You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.21 | বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারতের দায়িত্ব | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারতের দায়িত্ব

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্ৰীওয়াই বি বাধন কানপুরে এক জনসভায় বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ভারত সর্বপ্রকার সাহায্য করবে। নবজাত রাষ্ট্রটির সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ক রক্তের রাখি বন্ধনে বাধা পড়েছে। ভারতের তরফ থেকে তাই এই ধরণের আশ্বাস দেওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। ভারতবর্ষ ধনী দেশ নয়, তার নিজেরই সমস্যার অন্ত নেই। অন্য দেশকে সাহায্য করার সাধ্য তার নেই বললেই চলে। তবুও ভারত কলােম্ব পরিকল্পনা, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক প্রভৃতি মারফৎ অন্যান্য দরিদ্রতর দেশকে সাধ্যমত সাহায্য করেছে। নেপাল, ভুটান, মরিশাস প্রভৃতি দেশের উন্নয়নে ভারত উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু। বাংলাদেশে ভারতকে যা করতে হবে তার সঙ্গে ঐ সব দেশে ভারতের সাহায্যের কোন তুলনাই হয় না। বাংলাদেশ একটা ভয়ঙ্কর দুর্যোগের ভেতর দিয়ে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করল। গতবছরের ঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাস এবং পাকিস্তানি ফৌজের গত নয় মাসব্যাপী তান্ডব এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ সমগ্র বাংলাদেশের উপর ও দুরপনেয় ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। কত কুটির, কত গ্রাম, কত ব্রিজ অথবা রেললাইন ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। যাতায়াত ও যােগাযােগের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বন্দর প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বানিজ্যিক যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বহিবাণিজ্যের গােটা ছকটিই ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশের প্রভূত বনসম্পদ ও অন্যান্য প্রকৃতিক সম্পদের ভিত্তিতে সে দেশের শিল্প গড়ে তােলার যে সম্ভাবনা ছিল, যে সম্ভাবনাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাস্তবে পরিণত হতে দেনন নি, আজ যদি সেই শিল্প সম্ভাবনাকে রূপায়িত করতে হয় তবে প্রচুর অর্থ লগ্নী করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারের একার পক্ষে এত বড় আর্থিক দায়িত্ব গ্রহণ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। পৃথিবীর ধনী দেশগুলি এই দায়িত্বের ভাগ নেবে কিনা তা এখনাে বােঝা যাচ্ছে না। স্বভাবতই বাংলাদেশের সংগ্রামী সাথী হিসাবে তার প্রতিবেশি দেশ হিসাবে ভারতকে এই দায়িত্বের একটি বড় ভার নিতে হবে। যে স্বাধীনতা সম্ভব করে তােলার জন্য ভারত এত রক্ত দিল সেই স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের বােঝাও তাকে কিছুটা বহন করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে কতকগুলি সতর্কবানী সম্ভবত এখনই উচ্চারণ প্রয়ােজন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযােগিতা সমতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। দুই দেশের মধ্যে দাতা এবং গ্রহীতার সম্পর্ক স্থাপন কারাটা উভয়ের ভবিষ্যৎ মৈত্রির ক্ষেত্রে তা ক্ষতিকর হবে। ভারত ও নেপালের মধ্যে সম্পর্ক কিভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেটা যেন আমরা না ভুলি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করবেন সে দেশের সরকার। এই পরিকল্পনার কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার সেখানে যতটুকু সাহায্য নেয়ার প্রয়ােজন মনে করবেন ভারত সরকার ততটুকুই সাহায্য করবেন। সাহায্যের নাম করে ভারত তার অর্থনৈতিক ধারণাকে প্রতিবেশী দেশের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, একথা বলার সুযােগ যেন কেউ না পায়। দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া যেন অটুট থাকে যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করে ভারত পরিণামে নিজেকেই সাহায্য করছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে ভারতের সাহায্য করার অর্থটা যেন এই না হয় যে, পূর্ববঙ্গের বাজারটাকে এ দেশের মুনাফা সন্ধানী ব্যবসায়ীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। তা যাতে না হতে পারে সে জন্য দু দেশের মধ্যে বাণিজ্য সরকারি লেনদেনের ভিত্তিতে হওয়া চাই। এটা সুলক্ষণ যে, বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সীমান্তে র উভয় দিকের নেতারাই সচেতন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রী এ এল ডায়াস সেদিন ব্যবসায়ীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, তারা যেন বাংলাদেশে গিয়ে ব্যবসা ফাদার মওকা না খোজেন। বাংলাদেশের বাণিজ্য পর্ষদের চেয়ারম্যান জনাব মতিয়ার রহমানও বলেছেন যে, নুন, সরষের তেল, কেরােসিন প্রভৃতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস ভারত থেকে আমদানী করে বিক্রি করার জন্য বাংলাদেশে কোন বেসরকারি ব্যবসায়ীকে লাইসেন্স বা পারমিট দেয়া হবে না।
নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে হিসাব করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং সেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য ভারতকে ৬৫০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এদেশ থেকে চাল, কাপড়, নুন, তেল কয়লা, কেরােসিন, ওষুধপত্র প্রভৃতি পাঠাবার দরকার হবে। আমাদের দেশেও এসব জিনিসের যােগান যথেষ্ট নয়। সুতরাং টাকার অঙ্কেই হােক বা অত্যাবশ্যক পণ্যের দিক দিয়েই হােক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দায়িত্ব পালন করাটা এদেশের মানুষের পক্ষে যে খুবই ক্লেশকর হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্লেশ স্বীকার করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১