অপমানে নারীত্বের প্রতিষ্ঠা
পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে যে সমস্ত নারী আক্রান্ত অপমানিত ও ধর্ষিত হয়ে আত্মগ্লানী ভােগ করছেন, বাংলাদেশ সাধারণতন্ত্রের পুনর্বসতি, ত্রাণ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীকামারুজ্জমান বলেছেন, তাঁরা সবাই যুদ্ধবীর রূপে গণ্য হবেন। রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা যে ত্যাগ, সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, এদের ত্যাগ ও দুঃখবরণ তার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। এদের বিনষ্ট সম্মান পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং সমাজে ন্যায্য মানবিক অধিকারে যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন এ’রা, তার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অপমানিত নারীত্বের পুনরুদ্ধারকে তাদের কার্যসূচীতে দিতে হবে অগ্রাধিকার।
ঘােষণাটি সুন্দর এবং সহস্র সাধুবাদে সম্বর্ধিত হবার যােগ্য। প্রাচ্যদেশীয় গোঁড়ামী বলেই আমরা এখনাে দুবৃত্তের হাতে হতমান নারীকে শুচিতাভ্রষ্ট ভাবতে অভ্যস্ত রয়েছি। তার ফলে যাদের আমরা পৈশাচিক আক্রমণের থাবা থেকে বাঁচাতে পারি না আপন ক্ষমতার অভাবে, তারা যখন সর্বস্ব খুইয়ে ঘরে ফিরে আসেন, তাদের আমরা বিচারবিহীন কৌলীন্যের নামে দূরে ঠেলে দিই। এই মনােভাব আজ বদলাতে সুরু করেছে অবশ্য। আজ আমরা বুঝতে আরম্ভ করেছি যে কুকুরে কামড়ান বা ষাড়ে গুঁতানর মত ঘটনার বেশী কিছু নয় ওসব। ওজন্যে নিরপরাধ নারীদের দায়ী করা মূঢ়তা। বাংলাদেশ সাধারণতন্ত্রের নায়করা সেই বােধকে আজ এই সরকারি সনদের মধ্যে অভিব্যক্তি দিয়ে সকলের ধন্যবাদাহ হলেন।
ভগবদগীতায় যুদ্ধের কুশ্রীতা বর্ণনা করে বলা হয়েছে যুদ্ধে কুলনারীর সম্ভ্রম বিনষ্ট হয় এবং তাদের বাধ্য হতে হয় বর্ণসঙ্করের মাতৃত্ব গ্রহণ করতে। একথা যে কত সত্য তা যেকোন যুদ্ধের সামাজিক পটভূমি সন্ধান করলেই জানা যাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কে যে অবৈধ সন্তানরা দেখা দিয়াছিল, মুস্তাফা কামাল পাশা তাঁদের পিতৃত্ব স্বীকার করেই কামাল আতাতুর্ক হয়েছিলেন। ফ্রান্সে, জার্মাণীতে ও রাশিয়াতেও মিশ্র রক্তের নরনারীকে বৈধ নাগরিকতা দেওয়া নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র নেতাদের প্রচুর মাথা ঘামাতে হয়েছিল। রক্ষণশীল বৃটেনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কুমারী এবং স্বামী সংস্রব ভ্রষ্ট নারীদের সন্তান লাভের সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অনুরূপ ঘটনা কিছু ঘটেছিল এদেশেও।
সবাই জানেন বাংলাদেশে পাকিস্তানি দুষমনরা নির্বিচারে গ্রাম নগর জ্বালিয়েছে। বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষদের ধরে ধরে যত্রতত্র নির্বিচারে খুন করেছে। কুল নারীদের পশু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যে বন্দুক দেখিয়ে দলে দলে ঘরের বাইরে নিয়ে গেছে। সেই অসহায় অত্যাচারিত মা বােনেদের কিছু অংশ দুবৃত্তদের হাতে প্রাণই হারিয়েছেন। যারা রক্ষা পেয়েছেন, সর্বস্ব খুইয়ে সমাজের একান্তে তারা অসীম মনােবেদনা ও আত্ম ধিক্কারের মধ্যে বেঁচে আছেন। তাঁদের মানুষের অধিকারে পুন:প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যেমন চাই, তেমনি চাই অনুকূল সামাজিক সুবিচারের ঔদার্যও। আশা করি দুঃখ জয়ী পূর্ব বাংলার মানুষ এই দুইই সমভাবে দেখাবেন। যেখানে নারীরা সম্মানিত হন সেখানে দেবতারা বিহার করেন এই কথা বলেছেন হিন্দুশাস্ত্র। কিন্তু কথাটা সব দেশ ও সর্বশ্রেণীর ক্ষেত্রেই সমান সত্য।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১