You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972 | হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত - জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে - সংগ্রামের নোটবুক

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি-প্রকৃতি হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত হয় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যের উত্তরে আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক কে, এম, ওবায়দুর রহমান সর্বদলীয় সরকারের ধারণাকে ‘অবাস্তব’ আখ্যায়িত করে এর বিরােধিতা করেন। তবে প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে একটি মধ্যপন্থি’ ঘােষণায় বলেন, যুদ্ধ চলাকালে সরকারের সাহায্যকারী ৫ দলীয় পরামর্শদাতা কমিটি বহাল থাকবে। ফলে তখনকার মতাে বিতর্কটির সমাপ্তি ঘটলেও উক্ত কমিটিকে আর বহাল করা হয়নি। পরে ৩১ দৈনিক বাংলা, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭২  ২. ওবায়দুর রহমান ত্রাণ তহবিল তছরুপ ও দালালদের আশ্রয়দানের অভিযােগে দলের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ থেকে বরখাস্ত হয়েও পরে ১৯৭৩ সালে প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মুজিবের খুনীদের সাথে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামী ও বিএনপি দলীয় সাংসদ। দৈনিক বাংলা, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ দৈনিক বাংলা, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ডিপি ধর ২৯ আগস্ট কলকাতায় স্বাধীনতা সমর্থক সকল রাজনৈতিক দলকে একটি ফোরামে একত্রিত করার ভারত-সরকারের অভিপ্রায়ের কথা জানালে ৮ সেপ্টেম্বর শুধু পরামর্শ দানের জন্যে ১. মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি) ২. জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ (আহবায়ক) ৩, খন্দকার মােশতাক আহমদ ৪, কমরেড মণিসিংহ (কমিউনিস্ট পার্টি) ৫, শ্ৰী মনােরঞ্জ ধর (কংগ্রেস) ৬, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ (ন্যাপ)-কে নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’ ১৭ সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে : সর্ব দলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায়, বাংলাদেশের ভিতরে মুক্তিসংগ্রামীরা যেমন অনুপ্রাণিত হবেন, তেমনি বাইরে বাংলাদেশের শুভাকাঙ্গী ও বন্ধুদেশগুলােও উৎসাহিত হবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের একাংশ তাতে অনুপ্রাণিত হওয়ার বদলে কুপিত হন। আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ৪০ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (৫ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি আনুষ্ঠানিক অনাস্থা প্রকাশ করে এবং কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ।

সদস্যদের সমম্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ গঠনের দাবি জানায়। (মতান্তরে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে সেরনিয়াব্রত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং শেখ আজিজ ও শাহ মােয়াজ্জেম সহ কয়েকজন নেপথ্যে থেকে এ-প্রস্তাব চাঙা করেন। অবশ্য আলােচনার পর তা নাকচ হয়ে যায়)। ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিষদ সদস্য এনায়েত হােসেন খানের সভাপতিত্বে এ-গ্রুপের পরবর্তী সভায় তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণসেপ্টেম্বর ১৯৭২ পল্টন ময়দানে ভুখা মিছিল উপলক্ষে আয়ােজিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী মানুষ বাঁচানাের জন্য জাতীয় সরকার বাস্তবায়নের দাবি জানান। ২১ এপ্রিল ১৯৭৪ সর্বদলীয় (৬ দলীয়) যুক্তফ্রন্টের ৬ নেতা এক যৌথ বক্তব্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য সমস্যা ও জনজীবনের নিরাপত্তার লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রয়াস’র” প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরেন এবং মাওলানা ভাসানী ৩ নভেম্বর ১৯৭৪ পল্টনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পুনরায় মুজিবের প্রতি জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান। বলা বাহুল্য, এ ধরণের আহ্বানে ক্ষমতাসীন মহল সাড়া না দিয়ে বরং এর ভিন্ন অর্থ আবিষ্কারে অধিক মনােযােগী হয়েছেন। অথচ দেশ গড়া ও দুর্যোগকালে জাতীয় ঐক্যের প্রয়ােজনীতা সর্বজনবিদিত। সরকার বিরােধী বিক্ষোভ-আন্দোলন সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের দেশব্যাপী প্রচারাভিযান মানুষকে রাজনীতি ও অধিকার সম্পাদক উভয় পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। অক্টোবরে প্রচারিত তাদের এক সার্কুলারে বলা হয় । It is Awami league alone which is eligible and competant to conduct present war We all are aware that taking NAP (two groups), Communist Party and Congress along with Awami league, a joint front infact has been formed naming a consultative committee for the liberation struggle against the avowed policy of our leader Sk, Mujibar Rahman. (দ্র. মইদুল হাসান, মুলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০১) ।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চরিত্রদান এবং অ-আওয়ামী । স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ যুদ্ধের স্বার্থেই খুব প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী ১০ এপ্রিল তার প্রথম ভাষণেই এ-প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে শামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ও বাস্তব প্রয়ােজনেই একটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ার দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু আওয়ামী-পরিবারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভ ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান এ-প্রসঙ্গে বলেন, মুক্তিফ্রন্ট গঠনের কোনাে দরকার নাই, সকলে। বাংলাদেশ সরকার তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিয়া নিলেই সমস্যা চুকিয়া যায়’ (সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ’ ২৬ জুলাই ১৯৭১)।অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের আশীর্বাদপুষ্ট মুজিববাহিনী সৃষ্টির অন্যতম কারণই ছিল যুদ্ধে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি মােকাবেলা করা। ফলে জাতীয় ফ্রন্ট তাে দূরের কথা কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর) সমর্থক ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং নিতে তারা আপত্তি তােলে এবং বাধারও সৃষ্টি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রকৃত কাজই ছিল স্বাধীনতার ক্ষতিসাধন। উপরন্তু তিনি ছিলেন আদর্শ ও ঐতিহ্যগতভাবে বাম-প্রগতি বিরােধী। ফ্রন্ট সম্পর্কে তিনিও বিরূপ মন্তব্য করেন। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭ ১৪ এপ্রিল ১৯৭৪ মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আতাউর রহমান খান, আমেনা বেগম, অলি আহাদ, সৈয়দ সিরাজুল হুদা প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত মুজিব সরকার বিরােধী ফ্রন্ট। কয়েকটি জনসভা অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন কোন ভূমিকা পালনে এ ফ্রন্ট সক্ষম হয় নি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩ সচেতন করে তােলে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় প্রত্যাশা পূরণ না-হওয়ায় মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার দেড় মাসের মাথায়। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বেকার যুবকেরা। চাকুরি প্রার্থনা করে ঢাকায় মিছিল করে।

কিছুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬ জন মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট করেন। এর এক সপ্তাহ পর ১ মার্চ খুলনায় খালি ‘টিন’ হাতে কেরােসিন তেলের দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল। যুদ্ধের নয় মাস স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়। খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। অন্যদিকে যুদ্ধকালে পাকিস্তানী শিল্পপতিরা বাংলাদেশ থেকে ৭৮৫ কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যায় এবং আত্মসমর্পণের পূর্বাহ্নে হানাদাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল টাকা পুড়িয়ে দেয়। অবকাঠামাে ধ্বংস হওয়ায় শূন্য হাতে ফিরে-আসা শরণার্থীদের কাছে সরবরাহ যা আছে তা পৌছানােও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তদুপরি রিলিফসামগ্রী বণ্টনে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযােগ পাওয়া যেতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৬ আগস্ট ১৯৭২ বরিশালের বানারিপাড়ায় ও ২১ আগস্ট রংপুরে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল অনুষ্ঠিত  উপযুক্ত বিক্ষোভ-মিছিলগুলাে স্বত:স্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে মাওলানা ভাসানী ‘সংগঠিত’ সরকার বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় ভুখা মিছিল ও জনসভার আয়ােজন করেন। সভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করেছে বলে অভিযােগ তুলে প্রকারান্তরে পাকিস্তানি আমলের ভারত বিরােধী রাজনীতির অশুভ উদ্ভোধন করেন। এরপর তিন দফা দাবি (১. খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যমূল্যহ্রাস, ২. দমননীতি বন্ধ করা এবং ৩, শিল্প, ব্যবসা, চাকরিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে অরাজকতার অবসান ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান) আদায়ের উদ্দেশ্যে ভাসানী ১৫ মে ১৯৭৩ ঢাকায় অনশন শুরু করেন ও ২১ মে সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। হরতাল-কালে একদল উচ্ছঙ্খল লােক এশীয় শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে নির্মিত ভিয়েতনাম মন্ডপ’ বিধ্বস্ত করে। কিন্তু একই কারণে আহুত ১২ অক্টোবরের হরতাল ব্যর্থ হয়।১০ সংবাদ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২সংবাদ, ২ মার্চ ১৯৭২। রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জির জন্য পরিশিষ্ট ৯ পড়ুন অনেকে মনে করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা দেখা দেওয়া ছিল স্বাভাবিক। গঠনমূলক সমালােচনার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হত বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ভুখা মিছিল করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করাটা ছিল ‘ভিলেজ পলিটিক্সসুলভ অনৈতিক কাজ।

