিরুদ্ধেও। কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত বিরােধকে সজীব করে তােলার জন্য এই ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তােলা হয়েছে। পাকিস্তানের গণ-আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাক-ভারত সম্পর্ককে সবসময়েই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এক ঢিলে দুই পাখী মারার কৌশল পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার পক্ষে নতুন কোন আবিষ্কার নয়। পাক-ভারত বিরােধ থেকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধানােই হােল নয়া উপনিবেশবাদীদের পুরান কৌশল। দেশ বিভাগ থেকেই এই কৌশল চালু হয়েছে। কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরান কৌশল নব নব মূর্তিতে আবির্ভাব হচ্ছে মাত্র।
নিজেদের দেশের গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই পাকিস্তানের প্রগতিশীল জননায়কেরা তিক্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই শাসকগােষ্ঠী ও তাঁদের অনুগামীদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করেছেন। এটা নিশ্চয় পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিপক্কতারই লক্ষণ। এই কারণেই পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র ভারতীয় বিমানকে জোর করে নামান থেকে ধ্বংস করা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনার শুধু নিন্দাই করেন নি, উপযুক্ত তদন্তের দাবি করেছেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই প্রতিবাদ ও তদন্তের দাবি এখনও ধ্বনিত হয় নি। বরং খবরে প্রকাশ যে, পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জনাব ভুট্টো লাহােরে বিমান ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলাপআলােচনা করেছেন। জনাব ভুট্টোর ভারত বিদ্বেষের জন্য খ্যাতি আছে। কিন্তু ভারত বিদ্বেষ যে নয়াউপনিবেশবাদীদের অন্যতম হাতিয়ার এ সত্যটি জেনেও জনাব ভুট্টো নীরব। তার এই নীরবতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতেও ফাটল সৃষ্টি করেছে। সেই ফাটলের পূর্ব সুযােগ নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নয়া-উপনিবেশবাদীদের ফাঁদে পা দিলেই যে নিজের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যাহত হয় এবং জনসাধারণ ইন্সিত পথে অগ্রসর হতে বাধা পায় এটাই তার প্রমাণ। বিমান ছিনতাই ও ধ্বংস দুই পাকিস্তানের মধ্যেও সামরিকভাবে মতবিরােধ সৃষ্টি করেছে। একদিকে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের বাহনের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা ও নীরবতা প্রদর্শন। নেতাদের দুই বিপরীত মনােভাব সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ বা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।
ভিন্ন দেশের বিমান ছিনতাই ও ধ্বংস করার ঘটনার আন্তর্জাতিক গুরুত্বও আছে। যুগােশ্লাভিয়া ও সিংহল বিমান ছিনতাই ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করছে যে, পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে লঙ্ঘন করতেও দ্বিধা বােধ করেন না। টোকিও ও হেগ কনভেনশন বিমান ছিনতাই-এর বিরুদ্ধে অনেক পূর্বেই ইতিবাচক বক্তব্য উপস্থিত করেছেন। এটা যে পাকিস্তান সরকারের অজানা তা-ও নয়। তা সত্ত্বেও ছিনতাইকারীদের ভারত সরকারের নিকট পাকিস্তান সরকার সমর্পণ করবেন না। কারণ, পাকিস্তান সরকারের ভারত-বিরােধী ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এই কারণেই পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘনে সাহসী হয়েছে।

সূত্র: কালান্তর, ১৪.২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!