You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.20 | পৈশাচিকতার জয় না হওয়ায় | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পৈশাচিকতার জয় না হওয়ায়

কতক কতক মানুষের এত বেশী স্নায়বিক দৌর্বল্য থাকে যে সামান্য আঘাতেই তারা বিচলিত হয়ে পড়েন। বড় রকম আঘাত পেলে প্রাণ নিয়েই টানাটানি বেধে যায় তাদের। তেমনি একজন সাংবাদিকের খবর পাওয়া গেল রাওয়ালপিন্ডি থেকে। পূর্ব বাংলা হতে ছাড়া হয়ে গেছে, পাকিস্তানি ফৌজ হতমান হয়ে সর্বত্র আত্মসমর্পন করছে, এই সংবাদে দ্রলােক এমন অভিভূত হয়ে যান যে ঘরের গ্যাস পাইপ খুলে সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা করে ফেলেন। পাকিস্তান প্রেমিক হিসাবে তার কাজকে কেউ কেই হয়ত সাধুবাদে সম্বর্ধিত করবেন। কিন্তু তথ্যজ্ঞ ও বিচারশীল সাংবাদিক হিসাবে এমন মানুষেরা যে অচল, এ না স্বীকার করে পারবেন না কেউ। তাছাড়া হারজিতৎ ও দুঃখ। বিপদ বাদ দিয়ে জীবন নয় এ কথা সাংবাদিক অসাংবাদিক কে না জানেন?
পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলে, কিংবা প্রত্যাশিত প্রেমে বিমুখ হলে, নাবালক ছেলেমেয়ে দুচারজন কোন কোন সময় আত্মহত্যা করে। প্রিয় ফুটবলের দল খেলায় হারলে অন্নজল ত্যাগ করার এবং অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও পাওয়া যায় দুচারটি। বিখ্যাত অভিনেতার মৃত্যুতে আত্মহত্যার ঘটনাও আছে। এগুলাে সবই কৈশাের কালীন আবেগপ্রবণতার নিদর্শন এবং প্রবীন বুদ্ধির মানুষরা এতে দুঃখিত হলেও কোন যুক্তিতেই এসবকে সমর্থনীয় মনে করেন না। প্রজ্ঞাবান ও প্রাপ্তবয়স্ক একজন সাংবাদিকের এ কাজকে তাই ছেলেমানুষীর মুঢ়তাই বলতে হবে। হয়ত একাগ্র চিত্তে ভদ্রলােক চেয়েছিলেন পাকিস্তান জিতবে, হয়ত এসম্বন্ধে তাঁর সংশয় মাত্র ছিল না হয়ত মােটা রকম বাজিই ধরেছিলেন তিনি কারাে সঙ্গে। তাই শেষ পর্যন্ত মরেই মান বাঁচাতে হল তাকে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, খােদ ইয়াহিয়া খা এবং তার সাঙ্গ পাঙ্গেরা সবাই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এতবড় বেইজ্জতীতেও তাঁদের কারাে মরার কথা মনে হল না। নিয়াজী সাহেব যিনি সরাসরি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দিলেন, সাময়িকভাবে রেসকোর্সে সমবেত জনতার সামনে দুএকবার একটু ছলছলে চোখ করেছিলেন মাত্র। মালিক সাহেব, যিনি গবর্ণরীর তক্ত ছেড়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, তিনি শুধু কপালে কি আছে জানিনা বলেই হাহুতাশ করছিলেন দুএকবার। অর্থাৎ সবাই শেষ পর্যন্ত অপমানের বড়ি গলধঃকরণ করেই খাড়া থাকতে পারলেন, পারলেন না পাকিস্তান প্রেস ইন্টার ন্যাশনালের ঐ রিপাের্টার ভদ্রলােকটি। বেচারীর জন্যে দুঃখিত হবেন সবাই। কিন্তু তার বেশি আর কি করার আছে? কারণ প্রান বস্তুটা চলে গেলে আর ত ধরে পাওয়া যায় না তাকে।
তবে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক রূপে নিরপরাধ মানুষরা কি দারূণ লাঞ্ছনা ভােগ করছেন, কিভাবে ঘাতকদের হাতে দলে দলে প্রাণ দিয়েছেন জন্মভূমির বন্ধন মুক্তির জন্যে, তা দেখেও যিনি মনে মনে পাকিস্তানি দস্যুশাহীর জয় কামনা করেছিলেন এবং তা হল না দেখে ভেঙে পড়েছিলেন শােকে, তার বুদ্ধি ও বিচার শক্তিটা যে খুব টনটনে ছিল না, আর মানবপ্রীতি যে মােটেই ছিল না, এ কে না বলবেন?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১