ভাসানী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ১৪ পড়ুন। ১৩ ভারতীয় সৈন্য নির্ধারিত সময়ে আগেই ২৫ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশ ত্যাগ করে * বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ২৩ মে ১৯৭৩ ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এদিন শন্তির জন্য সংগ্রাম-এর স্বীকৃতিস্বরূপ মুজিবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলিওকুরী পদক’ প্রদান করা হয় * মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৮৩। এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৫ সালে দুঃখজনকভাবে চীন ও রুশ পন্থি হিসেবে বিভক্ত হয়ে যায়। পরেও চীনপন্থিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হওয়া অব্যাহত রাখেন। তবে প্রায় সকলই তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চ বা আশ্রয় হিসেবে ভাসানী ন্যাপ ও ভাসানীকে ব্যবহার করেন। এদের আন্তঃউপদলীয় দ্বন্দ্বের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৪ ন্যাপের (ভাসানী) কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিলের মধ্য দিয়ে। এসব দ্বন্দ্ব-কলহে মাওবাদী মাওলানা এতই বিরক্ত হন যে, ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি হুকুমতে রাব্বানী পার্টি’ নামে একটি দক্ষিণ পন্থি’ দল গঠন করে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতে নিজেকে নিয়ােজিত করেন। ভিয়েতনাম সংহতি ও ছাত্রহত্যা বাহাত্তরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিয়েতনামে ব্যাপক হারে বােমা বর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেদিন ঢাকার তােপখানা রােডে অবস্থিত মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক হাজার কর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং তােপখানা রােডের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে ঘৃণ্য মার্কিন তথ্যকেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা জঙ্গীরূপ ধারণ করে আর অসহিষ্ণু পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ছাত্রনেতা মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদের নিহত এবং পরাগ মাহবুব সহ ৭ জন আহত হয়।  স্বাধীন বাংলাদেশে সংগঠিত প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনা মুহূর্তে শহরে ছড়িয়ে পড়ে ও সর্বস্তরে আলােড়ন সৃষ্টি করে। সচিবালয় থেকে সরকারি কর্মচারিরা দল বেঁধে রাজপথে নেমে এসে ছাত্র-জনতার সাথে যােগ দিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। শহীদের লাশ নিয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে চারদিক থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যােগ দেয়। মিছিল যত সামনে অগ্রসর হয়, ততই দীর্ঘ হয়। সারা শহর বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়। সরকারি দৈনিক বাংলাও বিকেলে বিশেষ টেলিগ্রাম বের করে ।

১৬ এ সময় দলের সভাপতি ছিলেন ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী জাফর। ৪ মার্চ দলের। নতুন কমিটি গঠিত হয় এবং দালাল মশিউর রহমান যাদু মিয়া এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘টেলিগ্রাম’ বের করার অপরাধে দৈনিক বাংলার সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ও বার্তা সম্পাদক আবু তােয়াব খান তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারিত হন। পরে তারা যথাক্রমে মস্কোতে বাংলাদেশের দূতাবাসের প্রেস সচিব ও ঢাকায় প্রধানমন্ত্রির প্রেস সচিব নিযুক্ত হন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান শােক-বাণী প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। | শহর প্রদক্ষিণ শেষে লাশ-সমেত বিক্ষোভ মিছিল পল্টন ময়দানে এসে পৌছলে স্বতস্ফূর্ত জনসমাবেশে প্রদত্ত এক ভাষণে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ও ডাকসু সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শেখ মুজিবের ডাকসুর সদস্যপদ বাতিল ঘােষণা করে তা ছিড়ে ফেলেন। পরদিন সারাদেশে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়।  মুজিবের ডাকসুর সদস্যপদ বাতিল করা ও খুনী মুজিব গদী ছাড়, ফাঁসি চাই’ প্রভৃতি স্লোগান আওয়ামী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়। ৫ জানুয়ারি ঢাকা সহ সারা দেশে ন্যাপ (মােজাফফর), ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু অফিসে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযােগ করা হয় এবং কোথাও কোথাও দখল করা হয়। ঢাকায় অফিসে অবস্থানরত তকালীন ন্যাপ নেত্রী অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে লাঞ্ছিত করা হয়। দেশের সর্বত্র ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করা হয়। এ হামলা মােকাবেলার প্রয়ােজনীয় শক্তি বামপন্থিদের ছিল না। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দুর্বল ও সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্র সফলতা লাভ করার আশঙ্কায় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ প্রমুখের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তাবও বাতিল করে দেয়া হয়। উল্টো আওয়ামী লীগ ১০ জানুয়ারী প্রতিরােধ দিবস’ হিসেবে পল্টনে জনসভা করে এবং ৩০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তি, গুপ্তহত্যা ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার অভিপ্রায়ে সারাদেশে সরকারি হরতাল পালন করে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত বীর ভিয়েতনামীদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য আয়ােজিত বিক্ষোভ-সমাবেশের প্রধান দুটি দাবিই মতিউল-কাদেরের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়। অচিরেই তােপখানা রােড থেকে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র (ইউএসআইসি) সরিয়ে নেয়া হয়, ১ আগস্ট বাংলাদেশ ভিয়েতনামের বিপ্লবী১৮  অবশেষে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৩ মতান্তরে ২১ মার্চ ১৯৭৪ বিচারপতি নুরুল হুদার নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কমিশনের রিপাের্ট সুপারিশ প্রকাশ এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি কোন উদ্যোগের কথা জানা যায় নি। ১৯ ১৬ মার্চ ১৯৭২ শেখ মুজিবকে ডাকসু কর্তৃক এর আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়। তখন এর সহ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদুস মাখন ২০ স্বাধীন দেশে সরকার বিরােধী এই আন্দোলনে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি যথাযথভাবে পরিচালনার ব্যর্থতায় উদীয়মান বামপন্থি বিকল্প শক্তির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে ২৯ সংবাদ, ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭৩ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং ঢাকা-হ্যানয় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া সংবিধান রচনা ও নির্বাচন স্বল্পায়ু মুজিব-সরকারের সবচেয়ে বড় কীর্তি জনগণকে রক্তে লেখা’ সংবিধান উপহার। দান। সংবিধান-রচনায় পাকিস্তানিদের লেগেছিল ৯ বছর এবং বাঙালিদের ৯ মাস। হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন কাঠামােতে ইতােপূর্বে কয়েকবার স্বাধীন সত্তায় আসলেও এই প্রথম বাঙালির ইতিহাসে সংবিধান রচিত হল। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে ‘গণপরিষদ” এটি রচনা করে। এরশাদের উপ-রাষ্ট্রপতি ও বিএনপি সরকারের বর্তমান আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ-প্রসঙ্গে বলেন : মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। এটি ছিল একটি ব্যাপক, সুলিখিত দলিল এবং এই উপমহাদেশের অন্যান্য সংবিধানের তুলনায় উন্নতমানের। কিন্তু রচনার চেয়েও কঠিন কাজ ছিল একে বাস্তবে রূপ দেয়া, যা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ৪র্থ থেকে শুরু করে পরবর্তী সংশােধনীসমূহ (১৯৯১’র সংশােধনী ব্যতীত) এর মৌল চরিত্র বদলে দিয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে তৎকালীন বিরােধীদলীয় (ন্যাপ) একমাত্র গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এতে স্বাক্ষর করেননি। আর এখন ১৯৭২ সালের সেই সংবিধান ফেরত পাওয়ার জন্য, জনগণ ১৯৭৫ থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

