একটি করুণ প্রাণহরণ
বাংলাদেশে পাক হানাদারদের ন-মাস ধরে একটানা ‘মার্সিলেস কিলিং’-এর খবর আসার পর ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে এসেছে একটি মার্সি’ কিলিং-এর খবর। এ-খবরও সকলের মনেকে কম অভিভূত করবে না। কাহিনীটি হচেছ : ওখানকার হাসপাতালের রােগশয্যায় শায়িত এক মা দুরারােগ্য হাঁপানিরােগ আর সহ্য করতে না পেরে তার ছেলেদের বারংবার অনুরােধ করেছিলেন, ঐ অসহ্য যন্ত্রণা থেকে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে। ছেলে দুটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মায়ের পাশে বসে তার ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট দেখেছে আর চোখের জলে ভেসেছে। মার এই যন্ত্রণা তাদেরও আর সহ্য হচ্ছিল না। মার যন্ত্রণার চিরতরে অবসানের জন্য বড়ছেলে অত্যধিক মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মাকে দেয়। কিন্তু তাতেও মার প্রাণ না যাওয়ায় শেষে সে শ্বাসরােধ করে মার মৃত্যু ঘটাবার সিদ্ধান্ত করে। তখন ছােটভাই বলে, এ-কাজের দায়িত্বের সরিকানা সেও দাদার সঙ্গে নিতে চায়। অতঃপর দুইজনে বিছানার চাদর মার গলায় দিয়ে দুদিক থেকে জোরে টেনে ভয়ঙ্কর রােগযন্ত্রণা থেকে চিরতরে তাঁকে মুক্তি দিয়েছে। বলা বাহুল্য নরহত্যার অভিযােগে ছেলে দুটি স্বভাবতই আদালতে অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু ওদের মুখে ঐ করুণ কাহিনী শুনে প্রসিকিউটার ওদের বিরুদ্ধে ঐ নরহত্যার অভিযােগ প্রত্যাহার করে নেন এবং বিচারে করুণা প্রদর্শনের জন্য ওদের অনুরােধ সমর্থন করেন। আদালতে ওদের তিন মাসের কারাদণ্ড হয়েছে, তবে ঐ আদেশ স্থগিত রাখা হয়েছে।
দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে একটি মানুষ দিনের পর দিন ধরে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ভােগ করে চলেছে। চিকিৎসকদের সমস্ত রকম চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যর্থ। তার প্রাণের আর আশা নেই। অথচ প্রাণ সহজে বেরুচ্ছে না। দীর্ঘপ্রলম্বিত সে যন্ত্রণা দেখা রােগীর একান্ত প্রিয়জনের প্রক্ষে যে কত অসহ্য, সে-তাে বাস্তব ঘটনায় অনেকেরই জানা। সহস্র নাড়ীর বন্ধনে বেঁধে জননী যে-সন্তানকে আপন গর্ভে জন্ম দিয়ে ও পুষ্ট করে তুলেছেন, সেই প্রিয় সন্তান শিবের অসাধ্য রােগে ভােগে, ডাক্তার বৈদ্য শুকনাে মুখে জবাব দিয়ে যায়, অথচ সব যন্ত্রণার অবসান যে মৃত্যুতে, সে তাে কাছে আসে না। তখন সেই রােগযন্ত্রণাকাতর সন্তানের মাথা নিজের কোলে নিয়ে মা সাঞনয়নে তার আশু মৃত্যু কামনা করছেন—এরকম বাস্তব ঘটনার তত সহস্র উদাহরণ আছে। এ মৃত্যু-কামনা যে মানবীয় জননীর নিবিড় অপত্যস্নেহেরই আর একটি প্রকাশ তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দূরারােগ্য ব্যাধিগ্রস্ত একান্ত প্রিয়জনের যন্ত্রণা চোখের সামনে আর দেখতে না পেরে যদি কেউ ধৈর্য হারিয়ে তার আশু প্রাণ অবসানের চেষ্টা করে, তবে সে চেষ্টা যে অতি গর্হিত নরহত্যার সঙ্গে সমতুল্য নয়, অন্তত মানুষের হৃদয়গত একান্ত মমতা ও প্রীতির বিচারে সেকথা অস্বীকার করবে কে? এরকম হত্যাকে তাই ‘মার্সি কিলিং’ নাম দেওয়া হয়েছে। একান্ত মমত্ববােধে, একান্ত করুণাপ্রবণতায় এই প্রাণহরণের দায় ও দায়িত্ব যারা নিজের হাতে তুলে নেয়, তাদেরও ঐ কাজ করার সময় অসহ্য হৃদয়-বেদনার কথাও স্মরণ রাখতে হয়। ন্যায়-অন্যায় বিচারের আইনে এরকম হত্যাকে অন্য আর সব হত্যার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে দেখা যে ভুল, সেকথা বেশী বলার দরকার নেই। শুধু মানুষের বেলাতেই নয়। একান্ত প্রিয় পােষা কুকুর, পাখি, ঘােড়ার অসহ্য রােগযন্ত্রণা দেখে কত না পালক স্বহস্তে তাদের গুলী করে চোখের জলে ভেসেছে? তাই কোপেনহেগেনের ঐ ভাগ্যহত ছেলে দুটি নিজের দূরারােগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মা-এর যন্ত্রণা আর দেখতে না পেরে তার একান্ত অনুরােধেই তার যে প্রাণনাশ করেছে, তাতে হত্যাপরাধীর ঘৃণ্য মনােভাব নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১