You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.22 | প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর হুঙ্কার | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর হুঙ্কার

ক্ষেপে উঠেছেন ভুট্টো। তিনি প্রতিশােধ নেবেন- নির্মম প্রতিশােধ নেবেন। পাকিস্তানের অঙ্গ থেকে জওয়ানদের মারের চিহ্নগুলাে একেবারে মুছে ফেলবেন। প্রেসিডেন্টের তখতে বসার পরমুহূর্তেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি শুধু প্রেসিডেন্টই নন, মুখ্য সামরিক প্রশাসকও বটে। তাই যেখানে সেখানে দেখাচ্ছেন মিলিটারি মেজাজ। বাঘের চামড়ায় মােড়া একটি শিয়াল দিতে চাচ্ছে বাঘের হুঙ্কার। কিন্তু বেরিয়ে আসছে হুক্কাহুয়া আওয়াজ। ইতিমধ্যেই তিনি ইসু করছেন ডজনখানেক ফরমান। জওয়ানদের প্রতি তাঁর নির্দেশ-পূর্ব পাকিস্তান এবং অধিকৃত পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড ছাড়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রামের প্রতি তাঁর হুঁশিয়ারী-সাময়িক জয়ের আনন্দে বেশী নাচানাচি করাে না। মুজিব সম্পর্কে ভুট্টোর স্পষ্ট জবাব-তাকে ছাড়বাে কি ছাড়বাে না তা এখন বলব না। জনমত যাচাই করতে হবে। এ অঞ্চলে (পশ্চিম পাকিস্তানে) তিনি জনগণের চক্ষুশূল। বাংলাদেশের জনতার কাছে তার আবেদনঅতীত ভুলে যাও। ক্ষ্যামা ঘেন্না করে নাও। পূর্ব পাকিস্তান গােটা পাকিস্তানের অচ্ছেদ্য অংশ। পাক রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে একটি শিথিল ফেডারেশন গঠনের ভিত্তিতে আপােস আলােচনা চলতে পারে। ভুট্টোর সব কথাই উন্মাদের প্রলাপ এবং বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন।
ট্যাঙ্ক, জঙ্গী বিমান এবং যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে পাক সৈন্যরা রােধ করতে পারে নি জওয়ানদের অগ্রগতি। আর এই যুদ্ধবিজয়ীরা এখন বিজিত পাক প্রেসিডেন্টের ভূকুটিতে ছেড়ে আসবেন অধিকৃত পাকভূমি? এমন। কল্পনা একমাত্র ভুট্টোরই সাজে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বিজয়ী ভারতীয় বাহিনীর নেতা। তিনি বড়াই করবেন না, তা করবেন থেতানাে মুখে জুলফিকার আলী ভুট্টো। ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকা উচিত। এই সিন্ধি নেতার স্পর্ধা সীমাহীন। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর সৈন্যদল ভারতীয় জওয়ানদের হাতে হাত মিলিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছেন পাক ঘাতকদের। ভাগ্য বিড়ম্বনায় মুজিব আজ ভুট্টোর বন্দী। তাঁকে কারাগারে রেখে বাংলাদেশ উদ্ধারের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সিন্ধি শয়তান। ইয়াহিয়ার অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্তির ভার নিয়েছেন তিনি। মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে অবাঞ্ছিত। বাংলাদেশে ভুট্টো কি খুবই জনপ্রিয়? পশ্চিম পাকিস্তান জয় করতে চান নি মুজিব। তার কল্পনা স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিফৌজ এবং বাঙালী জনতা সার্থক করেছেন মুজিবের স্বপ্ন। ভারতীয় জওয়ানরা হয়েছেন তাদের সহযােগী। জয় বাংলা পতাকা