কী বিচিত্র এ দেশ! বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বেশি ভােট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার বাসনা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে জাসদ ২টি, জাতীয় লীগ ১টি, স্বতন্ত্র ৬টি এবং অবশিষ্ট সব আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে।২২.  ২৯ এপ্রিল ১৯৭২ মুজিব ভিয়েতনাম থেকে বিদেশী সৈন্য অপসারণের আহ্বান জানান এবং ১৪ মে ১৯৭২ আওয়ামী লীগ ঢাকায় এক প্রতিবাদ সভায় ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানায়। তাছাড়া বাংলাদেশ কোন প্রকার আন্তর্জাতিক জোটেই যােগদান করবেনা বললেও নির্জোট আন্দোলনে (NAM) যােগ দিয়ে কার্যত: সম্রাজ্যবাদ বিরােধী শিবিরে অবস্থান নেয় ও ২৩.  ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তানের ১৬৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম এন এ) ও পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এম পি এ) গণের মধ্যে দালালির অভিযােগে অভিযুক্ত ও নিহতদের বাদ দিয়ে ৪০৩ জনকে নিয়ে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ রাষ্ট্রপতির অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বলে গণরিষদ’ গঠন করা হয়। এর সদস্যগণের (এম সি এ) মধ্য থেকে ড, কামাল হােসেনের নেতৃত্বে ৩৪-সদস্যের একটি খসড়া সংবিধান কমিটি গঠন করা হয় । ১২ অক্টোবর গণপরিষদে এর খসড়া উত্থাপিত হয়। সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে ৪ নভেম্বর তা গৃহীত হয়। ১৪ ডিসেম্বর সদস্যগণ এতে স্বাক্ষর দান করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা বলবৎ ২৪. মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ শেখ মুজিবের শাসনকাল, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ১৬১ নির্বাচনের পূর্বে ১০ ফেব্রুয়ারি সকল জেলার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের ঢাকায় ডেকে এনে শেখ মুজিব ‘নির্বাচনে সরকারি ও বিরােধীদলের মধ্যে কোনাে বৈষম্য না-করার আহ্বান জানান। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার এই সদিচ্ছার মূল্য দেয়নি। মনােনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন থেকেই তারা বিরােধীদলের প্রতি বিরূপ আচরণ ও স্থানে স্থানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। শেখ মুজিব ৪টির মধ্যে ২টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অনেক আওয়ামী নেতা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে বিশেষ মর্যাদা অর্জনের প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হন। মাগুরার সােহরাব হােসেন, ফরিদপুরের কে এম ওবায়দুর রহমান, ভােলার তােফায়েল আহমদ এবং মােতাহার উদ্দিন বিরােধী প্রার্থীদের মনােনয়নপত্র জমা দিতেই। দেননি।

রাজশাহীর এইচ এম কামারুজ্জামান, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঞা, কিশােরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান ও মনােরঞ্জন ধর বিরােধীপ্রার্থীদের মনােনয়নপত্র প্রত্যহারে বাধ্য করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অপর দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টিকেও আওয়ামী লীগ মুজিবের সম্মানহানি হিসেবে বিবেচনা করে।  আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও যারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেননি, তারা । ‘বেশী ভােট পেয়ে তাদের জনপ্রিয়তা প্রদর্শনের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হন। মুন্সিগঞ্জের শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন মােট ১ লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬ শত ও ঢাকার গাজী গােলাম মােস্তফা ১ লাখ ৬২ হাজারের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ভােট পান। শেখ মুজিব পাশের আসনে গাজী’র থেকে কম ভােট (১ লাখ ৫ হাজার) পান। এতেও মুজিবের সম্মানহানি’ বিবেচনা করে তার প্রাপ্ত ভােট বাড়িয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ঘােষণা করা হয়! পরাজিত হয়েও নির্বাচিত টাঙ্গাইলের মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভাসানী ন্যাপের ড. আলীম আল রাজীর কাছে, সুনামগঞ্জের মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ন্যাপের (মাে.) সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে, বরিশালে হরনাথ বাইন ও আবদুল মান্নান জাসদের মেজর জলিলের কাছে (২টি আসনে), নূরুল ইসলাম মঞ্জুর রাশেদ খান মেননের কাছে , ক্যাপ্টেন সুজাত আলী অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের কাছে পরাজিত হয়েও জয়ী ঘােষিত হয়েছেন বলে। দেশবাসী মনে করে। চট্টগ্রামে ন্যাপের প্রার্থী মােশতাক আহমদ চৌধুরীকে। বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘােষণা করেও পরে ১০ মার্চ বেতারে পরাজিত ঘােষণা করা হয়। ১০ মার্চ ১৯৭৩ ফরিদপুরে ন্যাপের প্রার্থীসহ ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্বাচন ভাষ্যকার ও গবেষকরা মনে করেন, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ। নির্বাচনে তৎকালীন কোনাে রাজনৈতিক দলেরই আওয়ামী লীগকে মােকাবেলা করার ক্ষমতা ছিল না। তারপরেও আওয়ামী লীগের বহু নেতা ও কর্মীই নির্বাচনে অনিয়মের।

২৫ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩ আশ্রয় নেয়। অন্তত ১৫টি আসনের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিপর্যকর, যেখানে সরকারি দলের কর্মিরা সন্ত্রাস, পুলিং এজেন্ট অপহরণ এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। নির্বাচনােত্তর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ড. আলীম আল-রাজী বলেন, সরকারি দলের কোন কোন বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে প্রতি ১৮ সেকেণ্ডে একটি ভোেট পড়েছে যা বাস্তবে সম্ভব নয়।  ন্যাপপ্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, সুষ্ঠভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সকল বিরােধীদল মিলে ৫০টির মতাে আসন লাভ করত। অবজারভারের এক প্রতিবেদন মতে, বিরােধীদলকে কমপক্ষে ৩০টি আসন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিরােধীদলের দাবি পর্যালােচনা করে বলা যায়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে পারত। অন্যদিকে সংসদে একটি দায়িত্বশীল বিরােধীদল থাকলে সরকার, দেশ ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকত। আওয়ামী লীগ দেশকে নিজেদের ‘তালুক’ মনে করে যথেচ্ছাচার করায় নির্বাচনের বিশ্বাসযােগ্যতা নষ্ট হয় । আসন বাড়াতে গিয়ে আস্থা হারা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী জানাচ্ছেন, শেখ মুজিব লন্ডনে তাকে বলেছিলেন যে, বিরােধী দলগুলাে যদি ১০০টি আসন পেত তাহলে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা অনেক কম হত।” খুবই সত্য কথা, কিন্তু নির্বাচনের পূর্বাপর ঘটনা এ-কথার সঙ্গে মেলে না। বরং কারও কারও ধারণা বিরােধীদলসমূহকে গুনে গুনে ৯টি আসন দেয়া হয়েছে। ১০টি আসন পেয়ে যেন তারা সংসদে বিরােধীদল গঠন না করতে পারে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনসংখ্যা বাড়াতে গিয়ে জনগণের আস্থা ও ভালােবাসা হারিয়েছে। বলা চলে এর মাধ্যমেই শুরু হয় জনবিচ্ছিন্নতা।” এ-প্রসঙ্গে কাজী ফজলুর রহমান বলছেন : আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জিতেছে।… কিন্তু যে অল্প কটি আসনে না-জেতার সামান্য সম্ভাবনাও ছিল, সেগুলােও দখল করেছে ছলে বলে কৌশলে ।…

ঠিকমতাে ২৫ তথ্যপঞ্জি নির্বাচন রিপাের্টিং, সেড, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৯৭ ২” সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী (প্রথম খণ্ড), ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪৮১ ২৮ নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদন-১৯৭৩, সাপ্তাহিক ‘নতুন বাংলা’র ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বিভিন্ন সংখ্যা, বাংলাদেশ অবজারভার ৯ মার্চ, এবং সংবাদ ৮-১৫ মার্চ ১৯৭৩ তিন বিশিষ্ট জনের (আনিসুজ্জামান, মাে. মুজিবুল হক, ফারুক চৌধুরী) একান্ত আলােচনা, প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০২ মাত্র দু’আড়াই মাস পর জুনে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে ‘অপরাজেয়’ আওয়ামী লীগ সিলেট ও রাজশাহীতে ২টি আসনে পরাজিত হয় এবং অন্যান্য আসনে জয়ী হলেও মার্চের তুলনায় কম ভােট পায় (ঢাকায় এক আসনে মার্চে ৯৩,৫৮১ ভােটের স্থলে জুনে পায় ৩৯,২১৫ ভােট)। মার্চে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত রাজশহীর আসনে জুনে ৮ হাজার ভােটের ব্যবধানে হারে। দ্রষ্টব্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮৩-৮৪নির্বাচন হলেও সরকারি দল বড়জোর ২০টি আসন হারাত। কিন্তু সেটাও এদের কেন সইল না … যে অবাঞ্ছিত একটা প্রিসিডেন্ট হল বিনা প্রয়ােজনে এই নির্বাচনী কারচুপিতে, তা ভবিষ্যতে দেশের জন্য শুভ হতে পারে না। বিষয়টা সাধারণ মানুষও জানে এবং নিম্নকণ্ঠে হলেও বলাবলি করছে। দেশের লােক আওয়ামী লীগকে বা তাদের মনােনীত প্রার্থীদের ভােট দেয়নি। দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সবাই জানে এখন দেশে তার কোনাে বিকল্প নেই। বর্তমানে শাসনযন্ত্রের অক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কথা জেনেশুনেই তবু মানুষ শেখ সাহেবকে ভােট দিয়েছে। তাকে দেশগড়ার জন্য আবার সুযােগ দিয়েছে। তবে পার্শ্বচরদের কবলমুক্ত হয়ে তিনি কি এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন? চারদিকে যে চাপা অসন্তোষ ধুমায়িত হচ্ছে, তা যদি শক্তহাতে দূর না করা যায় তবে হয়তাে বছর দুইয়ের মাঝেই তাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দেবে। আর এমনটি হলে সেই আগুনে আমরা সবাই ভস্মীভূত হব।” কিন্তু এসব কথায় কান দেয়ার লােক তখন ছিল না। থাকলে এসব ঘটতে পারত । অন্তত ঘটে যাওয়ার পরও সংশােধনের চেষ্টা হত। পুনরাবৃত্তি রােধ করা হত। আর কী আশ্চর্য, দুই-আড়াই বছরের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডে মুজিব, তাঁর পরিবার, তাঁর আশা, তার আদর্শ সব ভস্মীভূত হল।

