খুনীদের বিচার চাই
পঁচিশে মার্চ বৃহস্পতিবার। সেই ভয়াবহ রাত্রী। পাইকারিহারে বুদ্ধিজীবিদের সাবাড় করেছিল পাক সৈন্যদল। তারপর সুরু হয়েছিল ঢাকায় গণহত্যা। এই নারকীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের সর্বত্র। ন’মাস ধরে চলছে নাদিরশাহী তান্ডব। যারা হত্যার উৎসবে মেতেছিল তাদের গায়ে ছিল পাক সৈনিকের ইউনিফর্ম। ওদের সহকারী রাজাকার এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবকরা। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ষােলই ডিসেম্বর। তার আগে পাক জঙ্গীনায়কদের নিয়ন্ত্রিত ঢাকা, কুমিল্লা এবং খুলনায় ঘটেছে পঁচিশে মার্চের গণহত্যার পুনরাবৃত্তি। ভারতীয় স্থলবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল মানেকশ বারবার দিচ্ছিলেন পাকসৈন্যদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ। তবু সতর্ক হয়নি ওরা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চালিয়েছে গণহত্যা। গত চৌদ্দই এবং পনেরই ডিসেম্বর ঢাকায় প্রায় একশ নাগরিককে বাড়ী থেকে টেনে বার করে নিয়ে গিয়েছিল পাক দুবৃত্তরা। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে তাদের। অনেকে হয়েছে জবাই। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সন্ধান পাওয়া গেছে বধ্যভূমি। সবাই দেখেছেন মৃতের পাহাড়। জনা কয় বুদ্ধিজীবীর শবও ছিল সেখানে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই ছড়িয়ে আছে এ ধরণের বধ্যভূমি। যথাসময় আবিস্কৃত হবে হাজার হাজার কঙ্কাল। স্মরণ করিয়ে দেবে নাৎসী জাৰ্মাণীর বীভৎসতা কিংবা মার্কিনী লাইমাই।
লেঃ জেনারেল নিয়াজী এবং তার ঘনিষ্ঠ সামরিক অফিসাররা অস্বীকার করতে পারেন না এইসব অপরাধের দায়িত্ব। তাদের শাসনের আওতার মধ্যেই ঘটেছে গণহত্যা। অপরাধীরা পায়নি কোন শাস্তি। সৈনিকবৃত্তির কতগুলাে আচরণবিধি আছে। সেগুলাে আন্তর্জাতিক আইন অনুমােদিত। এসব বিধি মেনে চলা প্রত্যেকটা সৈনিকের নৈতিক কর্তব্য। লেঃ জেনারেল নিয়াজী এবং তার অধীনস্ত সৈনিকেরা মানেননি সৈনিকের ধর্ম। পদদলিত করেছেন আন্তর্জাতিক বিধি। আত্মসমর্পণের একদিন আগেও পাক সেনাপতিরা গণহত্যা বন্ধ করার জন্য সচেষ্ট হননি। ওরা ভেবেছিলেন- সামনে রয়েছে জেনারেল মানেকশ এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কের প্রতিশ্রুতি। আত্মসমর্পণ করলেই পাকসৈন্যরা পাবে জেনিভা কনভেনশনের রক্ষাকবচ। গণহত্যা চালাবার পরমুহূর্তেই দু’হাত উঁচু করে দুবৃত্তদের দল করেছে আত্মসমর্পণ। ফাকি দিতে অপরাধের শাস্তি। জেনিভা কনভেনশন সত্যিকারের সৈনিকদের জন্য, ঘাতকদের জন্য নয়। গােটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্রোধে আত্মহারা। খোঁজে বেড়াচ্ছে তারা নিখোঁজ আত্মীয়স্বজন এবং অপহৃতা মা বােনদের। কোথাও মিলছে না তাদের সন্ধান। যুদ্ধের সময় পাক বেতার বারবার দাবী জানিয়েছে, বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছে বেশ কিছু ভারতীয় জওয়ান। একটা নিখোঁজদের তালিকাও