উড়ছে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গৃহের চূড়ায় চূড়ায়-ক্যান্টনমেন্ট গুলাের শীর্ষে শীর্ষে। হাজার হাজার পাক দস্যু আজ যুদ্ধবন্দী। জনতা মুক্তির আনন্দে আত্মহারা। এদেরই দাসত্ব শৃঙ্খল পায়ে পরবার জন্য আহ্বান করছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। নিজের জনপ্রিয়তায় থেকে থাকে যদি তাঁর গভীর প্রত্যয় তবে চলে আসুন বাংলাদেশে। দেখুন জান নিয়ে ফিরতে পারেন কিনা। লক্ষ লক্ষ হাত পাক। দুশমনের পিঠের চামড়া তুলে নিতে উৎসুক। গণহত্যার প্রতিশােধের জন্য তাঁরা পাগল। রক্ত-তৃষিত বাঙালিকে একমাত্র শান্ত করতে পারেন মুজিবুর রহমান। তাঁকে বন্দীশালায় রাখার অর্থ-বাংলাদেশে পাক তাঁবেদারদের কবর সৃষ্টি। একথা ভুললে চলবে না যে, পাকিস্তানের বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য দায়ী একমাত্র ইয়াহিয়া খান নন, তার সহযােগী ভুট্টোও সমভাবে দায়ী। এই মানবদ্রোহী এবং গণতন্ত্রের অপঘাতকের প্ররােচনাতেই বাংলাদেশের উপর নেমে এসেছিল পাক জল্লাদের খাড়া। এই শয়তানের উস্কানীতেই ইয়াহিয়া নেমেছিলেন লড়াই-এর ময়দানে। ডেকে এনেছিলেন পাক বাহিনীর বিপর্যয়। ইয়াহিয়া খান যদি ভুল করে থাকেন তবে সে ভুলের প্রশ্রয় কি দেন নি জুলফিকার আলি ভুট্টো? গত মার্চ মাসে কেন ভেঙ্গে গেল মুজিব ইয়হিয়া আলােচনা? কেন বসল না গণপরিষদ? কেন পাকবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালাল নিরস্ত্র জনতার উপর? তার গােপন রহস্য কি জানেন না ভুট্টো? তিনি কি পরবর্তীকালের রক্তাক্ত ইতিহাসের অন্যতম স্রষ্টা নন?
কোথায় আজ সত্যদর্শী পক জনতা? প্রচণ্ড আঘাতের পরও কি ফিরবে না তাদের সম্বিত? ইয়াহিয়ার সঙ্গে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাও রক্তলােলুপ ভুট্টোকে। চাও তার কাছে গণহত্যার কৈফিয়ৎ। গত ন’মাস ধরে বাংলাদেশে চলছে ইয়াহিয়ার তাণ্ডব। কেন চুপ করে ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো? আজ ক্ষমতার আসনে বসেও কেন ঘাড় ধরে জনতার সামনে টেনে আনছেন না দস্যুসর্দার টিকা খানকে? অতি ধুরন্ধর এই সিন্ধি নেতা। তিনি জানেন, কোথায় তার ক্ষমতার উৎস। ধিকৃতি আয়ুব ক্ষমতার আসনে বসিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খানকে। সময় বুঝে সটকে পড়েছিলেন তিনি। নাককাটা ইয়াহিয়া হাত ধরে ভুট্টোকে টেনে এনেছেন ক্ষমতার পাদপ্রদীপের সামনে। আয়ুবের মত ইয়াহিয়াও নিয়েছেন বিদায়। পিছনে রেখে গেছেন আসল ক্ষমতার জিম্মাদার সেনাবাহিনীর অন্যান্য জেনারেলকে। মিলিটারী বেয়ােনেটের উপর নৈবেদ্যের কলার মত বসে আছেন ভুট্টো। একটু নড়চড় হলেই ছিটকে পড়বেন মাটিতে। সাবধান ভারত। তাড়াহুড়া করে কিছুতেই ছাড়া হবে না যুদ্ধবন্দী এবং অধিকৃত পাক এলাকা। তার আগে চাই ভুট্টোর নাকখত, যুদ্ধপরাধীদের বিচার এবং কাশ্মীরের ফয়সালা। ভুট্টোর প্রতিশােধের হুমকি ভবিষ্যতের অশুভ ইঙ্গিতবাহী। বিষাক্ত সাপ এ বিষদাত ভাঙ্গে নি। এখনও সে ফুসফুস করছে। ভাঙ্গতে হবে ভুট্টোর বিষদাঁত। থেবড়া করতে হবে তার মুখ। তারপর শান্তি আলােচনা। নইলে ভুট্টোর আড়াল থেকে যথাসময়ে বেরিয়ে আসবে সেই সর্বনাশা জঙ্গীশাহী।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১