You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.13 | ফরমানের আর্তনাদ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ফরমানের আর্তনাদ

পাক সৈন্যদের মৃত্যুফাদ বাংলাদেশ। জান বাঁচাবার জন্য ওরা পাগল। কিন্তু জান বাঁচাবে কি করে? পালাবার সব পথ বন্ধ। বুদ্ধিতে বেড় না পেয়ে মেজর জেনারেল ফরমান আলী চিঠি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রসংঘের জেনারেল সেক্রেটারী উ থান্ট কে। তাঁর করুণ মিনতি তিনি (উ থান্ট) যেন অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেন। চিঠিটা পেয়ে রাষ্ট্রসংঘের সদর দপ্তর চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। তারা সলাপরামর্শেও বসেছিলেন। মাঝপথেই থেমে গেল সব গুঞ্জন। ইয়াহিয়ার ক্রুদ্ধ জবাব মেজর জেনারেল ফরমানের আবেদন অনুমােদিত। তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে রােমাঞ্চকর। মেজর জেনারেল ফরমান আলী বাংলাদেশ পাক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা। স্থানীয় সেনাপতিদের এবং ইসলামাবাদের কর্তাদের পাশ কাটিয়ে তিনি সরাসরি আবেদন করেছিলেন রাষ্ট্রসংঘের কাছে। মনে হয়, বাংলাদেশ পাক সমর নেতারা পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইসলামাবাদের সঙ্গেও তাদের কোন যােগাযােগ আছে কিনা সন্দেহ। হয়ত ঢাকার সমর নায়করা ভেবেছিলেন-দুর্গরক্ষা অসম্ভব। বেশী বাড়াবাড়ি করলে সবশুদ্ধ মারা যাবেন। ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মর্যাদায় বাধে। অগতির গতি রাষ্ট্রসংঘের কাছে আবেদন জানানােই বুদ্ধিমানের কাজ। সঙ্গে রয়েছে সামরিক শৃঙ্খলার প্রশ্ন। তাদের কি নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামাবাদ জানা নেই। বড় কর্তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে গেলে সামরিক আদালতে আসামীদের বিচার অনিবার্য। হয়ত সবার প্রাণ এবং মর্যাদা বাচাবার তাগিদে মেজর জেনারেল ফরমান আলীনিজেই নিতে চেয়েছিলেন সম্ভাব্য শহীদের ভূমিকা।
একটা কথা এখন খুবই স্পষ্ট যে, ঢাকার পতন আসন্ন। আন ক’দিনের মধ্যেই ঘটবে বাংলাদেশ পাক বাহিনীর সমূল উচ্ছেদ। জওয়ান এবং মুক্তিফৌজীরা অকটোপাশের মত জড়িয়ে ধরেছেন দস্যুদলকে। শুধুমাত্র গলাটিপে মারার অপেক্ষা। ইতিমধ্যেই দু হাজারের বেশী পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। যারা পালাচ্ছে তারা কিসের আশায় পালাচ্ছে তারাই জানে। ঢাকায় জমা হয়ে শেষ প্রতিরােধ আত্মহত্যার সামিল। মাথার উপরে নেই বিমান আচ্ছাদন। লড়াই এর আশ মিটে গেছে অনেক আগেই। কদিন আর টিকতে পরবে ওরা। ঢাকার অধিকার দুচার দিন ধরে রেখে কি লাভ তাদের? কোন তৃতীয় রাষ্ট্র এদের উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না। পাকিস্তানের অনুকূলে বাংলাদেশের লড়াই পশ্চিমে ফয়সালা হওয়া অসম্ভব।