আছে নয়াদিল্লীর হাতে। এইসব ভারতীয় যুদ্ধবন্দীরা গেলেন কোথায়? বাংলাদেশে কতজন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত করেছেন তাদের বিজয়ী সহকর্মীরা। এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দরকার। জেনিভা কনভেনশনের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে না পাকসৈন্য এবং তাদের সেনাপতিরা। বাংলাদেশের আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তাদের। নইলে অশান্ত জনতাকে শান্ত করা যাবে না। অত্যাচারী বুঝবে না তাদের অপরাধের গুরুত্ব। সৈনিক হয়ে যারা দেয়নি সৈনিকবৃত্তির মর্যাদা তারা পাবেন জেনেভা কনভেনশনের সুযােগ।
প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই আর কত জল ঘােলা করবেন? স্বস্তি পরিষদে তাদের প্রতিনিধিরা দাবী জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণের। যাদের মুলুকে জওয়ানরা আছেন তারা বলছেন এদের মুক্তিদাতা। আর সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের নিকসন এবং মার্কিন দোস্ত চৌ এন লাই বলছেন তাদের আক্রমণকারী। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ জওয়ানদের দিচ্ছে ফুলের মালা। নিকসন এবং চৌ এন লাই ছুড়ছেন গালাগালি। এই মুহূর্তেই যদি ভারতীয় জওয়ানরা ছেড়ে আসে বাংলাদেশ তবে কোন বিবরে লুকাবে হাজার হাজার পাকবন্দী? জনতার রুদ্ররােষ পড়বে তাদের উপর। জ্যান্ত অবস্থায় উপড়িয়ে নেবে দস্যুদের গায়ের চামড়া। ন,মাসের নৃশংস অত্যাচারের বদলা কি তারা নেবে না? আত্মসমর্পণের দু’একদিন আগে পাইকারী হারে যারা হত্যাকান্ড চালাল এবং যারা তাতে মদৎ দিল তাদের কৃতকর্মের কি কৈফিয়ত দেবেন প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খান নাকি নাদির শাহের বংশধর। তার দেহে বইছে খুনির রক্ত। তাই গণহত্যায় এই বর্বরের হাত কাপে না। কিন্তু নিকসন এবং চৌ এন লাই এর ধমনীতে উঠানামা করছে কার রক্ত? চেঙ্গিস খানের না অন্য কোন রক্তলােলুপ দানবের? তা না হলে ঘাতক দলকে উদ্ধারের জন্য বঙ্গোপসাগরে কেন যায় সপ্তম নৌবহর? নাদিরশাহের বংশধরের হাতে কেন পৌছে দেন মারনাস্ত্র? মার্কিন এবং চীনা খেলা এখনাে শেষ হয়নি। প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তির পর দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনার দেরী নেই। ভুট্টোর অস্বাভাবিক দৌড়াদৌড়ি তারই অশুভ ইঙ্গিত। ভবিষ্যতে যা ঘটার ঘটবে। তা নিয়ে মাথা ঘামানাের সময় এখন নেই। বাংলাদেশের রাহমুক্ত জনতার মুখে একটি দাবী বড় হয়ে উঠেছেখুঁজে বার কর ঘাতকদের। বসুক আদালত। হােক ন্যায়সঙ্গত বিচার। অপরাধীর মাথায় নেমে আসুক দণ্ড। আদালতে থাকবে না কোন গােপনীয়তা। নিকসন এবং চৌ এন লাই উকিল সেজে হাজির হােন বাংলাদেশের আদালতে। সওয়াল করুন আসামীদের পক্ষে। নির্দোষ প্রমাণের পর মুক্ত করে নিয়ে যান তাদের। বাধা দেবে বাংলাদেশের জনতা। ওরা পাল্টা গণহত্যা চায় না, চায় শুধু ন্যায় বিচার।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১