You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.28 | পাকিস্তানের বাঙালীরা বিপন্ন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের বাঙালীরা বিপন্ন

পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় পাঁচ লক্ষ বাঙালী বিপন্ন। ওদের উপর চলছে অকথ্য অত্যাচার। সিন্ধুর অবস্থা ভয়াবহ। পাক-ভারত লড়াই সুরু হবার আগেই অনেক বাঙালীর ঘরবাড়ী গুণ্ডরা ধংস করে ফেলেছে, রাস্তায় তাদের পিটিয়ে মেরেছে। ভুট্টোর চোখের সামনেই ঘটেছিল এসব ঘটনা। টু শব্দ করেন নি তিনি। মুক্তিবাহিনী আচ্ছামত ধােলাই দিয়েছে পাক সৈন্যদের। পরাজয়ের সব আক্রোশ পড়েছে প্রবাসী উপর। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো নিজেই স্বীকার করেছেন অবস্থার গুরুত্ব। চরম দূর্দিনের মধ্যে আর্ত মানুষগুলাে পালাবার পথ পায় নি। ভারত সীমান্ত বহুদূরে। সেখানে পাড়ি জমান সহজসাধ্য নয়। যারা পালাতে পেরেছে তাদের সংখ্যা নগণ্য। পাকিস্তানিদের হিংস্রতা কারও অজানা নেই। বাংলাদেশে দশ লক্ষ মানুষের কঙ্কাল এবং হাজার হাজার ধর্ষিত নারীর করুণ কাহিনী তার প্রমাণ। পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে কতজন বেঁচে আছেন তা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। যারা এখনও জীবন নিয়ে ধুকছে তাদের উদ্ধার আশু প্রয়ােজন। তা না হলে হয়ত নিশ্চিহ্ন হবে প্রবাসী বাঙালী। এরা নিদোষ এবং অবস্থার বলি। বাঙালীরা চালায় নি সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি নারকীয় তাণ্ডব। পেটের দায়ে বাসা বেধেছিল অবান্ধব দেশে। এইসব হতভাগ্যের একমাত্র অপরাধ বাংলাদেশে অত্যাচারীর শাসন খতম করেছে মুক্তিবাহিনী। অবসান ঘটিয়েছে পশ্চিমের আধিপত্য। ছিনিয়ে নিয়েছে স্বাধীনতা।
বাংলাদেশে অবাঙালীদের জন্য আজ চোখের জল ফেলছে বিদেশীরা। স্বয়ং ভুট্টো তাদের জন্য উদ্বিগ্ন। তার প্রতিনিধিরা তােলপাড় করছেন রাষ্ট্রসংঘ। যাদের জন্য তাদের এত মাথাব্যথা তারা কারা? ইয়াহিয়ার ঘাতকদলের বি-টিম রাজাকর। ওরা শ্মশানে পরিণত করেছে বাংলাদেশ। ঘরে ঘরে তুলেছে হাহাকার। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দুদিন আগেও চালিয়েছে বাঙালী বুদ্ধিজীবী নিধন। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বর্বর নয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরও সে চরম প্রতিশােধ নেয় নি। নির্মূল করে নি অবাঙালীদের। থামিয়ে রেখেছে প্রতিশােধের অতৃপ্ত আকাক্ষা। যারা জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী তাদের হবে বিচার। অন্যরা ছাড়া পাবে। এ ধরনের উদারনীতি যে-কোন লভ্য রাষ্ট্রের বাঞ্ছিত। ভণ্ড এবং মুর্তিমান শয়তান ভুট্টো, আর তার অন্ধ স্তাবকরা। যখন অবাঙালীরা পাক সৈন্যদের সহায়তায় বাংলাদেশে চালাচ্ছিল গণহত্যা তখন কোথায় ছিলেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো? কোন প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি? না, করেন নি। ইয়াহিয়ার একান্ত সহচর হিসাবে শুধু সত্য চাপা দিতে চেয়েছিলেন। আজ নরঘাতকদের জন্য তার উৎকণ্ঠার সীমা নেই। সিন্ধুতে ভুট্টোর চোখের সামনে যখন চলছিল বাঙালী নির্যাতন তখন তাদের রক্ষার কি ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি? কেন ডেকে বলেন নি ইয়াহিয়া কর এই পাইকারী অত্যাচার। একথা বলা তাে দূরের কথা ভুট্টো দিয়েছিলেন গুন্ডাদের পরােক্ষ প্রশ্রয়। এই গুন্ডা সদার আজ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশে রাজাকরদের দুঃখে বইছে তার চোখের পানি।
বাংলাদেশ সরকার এবং রাহুমুক্ত বাঙালীরা ভাল ভাবেই জানেন ভুট্টোকে ঠাণ্ডা রাখার দাওয়াই। উনি শক্তের ভক্ত এবং দুর্বলের যম। ইয়াহিয়া যখন ক্ষমতার আসনে ছিলেন তখন তিনি করতেন তার বুট লেহন। আজ ক্ষমতাচ্যুত প্রাক্তন মনিবের মাথায় ঘােল ঢালছেন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো। তিনি যুক্তি বুঝেন না, বুঝেন শুধু শক্তির দাপট। পশ্চিম পাকিস্তানের অবরুদ্ধ বাঙালীদের মুক্তির আগে একটি অবাঙালীও ছাড়া পাবে না বাংলাদেশে।
ওরা প্রবাসী বাঙালীদের মুক্তিপণ। মুক্ত বাংলায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিদেশী সাংবাদিকরা। সংবাদ প্রেরণে কোন বাধা-নিষেধ নেই। স্থানীয় সরকার কিছুই লুকাতে চান না। লুকাবার কিছুই নেই তাদের। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালীদের ভাগ্যে কি লাঞ্ছনা জুটছে তা অজ্ঞাত। দয়া করে তারা যান সেখানে। দেখুন প্রবাসী বাঙালীরা বেঁচে আছেন না, মৃতের পাহাড় সৃষ্টি করছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সজাগ হােন। অনুসন্ধান করুন। পশ্চিমের বাঙালীদের। জানান সবাইকে, তারা কেমন আছে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন। ওদের সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত কাটবে না তার উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার অবাঙালী জল্লাদরা অবাঞ্ছিত। ওদের পাপের ক্ষমা নেই। অপরাধীদের দাঁড়াতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়। বিচারের ন্যায়দণ্ড এড়াতে পারবে না তারা। যারা আদালতের আওতার বাইরে পড়বে তাদের সঙ্গে বিনিময় করতে হবে প্রবাসী বাঙ্গালীদের। ঘরের ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে নেবে বাংলাদেশ। পাক-অনুচররা চলে যাক পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের রক্তস্নাত নরনারী পঞ্চম বাহিনীর সঙ্গে একত্রে বসবাস করতে অসম্মত। অতীতের তিক্ত স্মৃতি এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের অপঘাত মৃত্যুর বেদনাময় কাহিনী সহজে ভুলার নয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১