You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.24 | স্বস্তি পরিষদের নরম সুর | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

স্বস্তি পরিষদের নরম সুর

স্বস্তি পরিষদ আত্মসমর্পণ করেছে। এই আত্মসমর্পণ বাংলাদেশে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মত নিঃসর্ত নয়। তাতে রয়েছে খানিকটা অভিভাবকত্বের সুর। যখন পাক-ভারত লড়াই চলছিল তখন স্বস্তি পরিষদের হম্বিতম্বী/হন্বিতন্বী ছিল আকাশচুম্বী। মার্কিন সুতাের টানে অসম্ভব নেচেছে সে। অবিলম্বে অস্ত্রসম্বরণ এবং সীমান্তে সৈন্যাপসারণ ছিল তার অনড় দাবী। বাংলাদেশও তার আওতা থেকে বাদ পড়ে নি। তিন তিনবার মাথায় ভিটোর চাটি মেরে স্বস্তি পরিষদকে ঠাণ্ডা রেখেছিল সােভিয়েট রাশিয়া। হাওয়া এখন পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকবাহিনী সেখানে নিশ্চিহ্ন। সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়েছে স্বস্তি পরিষদ। তার সর্বশেষ প্রস্তাবে বাংলাদেশের উল্লেখ নেই। শুধু আছে যথাযথভাবে অস্ত্রসম্বরণ ব্যবস্থা মেনে চলার এবং বাস্তব অবস্থা বিবেচনার পর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সীমান্তে সৈন্যাপসারণের আহ্বান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং বলে দিয়েছেন স্পষ্ট কথা। স্বস্তি পরিষদের প্রস্তাবের আওতায় পড়ে না বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার যতদিন সেখানে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানের প্রয়ােজন অনুভব করবেন ততদিন জওয়ানেরা থাকবেন। এটা নয়াদিল্লী এবং ঢাকার ঘরােয়া সমস্যা। পাকিস্তান যদি অন্য কোন রাষ্ট্রের সাহায্যে বাংলাদেশে পা দেবার চেষ্টা করে তবে শান্তিভঙ্গ অনিবার্য। মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আকারে ইঙ্গিতে মেনে নিয়েছে স্বস্তি পরিষদ। এখানকার দুর্গত মানুষগুলােকে সাহায্যের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ তৈরী।
স্বস্তি পরিষদ পাক-ভারত উপমহাদেশে চাচ্ছে স্থায়ী শান্তি। কাশ্মীরের উপর ইসলামাবাদের শ্যেন দৃষ্টি নিঃসন্দেহে স্থায়ী শান্তির বিঘ্নকর। ওরা বারবার ভেঙ্গেছে যুদ্ধবিরতি সীমারেখা। দখল করে রেখেছে এ রাজ্যের খানিকটা ভূখণ্ড। স্বস্তি পরিষদের প্রস্তাবে এই সীমারেখায় ফিরে যেতে বলা হয়েছে ভারত এবং পাকবাহিনীকে। এটা স্থায়ী শান্তি বিরােধী। জওয়ানেরা দখল করেছে যুদ্ধবিরতি সীমারেখার ওপারে গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য ঘাটিগুলাে। স্থায়ী শান্তির জন্যই এগুলাে ছেড়ে আসা অসম্ভব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং একথা গােপন রাখেন নি। বিশেষ করে, ভুট্টোর মতিগতি মােটেই আশাপ্রদ নয়। পরাজয়ের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য তিনি পাগল। এ অবস্থায় প্রতিরােধের দৃঢ়মুষ্টি কোনমতেই শিথিল করতে পারে না ভারত। যদি সত্যিই স্থায়ী শান্তি চায় স্বস্তি পরিষদ তবে তাকে নিতে হবে আরও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী। স্পষ্ট ভাষায় তাকে বলতে হবে-বাংলাদেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার উপর থাকবে না পশ্চিম পাকিস্তানের কোন দাবী। কাশ্মীরের যুদ্ধ-বিরতি সীমারেখার ঘটবে পুনর্বিন্যাস। যেখানে আজ দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় বাহিনী সেখানেই হবে যুদ্ধ-বিরতি সীমারেখা। এই সীমারেখাই যথাসময়ে রুপ নেবে আন্তর্জাতিক সীমানায়। কাশ্মীর সীমান্তের এই নব বিন্যাস হজম করা নয়াদিল্লীর পক্ষে সহজ নয়। গােটা কাশ্মীরের উপরই রয়েছে তাদের আইনসম্মত দাবী। জওয়ানরা যে ঘটিগুলাে দখল করে রেখেছে তার ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক সীমানা টানতে হলে তাদের ছাড়তে হবে কাশ্মীরের খানিকটা অংশ। যুদ্ধ যেভাবে চলছিল তাতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল ভারতের পক্ষে মােটেই অসম্ভব ছিলনা। স্থায়ী শান্তির জন্য হয়ত নয়াদিল্লী কিছুটা ত্যাগ স্বীকারে রাজী। তার আগে স্বস্তি পরিষদ এবং পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব। প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ইসলামাবাদকে, তারা কখনই অস্ত্র ধরবেন না ভারতের বিরুদ্ধে। তা না হলে মিথ্যা হয়ে যাবে মুক্তিবাহিনী এবং জওয়ানদের রক্তদান কণ্টকিত হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নব রাষ্ট্র গঠনের পথ।
স্বস্তি পরিষদ আজ আর স্বস্তির জিম্মাদার নয়। নীতি বর্জিত এই সংস্থা অস্বস্তির হাটখােলা। বাংলাদেশে যখন চলছিল ইয়াহিয়ার গণহত্যা তখন স্বস্তি পরিষদ ছিল নীরব। প্রায় এক কোটি শরণার্থী যখন এল ভারতে তখন উট পাখীর মত বালুতে মুখ গুজে রইল সে। কেন এতগুলাে মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে পাশের রাষ্ট্রে আশ্রয় নিল তার কারণ অনুসন্ধানেও স্বস্তি পরিষদের প্রচণ্ড অনীহা। গত ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান চালাল ভারতের উপর ব্যাপক এবং অতর্কিত বিমান আক্রমণ। এই সংস্থা সেখানে দেখতে পেল না অশান্তির কোন চিহ্ন। জওয়ানদের সার্থক পাল্টা আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভাঙ্গল স্বস্তি পরিষদের। চীন এবং আমেরিকার সঙ্গে হৈ-হৈ করে উঠল স্বার্থান্বেষীরা। পাকিস্তানকে রক্ষা করার সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ। চোখের জল ফেলছেন ভুট্টো। তার বিদেশী বন্ধুরা চারদিকে চেয়ে দেখছেন ‘শূন্য পরিণাম। তাই স্বস্তি পরিষদের সুর নরম। আহাম্মক রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং তার পশ্চিমী মুরুব্বীরা। এই মুরুব্বীদের দলে জুটেছে এখন চীন। মহাসচিব উ থান্ট প্রায় এগার বছর আগলিয়েছেন বিশ্বসভা। তার ভূমিকাও সন্দেহ মুক্ত নয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই-এর সময় বৃটিশ ইঙ্গিতে তিনি চেপে রেখেছিলেন পাক-বিরােধী নিম্মির রিপাের্ট। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার সময় মার্কিন তালে তাল দিয়ে বলেছিলেন উ থান্ট-ওটা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। তিনি যদি যথাসময়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তােলার সাহস দেখাতেন তবে এড়ান ভারত লড়াই। বাঁচত বাংলাদেশের হাজার হাজার নিরপরাধ নরনারী। সবাই জানে, রাষ্ট্রসঙ্ঘ ক্লীব এবং শক্তিমানের হাতের পুতুল। দুটি পক্ষের মধ্যে হয়ে গেছে সাম্প্রতিক লড়াই। এক পক্ষ ভারত ও বাংলাদেশ এবং অপর পক্ষ পাকিস্তান। জওয়ান এবং মুক্তিবাহিনী দিয়েছে প্রচণ্ড মার। নয়াদিল্লী এনেছেন একতরফা অস্ত্রসম্বরণ। ধ্বংসের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ইসলামাবাদ তাতে দিয়েছে সম্মতি। রাষ্ট্রসজ্ঞা এবং স্বস্তি পরিষদের কোন ভূমিকা নেই সেখানে। সব খতম হয়ে যাবার পর স্বস্তি পরিষদের নাক গলানাে নিছক আত্ম প্রতারণামূলক আত্মমর্যাদা রক্ষার করুণ কসরত। মহাসচিব উ থান্ট যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের দীর্ঘসেবার পর নিচ্ছেন বিদায় সে-রাষ্ট্রসঙ্রে সর্বাঙ্গে আদর্শভ্রষ্টতার কলঙ্ক চিহ্ন। ভাবী মহাসচিব ড. কুর্টভাল্ডহাইম ধরবেন এই শতছিদ্র তরণীর হাল। দেখুন বৃহৎ শক্তি গুলাের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের আবর্ত থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারেন কিনা-তার অঙ্গ থেকে কলঙ্কের চিহ্ন গুলাে মুছে ফেলতে পারেন কিনা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১