You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাষ্ট্রভাষার আসনে বাংলা

বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার যে-সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে-সিদ্ধান্ত সকলের বুকে আনন্দে ভরিয়ে দিলেও তা এখন সকলকে চমকে দেবার মত এমন কিছু নয়। কারণ স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণের মত বাংলাভাষাই তাে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা তথা সমস্ত সরকারি কাজকর্ম চালানাের ভাষা যে হবে, সে-ধ্রুব প্রত্যয়ই তাে ঐ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের মূলে এতদিন নিহিত থেকেছে। ওর জন্মপ্রত্রিকায় লিপিবদ্ধ বছরের পর বছরের অতীত ঘটনাগুলিতে চোখে বুললে দেখা যাবে, পাকিস্তানি শাসক-শােষকদের কাটামারা বুটের তলায় তাদের আর যা সব পিষ্ট রক্তাক্ত হয়েছে, তাদের অন্যতম হচ্ছে তাদের বুকের ভাষা, মুখের ভাষা বাংলা। এই বুকের ভাষা, মুখের ভাষাকে বাঁচাতেই তাে সাড়ে সাতকোটি মানুষের লড়াই সুরু হয়েছিল ঢাকায় ১৯৫২ সালে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে। ঢাকায় সালাম বরকতদের গুলির মুখে চুপ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসক-শােষক কুল। কিন্তু তাদের জান কেড়ে নিলেও তাদের মুখের জবান কেড়ে নিতে পারে নি নির্মম অত্যাচারীরা। বাংলাদেশের মাটিতে ঐ শহিদদের যে রক্তবিন্দু ঝরেছে, সে-সব রক্তবিন্দু ব্যর্থ হয় নি। তারা লক্ষ লক্ষ রক্তবীজের সৃষ্টি করে সেই শাসক-কুলের বিরুদ্ধে তাদের দাড়। করিয়েছে। শেষ পরিণতিতে পাকিস্তানি শাসন যে ভয়ঙ্কর নারীঘাতী শিশুঘাতী বীভৎস রূপে নিতেও কুণ্ঠিত হয় নি, গত ন-মাসে ১৫ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ বাঙালীকে যে জবাই করেছে, তার মুখে দাঁড়িয়েও ঐ মরণপণ-সংগ্রামীরা লড়াই করে শত্রুকে খতম করেছে। সে-লড়াই-এ ‘জয় বাংলা’-ধ্বনিই তাে তাদের বুকের বল প্রাণের বল জুগিয়েছে, আর এই ‘জয় বাংলা’-ধ্বনি তাে এই পৃথিবীর একটি ভৌগােলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ একটি ভূখণ্ডের তাে জয়ধ্বনি শুধু নয়। সে যে তার ভাষার,তার সংস্কৃতির, তার হর্ষ-শশাকের, তার দুঃখ-গর্বের তার সব কিছুর জয়ধ্বনি। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্যই ভিন-ভাষার ভিন সংস্কৃতির শাসকশােষকদের বিরুদ্ধে সাড়ে সাতকোটি মানুষের মরণপণ লড়াই তাে পরিণতিতে তাদের মাতৃভূমির সার্বিক মুক্তি এনে দিয়েছে। সুতরাং উর্দু নয়, ইংরেজি নয়, বাংলাভাষাই যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, সরকারি ভাষা হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
পাকিস্তানি শাসক-শােষকরা ধর্মের জিগির তুলে বাংলাভাষাকে ইসলাম-বিরােধী বলে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষকে খুব ভােলাবার চেষ্টা করেছিল। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলাভাষার অপমান করতে ওদের মন একটুও কুণ্ঠিত হয় নি। ঢাকা রেডিও থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্জনে ওদের অপচেষ্টা দেখেছে বাঙালীরা। ওরা মনে করেছিল, বেয়নেটে আর গুলিতে বাংলাভাষাকে খতম করে দিয়ে উর্দুকে বাংলাদেশের ওদের রাজ্যপাটে পাটেশ্বরী করে বসাবে। কিন্তু পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরীর মালা-জড়ানাে বাংলাদেশের মানুষরা স্বৈরতন্ত্রী পশ্চিমা শাসকদের চোখরাঙানিতে ডরায় নি, বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার জন্য একজাতি একপ্রাণ হয়ে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। আর যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাড়ে সাতকোটি মানুষকে জঙ্গীশাসকচক্রের হাত থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন, বলতে গেলে তিনিই তাে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য প্রথম সংকল্প বাক্য ঘােষণা করেছিলেন। সদ্যোজাত পাকিস্তানের জন্য আনন্দে ডগমগ হয়ে যেদিন কায়দে আজম জিন্নাসাহেব ঢাকায় গিয়ে জনসভায় দাড়িয়ে ঘােষণা করছিলেন, উর্দু তামাম পাকিস্তানের তাে বটেই, তার পূর্বাংশেরও রাষ্ট্রভাষা হবে, সেদিন সেই জনসভায় না উর্দু নয়, বাংলাই হবে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা’-বলে যে প্রতিবাদ একটিমাত্র কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, তা তাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামনেরই কণ্ঠে। ২৩ বছর আগে কেন্দ্রীয় পাক-শক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষদের পক্ষ থেকে যে-প্রতিবাদ বঙ্গবন্ধুর একক কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, কালক্রমে তাই সাড়ে সাতকোটি মানুষের সম্মিলিত নিনাদের রূপ নিয়ে কেন্দ্রীয় পাক-শাসকচক্রের হৃৎকম্পের সৃষ্টি করেছিল। তাই পরবর্তীকালে উর্দুর পাশে বাংলাকেও একটু ঠাই দিতে তারা বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আজ স্বাধীন বাংলাদেশ উর্দু নয় স্রেফ বাংলাভাষাকেই তাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আসনে বসিয়ে বাঙালীরা নিজেদের সংকল্প পূর্ণ করলাে। এখন থেকে ঠিক হয়েছে, সরকারি নির্দেশ, বুলেটিন গেজেট-বিজ্ঞপ্তি, সাইনবাের্ড, রাস্তার নাম, গাড়ির নম্বর -সবকিছুই লেখা হবে বাংলাভাষায়।
বাংলাভাষার এই রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জন্য আমরা এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরাও আজ বড় আনন্দিত, বড় গৌরবান্বিত। কারণ বাংলা আমাদেরও মাতৃভাষা। পশ্চিমবঙ্গ আর তার প্রতিবেশী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ভাষায় সংস্কৃতিতে এক। ওরা পরস্পরের নিকট আত্মীয়। ১৯৫২ সালে ঢাকায় বাংলাভাষার জন্য যারা শহিদ হয়েছেন এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমরাও তাদের শহিদ বলে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি তাদের উদ্দেশে আমরা মাথা নত করি। প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে এই পশ্চিমবঙ্গের নানান জায়গায়, এমনকি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনও যথােচিত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে আমরা স্মরণ করে আসছি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য ওঁরা শহিদ হয়েছেন বলেই আমরা ওঁদের স্মরণ করি। এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিছু নেই। আর আমরাও সেই সঙ্গে অনুভব করি, এই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের ভাষা বাংলা হলে হবে কী, আজও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষারূপে বাংলাভাষাকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নি। যদিও কী কংগ্রেসী, কী অ-কংগ্রেসী সরকার সবাই এখানে একের পর এক পার হয়ে গেছেন, সবাই অন্তত মুখে ঐ শুভকর্ম সম্পাদনের জন্য সংকল্প ঘােষণা করেছেন কিন্তু বাস্তবে সব শিকায় তুলে রাখা হয়েছে। এই বেদনাই আজ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাংলাভাষার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভের শুভ সংবাদের আনন্দের মধ্যে কাটার মত আমাদের বিদ্ধ করছে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!