You dont have javascript enabled! Please enable it!

এরা কি শুধুই যুদ্ধবন্দী, না যুদ্ধ-অপরাধী?

আজ এই প্রশ্ন খুব স্পষ্টভাবে তােলবার সময় এসেছে যে, বাংলাদেশে যে পাকিস্তানি দস্যুরা আত্মসমর্পণ করেছে তারা সত্যিই নিছক যুদ্ধবন্দী হিসেবে গণ্য হওয়ার যােগ্য কিনা? আমরা জানি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই হয়েছে এবং সেই লড়াই আপাতত: শেষ হওয়ার পর যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে জেনিভা চুক্তি মেনে চলারও একটা বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এ কথাও কি সত্যি নয় যে, এই লড়াই শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের লড়াইয়ে পরিণত হলেও আগাগােড়া আর একটি দেশের বাংলাদেশের-মানুষ এই লড়াইয়ের সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট? যে পাকিস্তানি ফৌজ ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় ফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তারা কি শুধুই ভারতের সঙ্গে সংগ্রামরত ছিল, না তারা ছিল বাংলাদেশের বুকের ওপর এক দখলদার বাহিনী? একটি দখলদার বাহিনীর পক্ষে একটি উপনিবেশের মানুষের ওপর যতরকম অত্যাচার সম্ভব তার সবই কি তারা করেনি? আমরা জানি যে, লড়াই শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে পাক ফৌজকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে জেনারেল মানেকশ যে বিবৃতি প্রচার করেছিলেন তাতে এই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে, আত্মসমর্পণের পর যুদ্ধবন্দীদের প্রতি জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী আচরণ করা হবে। আমরা এও জানি যে, লড়াইয়েরও একটা নিয়ম-কানুন আছে, কিন্তু সেই নিয়ম-কানুন কি শুধু এক পক্ষই মানবে? জেনারেল মানেকশর বিবৃতি যখন বেতারে প্রচারিত হচ্ছিল এবং তার মুদ্রিত বয়ান বিমান থেকে ঢাকার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখনই যে দখলদার পাক ফৌজ নিতান্ত ঠাণ্ডা মাথায় অসামরিক ব্যক্তিদের ধরে ধরে খুন করছিল তার মধ্যে যুদ্ধের নিয়ম-কানুন কতােটা পালিত হয়েছে?
বুদ্ধিজীবীদের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলি যে অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছিল, বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের বিবৃতিতে সেই আশঙ্কাই সমর্থিত হয়েছে। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে উপনিবেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য পাক ফৌজের এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের কথা জনাব কুদুস ফাঁস করে দিয়েছেন। এই শয়তানী চক্রান্তের নায়ক মেজর-জেনারেল ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার বসির এবং কর্নেল এজাজি। তাদেরই নির্দেশে ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বাঙালী, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, অধ্যাপক, সাংবাদিকদের খুন করা হয়েছে যুদ্ধ থামার ঠিক আগে। তবে এই গণহত্যা যে নিছকই যুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে মরীয়া হয়ে পাক সেনাপতিরা করেছেন সে-কথা ঠিক নয়। কারণ ঢাকার হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে যে গােপন দলিল পাওয়ার খবর আমাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, তা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই চক্রান্তের মূল অনেক গভীরে। ঐ দলিল থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন এবং বাঙালীর সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা যেহেতু অগ্রগণ্য তাই তাদের উপর পাকিস্তানি শাসকদের জাতক্রোধের কারণ বুঝতে অসুবিধে হয় না। ২৫ মার্চের ফৌজী তাণ্ডব সুরু হওয়ার পর থেকে এই বিশেষ শ্ৰেণীটির বিলুপ্তি সাধনের জন্যে পাক জঙ্গীশাহী চেষ্টারও কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ যে নারকীয় বর্বরতার শিকার হয়েছেন তা যদি আমরা মনে নাও রাখি (যদিও তা হয়ত মােটেই সম্ভব নয়) তবু ডিসেম্বর মাসে, অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি ফৌজ সেখানে অসামরিক জনতার উপর যে তাণ্ডব চালিয়েছে তার জন্যে তাদের যুদ্ধঅপরাধী বলে চিহ্নিত করা হবে না কেন? এই তাণ্ডবের যারা পরিকল্পনা করেছিল এবং ঐ পরিকল্পনা কার্যকর করার নির্দেশ জারী করেছিল সেই জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল ফরমান আলী থেকে সুরু করে অনেকেই আমাদের হাতে বন্দী। শুধু আত্মসমর্পণ করেছে বলেই কি তাদের সাত-খুন মাপ হয়ে যাবে? আত্মসমর্পণের পরেও পাক বাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণা কিছুমাত্র কমে নি। সেই ঘৃণা যাতে হিংস্র পথে প্রকাশ না পায় তার দিকে নজর রাখা অবশ্যই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু নিয়াজি বা ফরমান আলিকে জনতার রােষ থেকে রক্ষা করা হলেও তাদের আইনের হাত থেকেও রক্ষা। করতে হবে এমন কোন কথা নেই। এদের মতাে নরপশু সৈনিক বলে পার পেয়ে যেতে পারে না, কারণ এরা যে কোন সেনাবাহিনীর কলঙ্ক। এদের কেন তুলে দেয়া হবে না ঘৃণ্যতম যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে বিচারের জন্যে একটি ট্রাইব্যুনালের হাতে? অন্যান্যদের মধ্যে এই দাবী তুলেছেন বৃটিশ এম পি জন স্টোন হাউস। আর ইতিমধ্যে আমাদের সেনাপতিরা কি পাক যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যতােটুকু দরকার ঠিক ততােটুকুই সৌজন্য দেখাতে পারেন না? এমন ধারণা কখনােই সৃষ্টি হতে দেওয়া উচিত নয় যে, ভারতীয় বাহিনী পাক ফৌজকে তাদের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি খাতির করেছে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!