বাস্তব অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়! গণঐক্যজোট স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টি (মণিসিংহ) ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের একাংশের বিরােধীতার কারণে এটি যথার্থ ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথমে অধ্যাপক মােজাফফর ও পরে মাওলানা ভাসানীর জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও একই কারণে গ্রহণ করা হয়নি। ইতােমধ্যে কংগ্রেসের প্রধানব্যক্তি মনােরঞ্জন ধর আওয়ামী লীগে যােগ দেন এবং মাওলানা ভাসানী সরকার বিরােধী আন্দোলনে আত্মনিয়ােগ করেন। অন্যদিকে ভিয়েতনাম সংহতি দিবসে ছাত্র-হত্যাকে কেন্দ্র করে ন্যাপ (মােজাফফর)-কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সরকার তথা আওয়ামী লীগের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে’ এই দুরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ গণভবনে শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উক্ত তিনদল একযাগে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ৩১.  কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি-দিনলিপি : ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ১২ জুলাই ২০০২করে। এই পটভূমিতে ১৪ অক্টোবর ১৯৭৩ ত্রিদলীয় গণঐক্যজোট’ গঠিত হয়। | ইতােপূর্বে ১৩ জুন ১৯৭৩ গণঐক্যজোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ঢাকা শহরে অবৈধ রেশনকার্ড উদ্ধার সহ বিভিন্ন যৌথ কর্যক্রমের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা আশানুরূপ সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নানা সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার ক্রমেই ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে সরকার বিরােধী মনােভাবের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য গণসংগঠনসমূহের ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় মানুষ এদেকে সরকারের ‘বি-টিম’ হিসেবে গণ্য করে এবং এদের জনপ্রিয়তা ও দ্রুত হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় গঠিত গণঐক্যজোট মানুষের মধ্যে কোন আশার আলাে দেখাতে ব্যর্থ হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে এ জোট রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনরূপ ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় নি।

উপরন্তু একে মানুষ পরে গঠিত ‘বাকশালের’ ক্রন হিসেবে আখ্যায়িত করে।৩২. ১৯৬১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কয়েকটি (৪টি) গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যৌথভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এসব সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব, তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), মণিসিহ ও থােকা রায় এবং সমন্বয়কারী হিসেবে সাংবাদিক জহুর হােসেন চৌধুরী সভাসমূহে উপস্থিত ছিলেন। তখন ঢাকায় অবস্থানকারী শহীদ সােহ্রাওয়ার্দীও পরােক্ষভাবে আলােচনায় অংশ নেন। শেখ মুজিব কর্মসূচিতে ‘পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ‘কৌশলগত কারণে তা গৃহীত হয়নি। বিস্তারিত আলােচনার পর নিম্নরূপ রূপরেখা ও কর্মসূচি গৃহীত হয় ১ পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকার গঠন, ২ পূর্ববঙ্গের জন্য স্বায়ত্বশাসন, ৩ পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রথা বাতিল করে সেখানকার জাতিসমূহের জন্য স্বায়ত্বশাসন, ৪ রাজবন্দিদের মুক্তি, ৫ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ৬ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, ৭ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অবলম্বন। রূপরেখায় নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কথাও বলা হয়। (দ্রষ্টব্য : বজলুর রহমান, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন : নেপথ্য প্রস্তুতি, একটি ঐতিহাসিক বেঠক ; সাপ্তাহিক একতা, ১৯ আগস্ট ১৯৮৮; খােকা রায়, সংগ্রামের তিন দশক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮২-৮৩; রাজনৈতিক রিপেটি, প্রথম কংগ্রস, পূর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৫১ – ৫২। গণঐক্যজোট গঠনের লক্ষ্যে গণভবনে ত্রিদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের দিন (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হয়। পরাজয়ের আশাতক্ষায় সরকার-সমর্থকরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন ভন্ডুল করে দেয়-এ থেকে ও সরকার ও সরকার সমর্থক জোটের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে। একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় ওআইসি সম্মেলন ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনীতিতে ধর্মের সংমিশ্রণ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ তিক্ত।

স্বাধীনতার পর প্রথম সুযােগেই সরকার সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এ-সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে বিশিষ্ট লেখক ইকবাল সিং ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ ‘স্যোসালিস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লেখেন : বাংলাদেশের আবির্ভাব মৌলবাদী শক্তিসমূহের উপর একটা চরম আঘাত হিসাবে এসেছে এবং সংস্কার-আন্দোলনের ফলে একটা নতুন বেগ সৃষ্টি হবে।… প্রথমবার এই উপমহাদেশের ইতিহাসে অবস্থার এমন গুণগত পরিবর্তন এসেছে যে, পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামাে বাংলাদেশ, ভারত, এমনকি পকিস্তানের সমাজকেও একটা মৌলিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য মুজিবও আশা করেছিলেন ধর্মীয় ইস্যুতে সৃষ্ট ও বিবদমান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ একটি প্রাবর-রাষ্ট্র (Buffer State) হিসেবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড স্বরূপ অবস্থান করবে। কিন্তু এদের আশা ফলবতী হয়নি। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষগতার নীতি পরিত্যক্ত হয়েছে। ভারতে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত থাকলেও কার্যত: সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের শাসকচক্র ধর্মাচারী (Ritualist) না হলেও সেখানে জনমনে ধর্মীয় বুদ সৃষ্টির চেষ্টা ক্রমবর্ধমান।  ব্যক্তিগত জীবনে মুজিব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু প্রাত্যাহিক জীবনে নিষ্ঠধর্মাচারী বলতে যা বুঝায়, বাঙালির অধিকাংশই তা নয়, মুজিবও ছিলেন না। কথিত আছে, প্রায় চারশ বছর পূর্বে মুজিবের পূর্বপুরুষ (উর্ধ্বতন ৭ম পুরুষ) শেখ আওয়াল ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করেন। শেখ আওয়ালের পুত্র শেখ জহিরুদ্দিন ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে জীবিকার্জনে ব্যবসা শুরু করেন। ক্রমে তারা স্থানীয়দের সাথে ‘এক দেহে লীন হয়ে বাঙালি (মুসলমান) পরিচিতি লাভ করেন। মূলত মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ ও তরুণ সদস্যরা ভারতবিভাগের পর পাকিস্তানের। শুরুর দিকে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। কয়েক বছর পর ১৯৫৫ সালে মুসলিম’ শব্দ বিলােপ করে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু সকল সদস্যই রূপান্তরিত হয়েছেন এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এদের অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম লীগারদের থেকে ভিন্ন ছিল না, যদিও মুখে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বলতেন। তাছাড়া রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করা, কোনাে নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃষ্ঠপােষকতা না করে সকল ব্যক্তিকে তার নিজ ধর্ম পালনে কোনাে বাধা সৃষ্টি না-করার ‘নিরপেক্ষতার নীতি জনসাধারণ্যে প্রচার করে। ৩৪ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৩ ৩৫.  সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়নি। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে কৃত শত্রুপক্ষের অপপ্রচার জনপ্রিয় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জনৈক মুহিত মজুমদারের বরাতে এ এল খতিব বলেন : আওয়ামী লীগের মাঝে কিছু চরম ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি দর্শন হিসেবে রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী ধর্ম পালনের যে বৈধ অধিকার রয়েছে তার পার্থক্য অনুধাবনে ব্যর্থ হন।

