বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা আগস্ট, শুক্রবার, ১৬ই শ্রাবণ, ১৩৮১
অশুভ তৎপরতা রুখতে হবে
বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো, কারো সর্বনাশ কারো পৌষ মাস। কথাটা যে একেবারে ষোলআনা সত্যি তার প্রমাণ মেলে দেশে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে। ঝড়, ঝঞ্চা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ইত্যাদি অঘটন ঘটলে এক শ্রেণীর অসাধু ও সমাজ বিরোধী ব্যক্তিরা অতিশয় তৎপর হয়ে ওঠে। ওদের কর্মচঞ্চল যেন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ওদের ধারণা ‘টুপাইস’ কামিয়ে নেবার এইতো মহালগ্ন। বর্তমানে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি এক ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখিন। এমন দুর্যোগ বিগত কয়েক বছরেও দেখা দেয়নি। বন্যায় হিংস্র থাবা শত বাহু বিস্তার করে ১৪টি জেলার অসংখ্য মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে ভয়াবহ সংকট। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, দুর্গত মানুষের বাঁচানোর চেষ্টা টুকু দেশি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার দিন ও শেষ হয়েছে। চতুর্দিকে হাহাকার। সর্বত্রই থৈথৈ করছে পানি। কোন কোন অঞ্চলে একচিলতে শুকনো জায়গাও নেই। যেখানে ত্রাণ সামগ্রী ফেলা যেতে পারে। খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, ভিটামাটি নেই, নেই ঔষধপত্র-এ এক অসহনীয় করুন অবস্থা। এমনই এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, নুন, মরিচ, কেরোসিন সবকিছুর দাম বাড়ছে। আর এবাড়ার পেছনে রয়েছে একজন অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি।
গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, ‘ঢাকার রূপগঞ্জ এলাকার লবণ সম্পর্কে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদের রটানোর ফলে জনসাধারণের মধ্যে অতিমাত্রায় লবণ ক্রয় ও মজুতের প্রবণতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। পক্ষান্তরে মুনাফা শিকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার হতে লবণ উধাও হইতে শুরু করিয়াছে। প্রতিসরণ তিন টাকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন টাকা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আরও অধিক মূল্যে বিক্রি হইতেছে।’ নীলফামারী পাবনা এবং বাংলাদেশের লবণ ভান্ডার কক্সবাজারের ‘খোলাবাজারে এখন দেড় টাকা সের দরে লবণ বিক্রয় হইতেছে।’
উল্লেখিত সংবাদ এর পরিপ্রেক্ষিতে এতটুকু পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা রীতিমতো তৎপর হয়ে উঠেছে। যে কোন উপায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি তাহাদের লক্ষ্য।
একদিকে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি অন্যদিকে সমাজের এক শ্রেণীর অসাধু ও সমাজ বিরোধী ব্যক্তিদের অশুভ তৎপরতা। এরা গরীবের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে বাড়ি, গাড়ি আর টাকার পাহাড় গড়ে তোলার নেশায় ব্যস্ত। এই একশ্রেণীর টাউটদের কল্যাণে রিলিফের ত্রাণ সামগ্রী দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। এরা জনসাধারণের জীবনকে কিভাবে বিষিয়ে তুলেছে তার প্রমাণ হলো গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত অপর একটি সংবাদ। চিলমারী এলাকার দুর্ঘটনা জনসাধারণের বক্তব্য হলো, ‘ইলিফের চাউল, গম, চাঁও না। বানের পানিতে হামার গুলোর সউগ গিয়াছে, জমি গিইছে, বিচন ধান গেইছে। ওগের ওষুধ নাই। ইলিফ আইলে নেতা গোতা মেম্বোর চেয়ারম্যানরা চুরি করে খাইবে। তোমরা হামাক গুলাক এক মুট নুন দ্যাঁও। পাটার পাতা কলার পাতাত মাকিয়া আজরাইলের হাত থাকি জানটাকে বাঁচাবার চাই।’
দুর্গত জনসাধারণের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিঃসৃত বক্তব্য যে কতটা মর্মস্পর্শী তা বুঝিয়ে বলার জন্য বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এটা সত্য যে, বন্যা দুর্গতদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করার জন্য সরকার এগিয়ে এসেছেন। অর্থ ও ত্রাণ সামগ্রী সাধ্যানুসারে সরকার বিভিন্ন এলাকায় পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সবকিছু যথা স্থানে পৌঁছেছে কিনা এটা লক্ষ্য না রাখলে সবকিছুই বিফল হয়ে যাবে। অসাধু ব্যবসায়ী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করতে না পারলে বর্তমানে ও বন্যা পরবর্তী সময়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে সতর্ক হতে হবে বৈকি! তবে এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, এহেন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হলে সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ সংস্থা গুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। একা সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হলেও প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে বন্যাদুর্গত মানুষ গুলোর জীবনের স্বাচ্ছন্দ না হোক অন্ততঃ স্বস্তি যে আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের সঙ্কট
দেশে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বলে এক সংবাদে প্রকাশ। চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত সীমিত পরিমাণ নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বর্তমানে স্টরে মজুদ রয়েছে। অনতিবিলম্বে এই মজুত শেষ হয়ে যাবে বলে সংবাদে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। স্ট্যাম্পের সংকটের কারণে ভেন্ডাররা পূর্বের মতো পরিমাণ স্টাম্প আর পাচ্ছেন না, তাদেরকে সপ্তাহে মাত্র ২হাজার টাকার স্ট্যাম্প সরবরাহ করা হচ্ছে। সাবেক পাকিস্তান আমলে একমাত্র ঢাকায় ট্রেজারি থেকে ১২ কোটি টাকার স্ট্যাম্পে বিক্রি হতো কিন্তু সে ক্ষেত্রে বর্তমানে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত মাত্র ৩৭ লাখ টাকার স্টাম্প বিক্রি হয়েছে। এখন ট্রেজারিতে যে পরিমাণ স্টাম্প মজুত রয়েছে তাতে অনুমান করা হচ্ছে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মজুদ শেষ হয়ে যাবে। জানা গেছে, পূর্ব জার্মানি থেকে ১০ লক্ষ টাকার স্ট্যাম্পে চালানোর কিছু অংশ ইতিমধ্যে আমদানি করা হয়েছে। এবং এই স্টাম্প দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। সংবাদে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘ট্রেজারি হতে অর্থমন্ত্রণালয় যে ইন্ডেন্ট পাঠানো হয় তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম প্রদান করা হয়। স্টোরে স্ট্যাম্পের স্বল্পতার জন্য দেশে ৪৯টি ট্রেজারি ও সাবট্রেজারি হতে প্রেরিত ইনডেন্ট অর্থ মন্ত্রণালয় পাশ করে দেবার পরও স্টোরে হ্রাসকৃত ষ্ট্যাম্প সরবরাহ করা হয়।’ একারণে স্ট্যাম্পের স্বল্পতা ও হ্রাস কৃত সরবরাহের দরুণ ভেন্ডাররদের মধ্যে স্ট্যাম্প মজুদ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। দেশের সর্বত্রই স্ট্যাম্পের স্বল্পতার কারণে যে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে তাতে করে সুযোগ সন্ধানীরা ও কৃত্রিম অসুবিধা সৃষ্টি করেছে। এদিকে স্ট্যাম্প ভেন্ডাররা অভিযোগ তুলেছে যে, পূর্বের ন্যায় তারা প্রয়োজনীয় পরিমাণ স্ট্যাম্প পাচ্ছে না বলে তাদের সংসার জীবনে নিদারুণ সংকট দেখা দিয়েছে। শতকরা হিসেবে তারা যে স্ট্যাম্প পায় তাতে করে সপ্তাহে ২ হাজার টাকার স্ট্যাম্পে তাদের কিছুই হয় না। এ অবস্থা থেকে বাঁচবার জন্য তারা ভেন্ডার প্রতি স্টাম্পের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি উত্থাপন করেছে।
ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিলে জানা যাবে যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর জমি রেজিস্ট্রির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও প্রধান অন্তরায় হলো নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের স্বল্পতা। স্ট্যাম্পের দুষ্প্রাপ্যতা যদি অনতিবিলম্বে মেটানো না যায় তাহলে গোটা দেশের রেজিস্ট্রি কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরকারের আর্থিক ক্ষতি ছাড়া ও জনগণের দুর্দশা নিদারুণভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে করে সরকারের দুর্বলতা আরো প্রকট হয়ে জনগণের সামনে ফুটে উঠবে। স্টাম্পের সংকটকে আরো তীব্র করে তুলছে কিছুসংখ্যক অসৎ ভেন্ডার। এরা অধিক মূল্যে স্টাম্প বিক্রির অশুভ পথ অবলম্বন করছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ স্ট্যাম্পের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে সংবাদপত্রের খবর বেরিয়ে আসছে। জাতীয় সংসদের অধিবেশনের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প প্রাপ্যতা সম্পর্কে এক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। আমাদের অর্থমন্ত্রীর সাবেক সরেজমিনে তদন্ত জন্য কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে গত ২৫ জুলাই ঢাকা জেলা কটি আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি হাতেনাতে একজন স্ট্যাম্পের মজুদকারিকে ধরেছিলেন। সে বেশি দামের স্ট্যাম্প বিক্রি করছিল। পরে মন্ত্রী সাহেব নিজেই মামলায় সাক্ষ্যও দিয়েছেন। স্টাম্পের এই বর্তমান সঙ্কট দূর করা একান্ত আবশ্যক। কর্তৃপক্ষ অবশ্য অবিলম্বে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক