You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.25 | ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বিরােধী চক্রান্ত | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বিরােধী চক্রান্ত

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ ঢাকায় সরকারি কর্মচারীদের সভায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত করার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক থাকতে আহবান জানিয়েছেন। এই চক্রান্তের নায়ক কে বা কারা তা প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট উল্লেখ না করলেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর গতি অনুধাবন করলেই তাদের ঠিকুজির হদিস পাওয়া যায়। এখনও এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যারা নিজেদের ক্ষমতায় মত্ত হয়ে ভুয়া আদর্শের নামে পাকিস্তানের জল্লাদদের পেছনে মদৎ জুগিয়ে তারা বাংলাদেশের জনগণের মহান মুক্তি সংগ্রামকেই শুধু অপমান করছে না, তাকে আবার পাকিস্তানের হাতে তুলে দেবার জন্যও সাহায্য ও সহযােগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই তাঁর দেশবাসীকে এই চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ করে দিয়ে সময়ােপযােগী কাজ করেছেন। একটি নতুন জাতি সবেমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। তার সমস্ত অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে। এই ক’মাসে তার বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে বিনাশ করা হয়েছে। কত লক্ষ নিরীহ নরনারী জল্লাদদের হাতে নিহত হয়েছে। তার হিসাব নেই। এই ব্যাপক গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমতকে জাগ্রত করার জন্য প্রতিবেশী ভারত গত নয় মাস দুনিয়ার দেশে দেশে আবেদন নিয়ে গেছে। অবশেষে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তার সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানের সামনে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর নৃশংসতার দুর্গ ১৪ দিনের মধ্যেই তাসের ঘরের মতাে ধ্বসে যায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পাক দখলদারীর অবসান ঘটায় আশ্চর্য সামরিক দক্ষতায়। বাংলাদেশ মুক্ত। তার জনসাধারণের জীবন থেকে ২৪ বৎসরের অমানিশার অন্ধকার আজ দূরীভূত। মুক্তির বিজয়ােৎসবের আলােকে পূর্ব দিগন্ত আজ উদ্ভাসিত। কিন্তু অন্ধকারের জীবেরা সকলেই রাতারাতি ভালাে হয়ে গিয়ে বাংলাদেশের নবজাগ্রত চেতনাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসবে, এ ধারণা করা ভুল। সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ ঢুকিয়ে যাদের এতদিন পাকিস্ত নিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করেছে তারা এবং তাদের আন্তর্জাতিক দোসররা বাংলাদেশের এই গৌরবময় অভ্যুদয়কে ব্যর্থ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে যাবেই। এসম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক না থাকলে একটি নতুন জাতির প্রতি পদক্ষেপেই বিপদের সম্ভাবনা। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন সেই বিপদের দিকেই অঙ্গুলি সঙ্কেত করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাময়িক উপস্থিতিকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করবে আমাদের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্কে চিড় ধরাবার জন্য। অথচ একথা সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণেই ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের দেশকে পাকিস্তানি জল্লাদদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সেখানে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রয়ােজন যে-মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে সে-মুহূর্তেই আমাদের সেনাবাহিনী ফিরে আসবে। স্বদেশে। বাংলাদেশে আজ অসামরিক ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন। দেশের আইনকানুন, নিয়মশৃঙ্খলা সমস্ত কিছু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সেই সরকারের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতা যতটুকু দরকার ততটুকুই সেই সরকার গ্রহণ করবেন। সুতরাং ষড়যন্ত্রকারীদের এই অপপ্রচারে বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত হবেন না।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শােষণ করার অভিসন্ধিও ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার বরদাস্ত করবেন না। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাহুমুক্ত বাংলাদেশ বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে তার স্বাধীনতা। জনজীবন থেকে অর্থনৈতিক শােষণ উচ্ছেদ করা হল এই স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি। ভারত সরকার সে কারণেই গােড়া থেকেই সতর্ক হয়েছেন যাতে অর্থলােলুপ মুনাফাখােররা বাংলাদেশে নতুন করে দাঁত না বসাতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যােগসুত্র নিশ্চিতই স্থাপিত হবে। কিন্তু তা হবে পারস্পরিক স্বার্থে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এতদিন যেভাবে বাংলাদেশকে শােষণ করেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতি বাঙালীর মনে এখনও জাগরুক। ভারত সরকার সঙ্গতভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, একমাত্র সরকারি স্তরেই আমাদের দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হবে। বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে যতটা সাহায্য আমরা দিতে পারি তা দেওয়া হবে আমাদের দুই দেশের জনগণের মহান মৈত্রীকে মনে রেখে। কোনােরূপ চক্রান্ত, কোনােরূপ সাম্প্রদায়িকতাবাদী প্রচার এই মৈত্রীবন্ধন যাতে ছিন্ন করতে না পারে তার জন্য সীমান্তের এপারে এবং ওপারে সর্বস্তরে চাই সতর্কতা এবং সচেতন আন্দোলন। এই উপমহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বার্থেই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীকে চিরস্থায়ী করে রাখতে হবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১