সরকারি ছুটির তালিকা থেকে আশুরা বাদ দেওয়া হয় ও নতুন প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে নবান্ন উৎসবের ছুটি (১৭ ডিসেম্বর) ঘােষণা করা হয়। পরে মুজিব ছুটির তালিকায় নবান্ন দিবস বাতিল করেন এবং আশুরা দিবস যুক্ত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই (১৫ জানুয়ারি ১৯৭২) মুজিব সরকারি অনুষ্ঠানে মদপান নিষিদ্ধ করেন। পরে ১৬ এপ্রিল সমগ্র দেশে মদপান ও ঘােড়দৌড় ক্রীড়া নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন (ঘােড়া দৌড়ের সাথে জুয়াখেলার প্রচলন ছিল)। মদ, জুয়া প্রভৃতি বাংলাদেশে ধর্মীয়, নৈতিকতা এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও অসমর্থিত। স্বাধীনতার প্রথম বছরে বাংলাদেশ বিদেশে ২২টি মিশন স্থাপন করে। ৯৮টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, ঢাকায় ২৮টি কুটনৈতিক মিশন স্থাপিত হয়। জাতিসংঘের ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ বাংলাদেশ লাভ করে।” এ সাফল্য সহজে অর্জিত হয়নি। জাতিসংঘের সদস্যপদ তখনও পাওয়া যায়নি। এ পথে প্রধান বাধা পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সৌদি আরবও ওআইসিতে পাকিস্তানের ঘনিষ্ট বন্ধু । পাকিস্তানের সঙ্গে অনেকগুলাে সমস্যার সমাধান করা প্রয়ােজন। আটকে-পড়া বাঙালি ও ‘বিহারীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানাে, যুদ্ধবন্দিদের ফেরৎ পাঠানাে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সম্পদের হিস্যা, সর্বোপরি স্বীকৃতি। মুজিব উপযুক্ত সমস্যাসমূহ সমাধানে ওআইসির ভূমিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ লাহােরে অনুষ্ঠেয় এর শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ইতােমধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। দানকারীসহ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনুরােধ জানায়। এ সবকিছুর ফলে সম্মেলনের আগের দিন পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয় এবং এই স্বীকৃতিকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য তাদের সংবিধান সংশােধন করে। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হােয়ারি বােমেদীন ঢাকায় যাত্রাবিরতি করে মুজিবকে সাথে নিয়ে সম্মেলনে যান। মুজিবের উপস্থিতি ও ভাষণকে সকলে আন্তরিক স্বাগত জানান। তার ব্যক্তিত্ব রাজা-বাদশাসহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফেরার পথে৩৬ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১২সরদার আমজাদ হােসেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সঙ্কটকালে তৎকালীন সংসদ সদস্যদের আনুগত্য। (নিবন্ধ), দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা, ১৫ আগস্ট ২০০৩ মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত বাংলাদেশ সফর করেন। ইরান ও তুরস্ক এ সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।  ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘ ১৩৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে (এবার আর চীন ভেটো প্রয়ােগ করেনি।

তবে সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি মুজিবের মৃত্যুর পূর্বে পাওয়া যায়নি। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সৌদি আরব ও সুদান এবং ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ ঘটনাকে কেউ কেউ বলেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে আসার পুরস্কার। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিতের মতে : কালক্রমে বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয় এক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিব নিজেই, যখন তিনি ১৯৭৪ সালে লাহাের গমন করেছিলেন ইসলামী সংহতি শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্য। কিছুদিন পরই (মার্চ মাসে) বেআইনি মুসলিম লীগের প্রাক্তন নেতা আবুল হাশিম ওআইসি সম্মেলনে যােগ দেওয়ায় মুজিবকে অভিনন্দিত করেন এবং অবিলম্বে পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু ও জেল-খাটা দালালদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। একাত্তরের মার্চে ঢাকায় জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘ভুট্টোর বুকে লাথি মারাে-বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ সেই ভুট্টো স্বাধীন বাংলায় বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন পঁচাত্তরের জুনে। দু’এক স্থানে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ স্লোগান ওঠে বলেও শােনা। যায় । মিশর-ইসরাইল যুদ্ধে সমর্থনের নির্দশনস্বরূপ মুজিব মিশরে অক্টোবর, ১৯৭৩ -এ বিমান-ভর্তি (১ লক্ষ পাউন্ড) উৎকৃষ্ট মানের চা পাঠান। যুদ্ধে অর্থ ও অন্ত্রের প্রয়ােজন বেশি হলেও বাংলাদেশের। পক্ষে তা দেয়া সম্ভব ছিলনা। মিশর এ উপহার অত্যন্ত আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৪-এর বসন্তকালে কায়রাের কাছাকাছি (সিনাই) মরুভূমিতে সাজানাে বহুসংখ্যক টি-৫৪ ট্যাঙ্ক থেকে ৩০টি (মতান্তরে ৩২টি) ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে উপহার দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান একদিকে বাংলাদেশের আন্তরিকতার প্রতিদান, অন্যদিকে সদ্য-স্বাধীন দরিদ্র বাংলাদেশকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা। কিন্তু মুজিব এ প্রস্তাবে উৎসাহিত বােধ করেননি। সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে তার চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্ভবত এ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর ও মন্ত্রীবর্গের পরামর্শে তিনি সম্মতি দেন। জুলাই ১৯৭৪-এ ৪০০ রাউন্ড গােলাসহ উক্ত ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে পৌছায়। সামরিক বাহিনীর একমাত্র সাঁজোয়া রেজিমেন্ট ফার্স্ট বেঙ্গল লেন্সার্সের উপ-অধিনায়ক মেজর ফারুক আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলাে গ্রহণ করেন। বহরের ইতােপূর্বের ৩টি ট্যাঙ্কসহ গঠিত ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট ঢাকায় মােতায়েন করা হয়। যদিও ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ট্যাঙ্কযুদ্ধের উপযােগী নয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ট্যাঙ্কযুদ্ধ হয়েছে যশাের, হিলি, কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকায়। সতর্কতাস্বরূপ এগুলাের গােলাবারুদ গােপনে গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ডিপােতে তালাবদ্ধ করে রাখা হলেও সেনাপ্রধানের ঢাকায় ট্যাঙ্ক মােতায়েনের এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই গােলাহীন ট্যাঙ্কের আতঙ্ক সৃষ্টি করে দুষ্ট অফিসাররা ১৯৭৫-এর মধ্য-আগস্টে হত্যা যজ্ঞ ঘটাতে সক্ষম হয় * বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের তালিকার জন্য পরিশিষ্ট ৪ পড়ুন এমাজ উদ্দীন আহমদ, ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমান (নিবন্ধ), দৈনিক । ইনকিলাব, ১৫ আগস্ট ২০০২। কারাে কারাে মতে, ওআইসি সম্মেলনে স্বয়ং মুজিব না গিয়ে প্রতিনিধি পাঠালে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিটা হয়ত অক্ষুন্ন থাকতাে  মুজিবের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তিপ্রাপ্ত দালালেরা সুযােগ পেয়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৭৪-এ অনুষ্ঠিত স্থানীয় সংস্থার (ইউনিয়ন, পৌরসভা) নির্বাচনে বেশকিছু স্থানে এরা নির্বাচিত হয়। এদের সংখ্যা ১০-১৫ শতাংশের বেশি না হলেও এই পুনরুত্থান ছিল অশনি সংকেত। ১৬ এপ্রিল ১৯৭৫ এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সবকিছু ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে পেছনে ঠেসে দিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা পুনরুজ্জীবনের পথ উন্মুক্ত করে।  জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বা প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠলেই পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ইসলাম বিপ্ন জিগির তুলত। এসব কারণে মিশরের বাদশাহ ফারুক বলেছিলেন, মনে হয়, পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পূর্বে ইসলাম বলতে কিছু ছিল না। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশেও তাদের দালালরা গােপনে গােপনে এই একই আওয়াজ তুলছিল। কিসিঞ্জারের আগমন ; তাজউদ্দিনের নির্গমন যুদ্ধের ক্ষত সেরে উঠার আগেই বাংলাদেশ আক্রান্ত হয় স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ বন্যায়। বন্যার অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দেয় মহামারী আর দুর্ভিক্ষ। ফলে দেশের দুর্বল অর্থনীতি হয়ে পড়ে আরােও বেহাল। না খেয়ে মরব, তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব না’ বলেছিলেন যে স্বাধীনচেতা অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, সেই তিনিই টানা ৩৭ দিনব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক দেশসমূহ সফরে গিয়ে ঋণ ও সাহায্য প্রার্থনা করে ১৩ অক্টোবর ১৯৭৪ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাজউদ্দিনের জন্য এ ছিল এক। গ্লানিকর কর্তব্য। কিন্তু ভ্রমণ-ক্লান্তি দূর হওয়ার আগেই (২৬ অক্টোবর) ‘প্রিয় নেতা মুজিবের কাছ থেকে তিনি পেলেন এর উক্তৃষ্ট পুরষ্কার’, পদত্যাগের নির্দেশ।৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ওয়াশিংটনে মুজিব-কিসিঞ্জার বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার এক৪১.

এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬৭ অক্টোবর ১৯৭৪ আমেরিকা (জাতিসংঘে) সফর শেষে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে মুজিব ঘােষণা। করেন, সংকট সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু সপ্তাহান্তে ১৩ অক্টোবর ৩৭ দিনের বিভিন্ন দেশ সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাজউদ্দিন সংকটের ভয়াবহতা উপলব্দি করে বলেন, বর্তমান অবস্থা চলতে পারে না। আমরা বালিতে মাথা গোঁজে চলতে পারি না।’ তিনি সর্বদলীয় খাদ্য কমিটি করা ও কারাবন্দি রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির পক্ষেও মত ব্যক্ত করেন। এ কারণেই তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয় বলে মহলবিশেষ মনে করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের মার্চে ঢাকায় গুজব রটেছিল যে, অতিরিক্ত কাজের চাপে মুজিব অসুস্থ। তাই স্বাস্থ্য আর প্রশাসনিক প্রয়ােজনে তাজউদ্দিনকে। পুনঃ প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে মুজিব। বলেন, তারা কি মনে করে যে, আমি সরকার পরিচালনায় অক্ষম?’ এর পর থেকেই মুজিব। তাজউদ্দিনকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন বলে ধারণা করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ বাংলাদেশ ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এর। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য প্রধামন্ত্রী শেখ মুজিব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথেও বৈঠক করেন।মাসের মধ্যে (৩০ অক্টোবর) হেনরি কিসিঞ্জার ১৯ ঘণ্টার সফরে ঢাকা আসেন। এ সর্বজনবিদিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে তাে ছিলই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল তাদের জন্য বড় রকম পরাজয়। মি. কিসিঞ্জার একে তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলেও মনে করেন। এ হেন কিসিঞ্জারের আগমনের তিন দিন আগে তাজউদ্দিনের পদত্যাগকে রাজনৈতিক মহল সরকারের নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী মনে করেন। | তাজউদ্দিন ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহাদ। বুর্জোয়া আওয়ামী পরিবারে সমাজতন্ত্রে আস্থাবান। চলনে-বলনে ধীর, কর্তব্যে নিষ্ঠাবান। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কেউই পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। একমাত্র তাজউদ্দিনই এ প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। প্রবাসে মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা সর্বক্ষেত্রেই তিনি যথার্থ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিনের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলেই মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত সফল সমাপ্তি ঘটেছে। তবে প্রতিপদেই তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।

মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। সকল বাধা চূর্ণ করেই তিনি উন্মোচন করেছেন সফল জগতের লৌহকপাট। দুঃখজনক যে, এসব বাঁধার একটি উল্লেখযােগ্য অংশ এসেছে নিজের দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকেই। যুদ্ধ শুরু ও চলাকালে ব্যর্থ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দিন বিরােধীরা সহজেই সফলকাম হয়।বিশেষ ক্ষমতা আইন, জরুরী অবস্থা, ১৪৪ ধারা। স্বাধীনতার দ্বিতীয় বছরটি (১৯৭৩ খ্রি.) শুরু হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত। ভিয়েতনামীদের প্রতি সংহতি জানাতে আসা দু’জন ছাত্রহত্যা দিয়ে এবং শেষ হয় (২৭ ৪৫. কিসিঞ্জারের এই সফর বাংলাদেশ একটি তলাহীন ঝুড়ি’ উপাখ্যানের জন্ম দেয়। আর বাংলাদেশ এমনই বিচিত্র দেশ যে, এরূপ অপমানজনক মন্তব্য করার পরও বাংলাদেশী রাজনীতিকরা কিসিঞ্জারের সমালােচনা করেন না, বরং সুযােগ পেলেই এই ‘বেদ-বাক্য’ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে উপর দিকে থুথু ফেলে’। হায়! দেশের ভাবমূর্তি জ্ঞান! * স্বাধীন বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র গৃহীত হয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জনের কিছু কর্মসূচিও গৃহীত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শেখ মুজিবের প্রকৃত মনােভাব বুঝার জন্য মার্চ ১৯৭১ -এ অসহযোেগ চলাকালে ‘এজেন্সি-ফ্রান্স-প্রেস’ এর জনৈক প্রতিবেদককে দেয়া বক্তব্য বিবেচনা করা যেতে পারে। মুজিব। বলছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কি এটা জানে না যে, শুধুমাত্র আমি এবং শুধুমাত্র আমিই পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিজমের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। তারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়, আমি ক্ষমতা হারাবাে, আর আমার জায়গা দখল করবে নক্সালপন্থিরা। আমি যদি খুব | বেশী ছাড় দিই তা হলে আমার কর্তৃত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এক কঠিন অবস্থানে রয়েছি।’ (লা ম, ৩১ মার্চ ১৯৭১, উদ্ধৃত : লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, কর্নেল তাহের সংসদ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৪৪) ডিসেম্বর) জামালপুরে নির্বাচনী হাঙ্গামায় পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও ২০ জনের গ্রেফতারের মাধ্যমে। বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন ছাত্র খুন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, জাতীয় বেতন স্কেল ঘােষণা, পাকিস্তানী দালালদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগ প্রভৃতি অন্যতম।

এছাড়া দ্রব্যমূল্য, লুটতরাজ, খুন-খারাবি প্রভৃতির ক্রমবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সরকারি সন্ত্রাস’। বিরােধীদলের অফিস পুড়ানাে, দখল করা, এমনকি স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টুটি চেপে ধরা হয়। বলা যায়, শুধুমাত্র দালাল ছাড়া আর কারও জন্যেই বছরটি সুখকর ছিল না। স্বাধীনতার পর দু’বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জনজীবনের সমস্যা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী) ও অন্যান্য মাওবাদী দলসমূহের সরকার ও সমাজ বিরােধী কার্যকলাপও বেড়ে চলেছে একই তালে। এসব মােকাবেলায় ব্যবস্থাপনাগত ও রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে সরকার দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ৫ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদ বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ পাস করে। এ আইনের বলে জেলা প্রশাসক যে কোন নাগরিককে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে, তাকে বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখতে পারেন। স্বভাবতঃই নিবর্তনমূলক এই আইনের বিরুদ্ধে সরকার-বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এমতাবস্থায় ১৩ জানুয়ারি প্রথমবারের মতাে সরকার। ‘জনজীবনে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা অটুট রাখতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ পর্যন্ত সকল প্রকার সভা, মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।জাসদ এই ঘােষণাকে অমান্য করে ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের। করে। পুলিশ মিছিল থেকে ১১ জনকে গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে তারা পরদিন পুনঃ মিছিল বের করে এবং ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ জানুয়ারি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও জাসদ প্রতিবাদ মিছিল বের করে। সেদিন রাজশাহীতে সাংসদ৪৬. কাজী ফজলুর রহমানের ভাষায়, মনে হচ্ছে অন্তত সরকারিদলের একটা প্রভাবশালী অংশ চাইছে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে কংগ্রেস সরকার ক্যুনিস্ট আর নকশালীদের দমন করেছে, ঠিক সেভাবেই বিরােধী সকল দলকে খতম করতে। নয়মাস কলকাতা থাকাকালে এই শিক্ষাটা ভালোভাবেই নিয়েছে। তবে এখানে পশ্চিমবঙ্গের মতাে এত সহজ হবে বলে মনে হয় না।’ দ্রষ্টব্য প্রথম আলাে, ১২ জুলাই ২০০২ নিবর্তনমূলক এই আইনটি প্রণয়নের জন্য সকল মহল থেকে আওয়ামী লীগের সমালােচনা করা হয়। গত ২৯ বছরের মধ্যে সাড়ে ২৩ বছর অ-আওয়ামী সরকার ক্ষতায় থাকলেও কেউই তা বাতিল করেনি বরং প্রয়ােগ করেছে, করছে ১৮-২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। শহরে ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় কী করে তা সম্ভব হলাে? এমতাবস্থায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল দলের জনবিচ্ছিন্নতা নয় কী?

