You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.18 | ইয়াহিয়ার রণসাধ মিটেছে | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার রণসাধ মিটেছে

চৌদ্দ দিনের লড়াই শেষ। ইয়াহিয়া অস্ত্র সম্বরণে রাজি। রণসাধ তার মিটেছে। পুরা ঘটনাই নাটকীয়। দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধযাত্রা এবং চৌদ্দ দিন লড়াই-এর পর প্রত্যাবর্তন। মাঝখান থেকে খােয়া গেল বাংলাদেশ। সেখানে ঘটল পাক-বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। লেঃ জেনারেল নিয়াজীর মাথার উপর উড়ল জয় বাংলা পতাকা। তিনি আজ ভারতের বন্দী। ঢাকার পতনের পরও সাদম্ভে বলেছিলেন ইয়াহিয়া খান- শত্রুকে পাকভূমী থেকে না তাড়ানাে পর্যন্ত লড়াই চলবে। পরাজয় তিনি স্বীকার করবেন না। শঙ্কার কারণ নেই। সঙ্গে আছে বিদেশী মিত্রবর্গ। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ফেলেছেন একটি মাত্র টোপ। পশ্চিম রনাঙ্গনে ভারত করবে একতরফা অস্ত্রসম্বরণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল নয়দিল্লীর কাম্য। বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গেই পথের কাঁটা অপসারিত। সুতরাং কেন তবে অনর্থক রক্তপাত? পরাজিতের মনােবৃত্তি জানতেন তিনি। ইয়াহিয়া খপ করে গিলে ফেলেছেন শ্রীমতী গান্ধীর টোপ। হাজার বছর লড়নেওয়ালা ভুট্টোও তাকে টেনে রাখতে পারেন নি। লেঃ জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মতই ইয়াহিয়া খানের অস্ত্র সম্বরণ নিঃশ্বৰ্ত। কোথায় এখন মার্কিন সপ্তম নৌবহর? যুদ্ধ না থামলে চট্টগ্রামের বদলে তাদের যেতে হত করাচীর অদূরবর্তী দরিয়ায়। ঢাকার মার্কিন নাগরিকদের বদলে উদ্ধার করতে হত ইসলামাবাদের ইয়াহিয়াকে। তা না হলে ভারতের বজ্র আটুনী থেকে রেহাই পাবার কোন উপায় থাকত না তার। কোথায় এখন বিপ্লবী চীন? দূর থেকে শুধু দোস্তের শােচনীয় পরিণতিটাই দেখল। সশস্ত্রে এগিয়ে এল না। হায় ইয়াহিয়া! এখন বুঝতে পারলেন, দুনিয়াটাই গােলকধাঁধা।
চোখের জলে বদন ভাসাচ্ছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁর রণসাধ মিটেছে কিনা জানা নেই। সেদিনও তিনি বলেছিলেন- ঢাকা যায় যাক্, পূর্ব পাকিস্তান যায় যাক্ এবং পশ্চিম পাকিস্তান যায় যাক- আমরা লড়াই করব। ভুট্টোর লড়াই-এর ঢং আলাদা। মুন্ডু কাটা গেলে শুধু ধড়টাই ছটফটাবে মাটিতে। এই হল তার আসল লড়া মনে পড়ে, লেঃ জেনারেল নিয়াজীর গর্বোক্তি -ভারত যদি পাকিস্তারে উপর লড়াই চাপিয়ে দেয় তবে সে লড়াই হবে ভারতের মাটিতে। অদৃষ্টের এমনি পরিহাস- ঢাকাতেই তিনি করেছেন আত্মসমর্পণ। কপালে জুটেনি ভারতের মাটিতে পা রাখার কোন সূযােগ। জওয়ানরা আগেই ভেঙ্গে দিয়েছিল তাঁর দুখানি পা। তবু লেঃ জেনারেল নিয়াজীর আছে একটি স্বান্তনা। তিনি বলতে পারবেন- প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। পাকিস্তানের উপর ভারত চাপায় নি লড়াই। বরং পাকিস্তানই ভারতের উপর চাপিয়েছে লড়াই। সুতরাং ভারতের মাটিতে যুদ্ধ করার প্রশ্ন আসে না। ঢাকার মাটিতেই সব খতম। এত বিপর্যয়ের মধ্যেও আশা ছাড়েননি ইয়াহিয়া খান। তিনি নাকি বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। যারা ঘাড় ধরে তাঁকে বার করে দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কি ঐকান্তিক ইচ্ছা। কে বলবে ইয়াহিয়া নরঘাতী দস্যু? তিনি প্রেমের অবতার। নাইলে এত মার খাবার পরও আবার আলােচনায় বসতে চান? বেহায়াপনার প্রতিযােগীতায় ইয়াহিয়াকেও হার মানিয়েছে চীন এবং আমেরিকা। পাক-ভারত লড়াই-এ চীন নাকি পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরবে না। শেষমুহুর্তে বিশ্ববাসীকে তা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন পিকিং নেতারা। বাংলাদেশের দুঃখে মার্কিন কর্তপক্ষও নাকি একেবারে গলে গিয়েছেন। দূর্গত বাঙালীকে আর্থিক সাহায্য দিতে তাদের নাকি আপত্তি নেই। পাক ভারত লড়াই-এ এটাই প্রমাণিত হয়েছে, মারের নাম মধুসুদন। ভারত যদি হারত তবে চারদিক থেকে হিংস্র নেকড়েরা তার গায়ে ছােবল মারত। এ যুদ্ধে ভারত জয়ী। তাই থাবা গুটিয়েছে ভারত জানােয়াররা।
যুদ্ধ শেষ। বিস্তৃত পাকভূমির উপর দাড়িয়ে আছে জওয়ানরা। আর ছাম্ব এলাকায় ছােট্ট এক ফালি কুমড়াের মত জমি রয়েছে পাকিস্তানের দখলে। অবশ্যই যথাসময়ে উঠবে সীমান্তে সৈন্য অপসারণের প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে তাসখন্দ চুক্তির পরবর্তী পাক আচরণ। মুস্কিল আসানের পরই সে ধরে নিজ মূর্তি। তারই পরিণতি এই চৌদ্দ দিনের লড়াই। ১৯৬৫ সালের চেয়েও ভারত এবার রয়েছে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে। তার এবারের মারটাও সাংঘাতিক। পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জমির উপর ভারতের লােভ নেই। তা যদি থাকত তবে শ্রীমতী গান্ধী পশ্চিম রণাঙ্গনে একতরফা অস্ত্রসম্বরণের নির্দেশ দিতেন না। গােটা পাকিস্ত নিই তিনি দখল করতে পারতেন। যুদ্ধের গতিও চলছিল সে-দিকে। নয়াদিল্লী বাঁচিয়েছেন পাকিস্তানকে। আমরা জানি, পাক জঙ্গিশাহী মুর্তিমান শয়তান। ফাঁদ থেকে বেরুলেই আবার দেবে রণহুঙ্কার। পরাজয়ের ডঙ্কা বাজাবে মিথ্যা বিজয় নিনাদে। দখল করতে চাইবে কাশ্মীর। এর একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। পাক অধিকৃত কাশ্মীর পাকিস্তানের নয়, ভারতের। জওয়ানদের দখল করা পাকভূমির বদলে পাকিস্তানকে ছাড়তে হবে কাশ্মীর। তা না হলে এই উপমহাদেশে আসবে না শান্তি। যুদ্ধবন্দী বিনিময় কিভাবে হবে, জানি না। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে চলেছিল গণহত্যা। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরপরাধ এবং অসামরিক নরনারী ও শিশু। খুঁজে বার করা উচিত ঘাতক সর্দারদের। হােক তাদের বিচার। তা হলেই বিশ্ববাসী ভালভাবে জানতে পারবেন- কি অপরাধ করেছিল পাকিস্তান? কেন অস্ত্র হাতে নিয়েছিল ভারত? ইতিহাসে বিধিবদ্ধ হয়ে থাকে পাক দস্যুবৃত্তির ঘৃণিত নজির। একটি কথা স্মরণ রাখা উচিত পশ্চিমের পাক নাগরিকদের। ইয়াহিয়া এবং তাদের সঙ্গীচক্র পাকিস্তানের নিদারুন অভিশাপ। ধ্বংসের মুখে টেনে এনেছেন তারা স্বদেশকে। পথে বসাচ্ছিলেন তাঁরা পশ্চিমের সাধারণ মানুষকে। কেড়ে নাও ওদের ক্ষমতা। গড়ে তােল ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রী রাষ্ট্র। বর্তমান যুগে মােল্লাতন্ত্র অচল। চৌদ্দদিনের লড়াই পাকিস্তানের পরাজয় এবং ধর্মীয় ঔদ্ধত্যের শােচণীয় পরিণাম তার জ্বলন্ত সাক্ষী।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১