You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.23 | শেখের এই মুক্তি মুক্তি নয় | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শেখের এই মুক্তি মুক্তি নয়

বাঘকে খাঁচায় আটকে তার লেজে কান চুলকাবার কেরামতি দেখিয়েছেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। ঠোট বাঁকিয়ে তিনি বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথমে জনগণের ইচ্ছা যাচাই করে দেখবেন ; কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর তাে খুব জনপ্রিয় নন। কে কার সম্পর্কে একথা বলছেন? ভুট্টো সাহেবের মতে যে ভূখণ্ডটা আজও পূর্ব পাকিস্তান, যেখানকার মানুষকে তিনি “ভাই” বলে সম্বােধন করেন সেখানে জুলফিকার আলি ভুট্টো কি জনপ্রিয়? ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ববঙ্গ থেকে কি একটিও আসন জিততে পেরেছিল? ২৫ মার্চের সেই কালাে রাত্রির পর আর কখনই তিনি ঢাকার মাটিতে পা দিতে পারলেন না কেন? আর শুধু পূর্ববঙ্গে কেন, পশ্চিম পাকিস্তানেই বা ভুট্টো সাহেবের জনপ্রিয়তা কতটা? সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বাইরে তাঁকে বা তার দলকে পৌঁছে কে? শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় কিনা, এই প্রশ্ন অবান্তর। পাকিস্তান বলতে আজ যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেখানে। তিনি ভুট্টোর সঙ্গে জনপ্রিয়তার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন নি। প্রশ্নটা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতের নাম করে ভুট্টো সাহেব বাংলাদেশের মানুষের নয়নের মণি, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে রাখছেন কোন অধিকারে? কথায় বলে ছাগলে চাটে বাঘের গাল। সেই দৃশ্যই আমরা যেন দেখছি। ইয়াহিয়া খানের পরিত্যক্ত ফৌজী উর্দিটার উপর গণতন্ত্রের উড়নি চাপিয়ে ভুট্টো সাহেব এখন সাচ্চা পাকিস্তানি সেজেছেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বােম্বাই থেকে ভারতীয় পাসপাের্ট নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে চলে গিয়েও তিনি বােম্বাইয়ে তার সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টায় ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত ভারতীয় আদালতে বলে এসেছেন, তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন নি। অথচ একই সময়ে তিনি নিজেকে ‘মােহাজের’ বলে ঘােষণা করে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে খেসারৎ দাবী করেছেন। এই হচ্ছে লারকানার জমিদারনন্দন জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের নমুনা। এই মানুষই আজ পাকিস্তানের একমাত্র স্বাধীন, সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত বৃহত্তম দলের। নেতার জনপ্রিয়তা নিয়ে পরিহাস করার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন।
বুধবারের খবর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ভুট্টো সাহেব শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা দিতে, তাকে তার নিজের মানুষদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হতে দিতে রাজী নন। কিন্তু ইসলামাবাদের নয়া শাসকদের অন্তত এটুকু সুমতি হয়েছে যে, তারা শেখের বিরুদ্ধে বিচারের প্রহসনটা শেষ করলেন এবং ধরে নেওয়া যায়, তার উপর থেকে অভিযােগগুলি তুলে নিলেন। যাঁকে জঙ্গী শাসকরা ফাঁসিকাষ্ঠে চড়াবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তার জীবনের আশঙ্কাটা অন্তত এখনকার মতাে গেল। ভুট্টো চক্র যে করুণা করে শেখকে জেল থেকে বার করে দিলেন তা মনে করার কারণ নেই। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ও তাদের দালালদের জনতার রােষবহ্নি থেকে বাঁচাবার সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য গ্যারান্টি দিতে পারেন শেখ মুজিবুর রহমান। যে নেতার কথায় বাংলাদেশের মানুষ আগুনের মতাে জ্বলে উঠেছে সেই নেতাই পারেন সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে। এই সহজ ব্যাপারটা ইসলামাবাদের মাথামােটা নেতাদেরও না বােঝার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু তারা বাস্তব অবস্থাটা এখনও সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে প্রস্তুত নন সেহেতু এখনও তারা শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে চড়া দাম আদায় করার আশা করছেন। শেখকে গৃহবন্দী করে রেখে “পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা সমঝােতায় আসা যেতে পারে, এমন একটা ধারণা ছড়িয়ে অথবা চীনের নেতাদের দিয়ে মুজিবের মাথা ঠাণ্ডা করার উদ্ভট কাহিনী রটনা করে পাকিস্তানের শাসকরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষদের মনে একটা সংশয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের অন্যান্য চক্রান্তের মতাে এই চক্রান্তও ব্যর্থ হবে। শেখ স্বাধীন মানুষ হিসাবে তার স্বদেশবাসীদের মধ্যে এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তার নামে প্রচারিত কোন উক্তিকেই পৃথিবীর সৎ মানুষরা যথার্থ বলে ধরে নেবে না, নিতে পারে না।
শেখ মুজিবুর রহমানের এই মুক্তি মুক্তি নয়। তিনি বাংলাদেশের মাটিতে পা না দেওয়া পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের ফৌজদাররা ও তাঁদের দালালরা জামিন থাকবেন, ভুট্টো ও তার অনুচরদের একথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া দরকার।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১