মইনুদ্দীন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মিছিল থেকে ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ৮ মার্চ ১৯৭৪ জাসদ ঢাকায় এক সমাবেশের আয়ােজন করে ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের ১৫ দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানায় এবং প্রদত্ত সময়সীমার মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় আন্দোলনকে জঙ্গী রূপ দিয়ে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির বাসভবন আক্রমণ করে। সেখানে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সাথে গােলাগুলিতে ৮ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। এই সূত্রে ২৩ মার্চ রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযােগে জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় জেলা শহরগুলােতেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ফলে ২৪ এপ্রিল ১৯৭৪ দুনীতি, চোরাচালান, সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনীকে তলব কর হয়। একই সাথে সবরকম ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল বেআইনি ঘােষণা করা হয়। ২৬ এপ্রিল ঢাকা, খুলনা, রংপুর ও সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২৯ এপ্রিল সামরিক ও বেসামরিক যৌথ অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এদিন কুমিল্লায় রাজনৈতিক নেতাসহ ৬০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ জুন মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও অলি আহাদকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুলাই চট্টগ্রামে ন্যাপ নেতা গােলাম কবিরকে গ্রেফতার করাহয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ও ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাসদের জনসভায় যথাক্রমে রাজবন্দিদের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগসহ ১৬ দফা দাবি পেশ করা হয়। ২৩ নভেম্বর শাজাহান সিরাজ ও নূরে আলম জিকুকে গ্রেফতার করা হয়।  ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সমাজ বিরােধীদের কার্যকলাপের কারণে সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করা হয়। ধর্মঘট, লকআউট, জনসমাবেশসহ মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘােষণা করা হয়। ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৫ গণকণ্ঠ কার্যালয় “সিজ’ করা হয়। বাকশাল মে মাসের মাঝামাঝি পিকিং -এ চৌএন লাই-ভূট্টো এবং দিল্লিতে মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থ ছাড়াও মহাদেশীয় রাজনৈতিক অবস্থা গুরুত্ব পায়। এসময় ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতি সংকটাভিমুখী। ভারত সফরের পর বিভিন্ন আলােচনায় মুজিবকে প্রশাসনিক গণতন্ত্র’ ও ‘রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র এ দুটি নতুন রাজনৈতিক পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। চুয়াত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি চালু করার পক্ষে প্রচারণা চালানাে হয়। এই লক্ষ্যে আমেরিকা, ফ্রান্স, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশের দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৯-২১ জানুয়ারি, ১৯৭৪।

ক্রমেই সরকারের দমনকার্য বৃদ্ধি পায় এবং ২৮ জানুয়ারি রক্ষীবাহিনীকে বিনা পরােয়ানায় সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়।সাংবিধানিক মডেল পরীক্ষা করেও দেখা হয়। নভেম্বরের আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এক সভায় সাংবিধানিক পরিবর্তন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে মুজিব জানান যে, তার প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে যদি সংসদীয় দলে বিরােধিতা উত্থাপিত হয়, তবে জনগণের সঠিক রায় নেবার জন্য এর উপর গণভােট গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। সময়ের সাথে সাথে নাশকতামূলক কাজ বেড়ে চলে এবং ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার এক পর্যায়ে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল পাস হয়। এ সংশােধনীতে সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার কায়েম ছাড়াও অনেক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এর অন্যতম হচ্ছে, একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের বিধান এবং এ বিধান অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (BKSALবাকশাল) গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশােধনীর আওতায় শেখ মুজিব সাংসদদের ভােটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এবং তার প্রধানমন্ত্রীর শূন্য পদে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী নিযুক্ত হন। এঁরাই যথাক্রমে বাকশালের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক হন। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক হন সম্পাদক এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুল মালেক উকিল, মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, শ্রী মনােরঞ্জন ধর, ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, শেখ আব্দুল আজিজ ও গাজী গােলাম মােস্তফাকে নিয়ে ১৫ সদস্যের কার্যানিবাহী কমিটিসহ ১১৫ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি মনােনীত করা হয়। সকল আওয়ামী লীগ সদস্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাকশালের সদস্য হওয়ার অধিকারী ছিলেন। আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়াদের মধ্যে আতাউর রহমান খান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, সং প্রু শাইন, মােহাম্মদ ফরহাদ ও অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ অন্যতম। মওলানা ভাসানী বাকশালে যােগ দেননি। তবে তা গঠনের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাগমারীতে (টাঙ্গাইল) অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মুজিব-ভাসানী উভয়েরই বক্তৃতা করা, বিশেষ করে ভাসানী কর্তৃক মুজিবকে দোয়া করে বক্তৃতা করায় সকলেই একে তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন হিসেবে গণ্য করেন।

তার এই কুশলী আশীর্বাদ বামপন্থী শক্তিগুলাের বিরােধিতার তীব্রতাকে নমনীয় করে তােলে।  মূল দলের বাইরে বাকশালের ৫টি অঙ্গ সংগঠন গঠন করা হয় এবং এদের আহবায়ক মনােনীত করা হয় : ১, জাতীয় কৃষক লীগ (ফণিভূষণ মজুমদার) ২. জাতীয় শ্রমিক লীগ (ইউসুফ আলী চৌধুরী) ৩. জাতীয় মহিলা লীগ (সাজেদা চৌধুরী)। ৫” এ এল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯১। সংসদীয় দলের সভার দ্বিতীয় দিন । প্রস্তাবিত পরিবর্তন বিরােধী ১০ জন সাংসদ ওবায়দুর রহমানের বাসায় মিলিত হয়। কিন্তু মুজিবের। সমর্থন ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব নয় বিধায় তারা রণে ভঙ্গ দেয়। ৫ দৈনিক বাংলা, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫  ৪. জাতীয় যুবলীগ (তােফায়েল আহমদ) ৫. জাতীয় ছাত্রলীগ (শেখ শহীদুল ইসলাম)। ৩ আগস্ট ১৯৭৫ বাকশালের জেলা কমিটিসমূহের সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘােষণা করা হয়। কমরেড মােহাম্মদ তােয়াহা ও কাজী জাফর প্রমুখ বাকশালে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদের ১৫ জন ইতােমধ্যে ১২ আগস্ট যােগদানও করেন। ২ জুন ৯টি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, ২৩মে ২২৪ জন সাংবাদিক, ৩ জুন ৩০২ জন সাংবাদিক, ৭ জুলাই মওলানা নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে ৪৯ হাজার মাদ্রাসা শিক্ষক বাকশালের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেন। | বাকশাল গঠনের বিপক্ষে ছিলেন এমন লােকের সংখ্যা আওয়ামী পরিবারে ছিল অতি নগণ্য। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী এক সভায় কেবল জেনারেল ওসমানী ও নূরে আলম সিদ্দিকী এর বিরােধিতা করেন। মুজিবের সামনে দাড়িয়েই ওসমানী বলেছিলেন, ‘আমরা আইয়ুব খানের মতাে কোনাে মুজিবুর খান দেখতে চাই না।’ পরে জাতীয় সংসদে ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন (হিরাে) এর বিরােধীতা করেন। এজন্য তারা সংসদ থেকে পদত্যাগও করেন।  স্বাধীনােত্তর চতুর্মুখী সংকট নিরসনে বাকশাল ছিল শেখ মুজিবের মস্তিষ্কপ্রসূত এক উদ্ভাবন। এর উদ্দেশ্যও কর্মপন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। মুজিবের সমসাময়িক বক্তৃতা থেকে যা জানা যায় তা হল : রাজনীতিবিদ ও আমলাদের। পারস্পরিক সন্দেহ দূর করা, আমলাদের দ্বারা রাজনীতিবিদদের মর্যাদা ক্ষুন্নকরণ বন্ধ করা, সমাজের জ্ঞানী-গুণী ও অন্যধরনের লােকদের সম্পৃক্ত করা। সামরিক, বেসামরিক, সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যতদূর সম্ভব সবাইকে নিয়ে একটি নতুন দল, নতুন System -এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য স্থাপন করা।

তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী সমবায় করা। সকল কর্মক্ষম লােক এর সদস্য হবে। এটি পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা। কৃষকই জমির মালিক থাকবেন। Test relief, works program, সার, টাকা প্রভৃতি ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদের পরিবর্তে তাদের (সমবায়ীদের) নিকট দেয়া হবে। জমির ফসলের একাংশ পাবে জমির মালিক, একাংশ সমবায় সমিতি ও অবশিষ্ট সরকার। বলা হয়, প্রতিটি থানায় একটি প্রশাসনিক কাউন্সিল হবে। রাজনৈতিক কর্মী বা । সরকারি কর্মচারী এর চেয়ারম্যান হবেন। বিভিন্ন বিভাগের সরকারি কর্মচারী, বাকশালের প্রতিনিধি, কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, যুব প্রতিনিধি, ব্যাংক প্রতিনিধি এর সদস্য হবেন। এরাই থানা চালাবে। সব মহকুমা জেলা হবে। প্রত্যেক জেলায় একজন গভর্নর।৫৩.  ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮০ ৫৪. এক ওসমানী ও মইনুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য যথাক্রমে পরিশিষ্ট ১৩ ও ১৫ পড়ন। থাকবেন। সাংসদ, রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী এই গভর্নর হতে পারেন। সেখানে দলের প্রতিনিধি, সাংসদগণ, জনগণের প্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী থাকবেন। এই system চালু হওয়ার পর খারাপ হলে rectify করা হবে। মুজিবের ভাষায় এটাও গণতন্ত্রশােষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভােটাধিকার থাকবে। … এটা। আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লবের অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে।৫৫ প্রশ্ন হচ্ছে, এজন্য বাকশাল করা কী আবশ্যক ছিল? একমাত্র তাজউদ্দিন ছাড়া সকল আওয়ামী নেতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাকশালের সদস্য ছিলেন। অঙ্গুলিয়ে ক’জন ভিন্নদলের নেতা এর কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকার শেষ দিকে স্থান পেলেন। দলের নামও কার্যত ‘আওয়ামী লীগই’ রইল। সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব মাে. মুজিবুল হকের মতে :…চাটার দল ও দুর্নীতির হতাশা…আইন শৃঙ্খলার অবনতি, ১৯৭৪এর খাদ্যাভাবজনিত পরিস্থিতিজাত হতাশা থেকেই বাকশাল হয়েছিল। কিন্তু এসব দুষ্কর্মের হােতারা সকলেই তাে বাকশালে ঠাই পেয়েছিল। মতিউর রহমানের ভাষায়,বাকশালের সর্বস্তরের কমিটিতে স্থান পায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ছিল, বহু অভিযােগ ছিল। এমনকি বাকশালের সর্বোচ্চ কমিটিতে জায়গা পেল খন্দকার মােশতাক আহমদসহ পরিচিত ষড়যন্ত্রকারীরা।” বাকশাল গঠন কী তবে আওয়ামী বিরােধীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল ছিল? তাদের সে সময়কার ‘এক নেতা-এক দেশ, বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ’ স্লোগান থেকে তা-ই প্রতীয়মান হয়।

অথচ স্বাধীনতার পর মুজিবনগর সরকারের দুই উপদেষ্টা অধ্যাপক মােজাফফর ও মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার গঠন করা হলে পরিস্থিতির এরূপ সংকটজনক মোেড় না-ও নিতে পারত।চুয়াত্তরের বন্যা ও দুর্ভিক্ষ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হওয়া সত্ত্বেও নানা ধরনের শােষণের ফলে ‘সােনার বাংলা ক্রমে শ্মশানে পরিণত হয়। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই দেশের জন্য খাদ্য আমাদানী করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর পরই (৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১) খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে চালুকৃত ‘বােনাস ভাউচার ব্যবস্থা বিলােপ করে খাদ্য করপােরেশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০ মার্চ ১৯৭৪ এক প্রেস “ব্রিফিং’-এ খাদ্যমন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার জানান :জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী , ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ হক প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০২ (তিন বিশিষ্টজনের একান্ত আলােচনা)মতিউর রহমান, পনেরাে আগস্ট : পেছনে ফিরে দেখা (নিবন্ধ), প্রথম আলাে ১৬ ও ১৭ আগস্ট ২০০২দেশে এবার খাদ্য ঘাটতির পরিমান ১৭ লক্ষ টন। এটা বার্ষিক ঘাটতি সরকার খাদ্য আমদানী করছেন। সুতরাং দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নেই।” ১৯৭৩-৭৪ বর্ষে বাংলাদেশে ১১৮,২২ লক্ষ টন খাদ্যশ্য উৎপন্ন হয়। ২৯ মে ১৯৭৪ জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন গম সাহায্যের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ ১.৫ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানির পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যেই দেশ পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয় এবং লক্ষ লক্ষ বন্যার্থ মানুষের প্রাণ বাঁচানাের জন্য খাদ্য সচিব ঢাকাস্থ বিদেশী মিশন প্রধানদের কাছে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন জাতিসংঘে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৭ দিন ব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে ঋণ ও সাহায্য লাভের চেষ্টা করেন। জাতিসংঘ তার ৮৬টি সদস্য দেশকে বাংলাদেশের জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহের আহবান জানায়। জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করে এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘের জরুরি খাদ্য সাহায্য প্রাপ্তব্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখিত প্রচেষ্টার ফলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ-তহবিলে ২৫ হাজার ডলার, অষ্ট্রেলিয়া ১৬ লক্ষ টাকার ত্রাণ সামগ্রী, জার্মানী ২.৫ লক্ষ টাকার ত্রাণ সামগ্রী, জাতিসংঘ ত্রাণ অফিস ২০ হাজার ডলার সাহায্য, যুক্তরাষ্ট্র ৪ মিলিয়ন ডলার এককালীন বরাদ্ধ, সােভিয়েত ইউনিয়ন ১৪ হাজার পাউন্ড সাহায্য ও বুলগেরিয়া ৭০ হাজার ডলার ত্রাণ সাহায্য দান করে।

 বাংলাদেশের সাহায্য দাবি বিবেচনার জন্য ২৫ অক্টোবর ১৯৭৪ প্যারিসে বিশ্বব্যাঙ্কের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে ২৭৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত হয়।৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘের মুখপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লক্ষ দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য খাদ্যের প্রয়ােজন ছিল ৫ লক্ষ টন এবং বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার টন খাদ্য প্রেরণের অঙ্গীকার করে। কিন্তু জাহাজের অভাবে তা পাঠাতে বিলম্ব হয়।” এসময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যের আমদানি মূল্যও বেড়ে যায়। অধিকন্তু, আমদানি ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় দুনীতি-স্বজনপ্রীতি, মজুতদারিকালােবাজারি প্রভৃতির জন্য খাদ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। জুন মাসে (১৯৭৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করে।৫৮.  স্বাধীনতার পর প্রাপ্ত খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্যের ফলে ১৯৭২-৭৩ সময়কালে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। ৫৯. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, প্রকাশক আলী আহমেদ,সভাপতি বঙ্গবন্ধু শিক্ষাগােষ্ঠীর ঢাকা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৪ ৬০.  বন্যায় ৩ কোটি লােক আক্রান্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্ঘটনার জন্য পরিশিষ্ট ৮ দেখুন।সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪২১ নভেম্বর ১৯৭৪ প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, সারাদেশে ৫,৭৫৭ টি অন্নসত্রের (লঙ্গরখানা) মাধ্যমে প্রতিদিন ৪২ লক্ষ বন্যার্থকে এক বেলা সামান্য খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২২ নভেম্বর ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে। খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী সাড়ে ২৭ হাজার মানুষ অনাহার ও বাধিতে’ মৃত্যু বরণ করেছে বলে জানান। কিন্তু অনেকেই মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক বলে মনে করেন।

১ জানুয়ারি ১৯৭৫ অঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে তারা ঢাকা শহরে ২ হাজার ৪শ’ ৪৩ টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।  প্রসঙ্গক্রমে, বন্যা ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিবিম্ব হিসেবে সে সময় কাপড়ের অভাবে ‘জাল পরা অবস্থায় রংপুরের জনৈক বাসন্তীর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল হলুদসাংবাদিক গােষ্ঠী কর্তৃক তৈরী’। ঢাকায় তখন চালের মন আড়াইশাে” টাকা। কিন্তু বাজারে চালের কোন অভাব ছিল । টাকা হলে যে কোন পরিমাণ চাল পাওয়া যাচ্ছিল। হাতে টাকা না থাকায় মানুষ খাদ্য কিনে খেতে পায়নি। অর্থাৎ সরকারে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের শিকার হয়।৬২,  সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪২-৪৩৬৩. ১৪ জুন ১৯৭৩ জাতীয় সংসদে পেশকৃত বাজেটে রেশনে চাউল ও গমের দাম প্রতিমন যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ টাকা নির্ধারনের প্রস্তাব করা হয়। একই সালের নভেম্বরে ধান ও চাউলের সরকারি সহ মূল্য যথাক্রমে ৪৫ ও ৭২ টাকা নির্ধারন করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রচারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের উদাহরণস্বরূপ প্রতিমন চালের দাম যথাক্রমে ৫০ ও ২৫টাকা উল্লেখ করা হয়।

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান