ক্ষমতার আসনে ভুট্টো
ইয়াহিয়া বিদায় নিলেন। পিছনে রেখে গেলেন পাকিস্তানের নিদারুন ভাগ্যবিপর্যয় -ক্ষুব্ধ জনতার প্রচণ্ড ধিক্কার। জুলফিকার আলি ভুট্টো চেপে ধরেছেন রাষ্ট্রের দিশেহারা তরণীর হাল। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ। ওটা আজ পশ্চিমের ধরাছোঁয়ার বাহিরে। তাতে দমেন নি ভুট্টো। অনিবার্যকে স্বীকার করে নিতে সরম লাগছে তার। পরাজিত সমরনায়করা লজ্জায় অপােমুখ। প্রেসিডেন্টের গদীতে বসতে রাজী নন কেউ। সংবিধানের বালাই নেই। সদম্ভে এগিয়ে এসেছেন পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো। তিনি খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইনপ্রশাসক। ব্যবস্থাটা খুবই সাময়িক। রাজনৈতিক নেতাদের হুকুম তামিলের অভ্যাস অনেক আগেই ছেড়েছেন পাক সেনাপতিরা। তাদের দয়ার উপর নির্ভর করেই বেঁচে ছিল রাজনৈতিক দলগুলাে। এখন কর্তা হলেন ভৃত্য এবং ভৃত্য হলেন কর্তা। এই ওলটপালট হয়ত বেশিদিন টিকবে না। সুযােগ এলেই জঙ্গীচক্র আবার হয়ত বার করবে তাদের নখদন্ত। লড়াইএ যেগুলাে ভেঙ্গে গেছে তা গজাবার জন্য শুধু অপেক্ষা।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেছে পাক জনতার। শেষ মুহূর্তে তারা জেনেছে চৌদ্দদিনের লড়াই এ পাকিস্তানের পরাজয়। বাংলাদেশ চিরদিনের জন্য হাতছাড়া। পশ্চিমের জনতাকে অন্ধকারে রেখেছিলেন জঙ্গিচক্র। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন এবং পশ্চিমে অস্ত্রসম্বরণ জনগণের দৃষ্টিতে এক অভাবনীয় ঘটনা। নিমেষের মধ্যে চুরমার হয়ে গেছে বহুদিনের তাতান আত্মপ্রত্যয়। খানখান হয়েছে সামরিক শাসকদের উপর একনিষ্ঠ আস্থা। গর্জে উঠেছেন প্রাক্তন এয়ারমার্শাল অসাগর খান। তার প্রকাশ্য দাবী ইয়াহিয়ার পদত্যাগ। সামরিক নেতাদের বিচার। ইয়াহিয়ার দেশত্যাগের পথঘাট বন্ধ করার জন্য তিনি অনুরােধ জানিয়েছিলেন পাক বিমানবহরে অধিনায়কের কাছে। এটা নিঃসন্দেহে বিদ্রোহ ঘােষণা। ইয়াহিয়া এবং তাঁর সহচরদের বন্দী করার ইঙ্গিতপূর্ণ আহ্বান। ভুট্টোর সামনে জটিল সমস্যা। নিজের মুলুক সিন্ধুর স্বাতন্ত্রের দাবী উচ্চগামী। বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ হয়ত ধরবে অস্ত্র। এসব আন্দোলন দমনের জন্য প্রয়ােজন সৈন্যবাহিনীর। ওরা যখন স্বজাতি নিধনে ময়দানে নামবে তখন ভুট্টোর বিরুদ্ধেও উঠবে হাজার কণ্ঠের ধিক্কার। হৃত মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে সামরিক গােষ্ঠী। পাকিস্তানের বিস্তৃত এলাকা ভারতের দখলে। স্বস্তি পরিষদে জল ঘােলা করে লাভ নেই। ভুট্টোকে ছাড়তে হবে কাশ্মীরের অধিকৃত ভূভাগ। তা না হলে হয়ত জওয়ানেরা ফিরবে না স্বদেশের সীমানায়। এবারের সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি সরাসরি বিজয়ী ভারত এবং পরাজিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। কোন তৃতীয় শক্তির মধ্যস্ততা কিংবা স্বস্তি পরিষদ সেখানে অচল।
সহজে নাকখত দেবেন না জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন তিনি। শীঘ্রই যাবেন চীন সফরে। পিকিং এর সঙ্গে নাকি করবেন সামরিক চুক্তি। সবাই জানে চীনে চেলা ভুট্টো। তার ক্ষমতা প্রাপ্তির সুযােগ দু’হাতে লুফে নেবেন পিকিং নেতারা। দুরে দাঁড়িয়ে দেখবে আমেরিকা কিম্বা সম্ভাব্য ভারতবিরােধী জেহাদে সে হবে চীনের সহযােগী। জল কতদূর গড়াবে, বলা মুস্কিল। অস্ত্রসম্বরণ আবার অস্ত্র ধারণের রূপ নিলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। সাবধানে পা বাড়াতে হবে ভারতকে। ভুট্টোকে বিশ্বাস নাই। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ ভারতবিদ্বেষে পরিণত করার চেষ্টা তাঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। নূতন করে যুদ্ধারম্ভ সহজ নয়। পাক সামরিক নায়করা তুঝতে পেরেছেন নিজেদের হিম্মত। চৌদ্দদিনের লড়াই এর পরিণতি তাদের হঠকারিতার জ্বলন্ত সাক্ষী। ভারতের হাতে লক্ষাধিক পাক যুদ্ধবন্দী ভবিষ্যতের দুরন্ত হুঁশিয়ারী। তবু সােজা হয়ে দাঁড়াবার শেষ কসরত করবে পাকিস্তান। চীন এবং আমেরিকা জোগাবে অস্ত্র। লড়াই এ খােয়ান সমর সরঞ্জামের পরিপূরণে দেরী না হবারই কথা। পাকিস্তান কি সইতে পারবে এ ভার? কামধেনু বাংলাদেশকে দোহনের পালা সমাপ্ত। আর্থিক সঙটের দিন আগত। কতদিক সামলাবেন ভুট্টো। কক্ষচ্যুত পাকিস্তান। পশ্চিমের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিয়ে কোনমতে সে টিকিয়ে রাখবে নিজের অস্তিত্ব। পূবের বাংলা স্বাধীন। ভুট্টোর পশ্চিম হতে যাচ্ছে চীনের তাবেদার। আমেরিকা গুণবে প্রমাদ। বঙ্গোপসাগরে সে পাঠাল সপ্তম নৌবহর, আর পশ্চিম পাকিস্তানে চীনা হাট বসাবেন পিকিং? এ অপমান বেশিদিন সইবে না আমেরিকা। অদূরভবিষ্যতে নির্বাচনে নামতে হবে ভুট্টোকে। ফলাফল তার অনুকূলে যাবে কিনা সন্দেহ। তার আগে যদি সুরু হয় গৃহযুদ্ধ তবে ঘটবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামাে গঠনের সব জল্পনাকল্পনার অবসান। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ্যে কি আছে জানা নেই। তবে এ কথা সত্য অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। যে পাকিস্তান এখন অবশিষ্ট রইল তা হবে পশ্চিম এশিয়ার উচ্ছিষ্ট। মােল্লাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলাে নিয়ে হয়তাে গড়ে উঠবে একটি সামরিক জোট। ইরান নেবে তার নেতৃত্ব। পশ্চিম পাকিস্তান হবে তার তল্পীবাহক। এই আঁতাতের উপর পড়বে মার্কিন আশির্বাদ।গদীতে থাকবেন না ভুট্টো। ছিটকে পড়বে চীন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১