যুদ্ধের গতি পাল্টিয়ে দিয়েছে ভারত। ইয়াহিয়ার হাত-পা বাঁধা। জল স্থল এবং আকাশ পথে কোন সাহায্য পাঠাতে পারবেন না তিনি দূর্গত পাকসৈন্যদের। ওদের সামনে আত্মসমর্পন কিম্বা মৃত্যু এ দুটি পথ ছাড়া আর কোন পথ খােলা নেইবারবার হুশিয়ারী দিচ্ছেন জেনারেল মানেকশ। তিনি দেখাচ্ছেন বাঁচার পথ। ভিতরে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু বাইরে বাংলাদেশের পাক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লে: জেনারেল নিয়াজি অনড়। তিনি ঢাকার হােটেল ইন্টারন্যাশনাল গিয়ে বলে এসেছেন— আমি পালাই নি। সৈন্যদের সঙ্গেই আছি। তার না পাল্টানােটা ইচ্ছাকৃত নয়। আসল কথা তিনি পালাবার চেষ্টা করেও পথ খুঁজে পান নি। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী এবং তাদের পার্শ্বচররা মানুস নন, এক একটা দানব। গণহত্যা চালাতেও যেমন তাদের বিবেকে বাধে না, নিজেদের সৈন্যদলকেও নিশ্চিৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেও তেমনি তাদের মনে দাগ কাটেনা। বাংলাদেশে হাজার হাজার পাক সৈন্যকে বলিদানের প্রস্তুতিপর্বই তার প্রমাণ।
ডুবন্ত মানুসের বুদ্দি বিপর্যয় সাধারণ ঘটনা। মেজর জেনারেল ফরমান কি বুঝতে পারছেন না তার অবরুদ্ধ সৈন্যদলকে উদ্ধার করা রাষ্ট্রসংঘের ক্ষমতার বাইরে? ভারত কি এতই বেকুব ফাদে পড়া শত্রু সৈন্যদের সে ছেড়ে দেবে? সে কি জানেনা, ওরা পশ্চিম পাকিস্তানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যাবে সীমান্তে? ঝাপিয়ে পড়বে জওয়ানদের উপর? যুদ্ধমান কোন পক্ষই অস্ত্র সম্বরণ করেন নি। পশ্চিমে এখনও চলছে প্রচণ্ড লড়াই। এ অবস্থায় কৌশলে বাংলাদেশের অবরুদ্ধ পাক বাহিনীকে মুক্ত করতে আসার অর্থ জওয়ানদের বুলেটের মুখােমুখী হওয়া। রাষ্ট্রসংঘের পক্ষে এ কাজের দায়ীত্ব গ্রহণ কল্পনাতীত। তবে কেন এই অসম্ভব পায়তারা? হয়ত এটা ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে মেজর জেনারেল ফরমানের প্রকাশ্য বিদ্রোহ কিম্বা বুদ্ধি বুদ্ধিভ্রংশ নেতার অস্থির পদচারণা। আত্মসমর্পণে যদি সরম লাগে তবে মৃত্যুবরণই তাে বীরের পথ। যারা নির্বিচারে হনন করেছে হাজার হাজার নিরস্ত্র নর নারী তাদের কেন এত মৃত্যুভয়? হয়ত ওরা ভাবছে গত ন’মাস ধরে যে অপরাধ তারা করেছে। তা থেকে মুক্তি নেই। টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলবে তাদের বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষ। পাক দুশমনদের তান্ডব থেকে যারা আত্মরক্ষা করতে পেরেছেন তাদের আজ চোখের জল মুছে ফেলার দিন। একবার তাকান ঢাকার দিকে। দেখুন নরপশুদের মুখে মৃত্যুযন্ত্রণা।ওরা কাঁপচে বলির পাঠার মত কাঁপছে। যে মাটিতে তারা মেরেছে বুটের ঠোক্কর, যে মাটিতে তারা এনেছে রক্তস্রোত এবং যে মাটিতে বানিয়েছে তারা শবের পাহাড় সে মাটিতে নাকে খত দিতে হবে তাদের। ন্যায়ের দণ্ড ঝুলছে মাথার উপর। ওটা নেমে আসবে অচিরে। মেজর জেনারেল ফরমানের আর্তনাদ মুমুর্মুর অন্তিম চীৎকার। কামানের গােলায় স্তব্ধ হবে এ আর্তনাদ। জওয়ান এবং মুক্তিফৌজীদের পদ তাড়নায় কাঁপছে ঢাকার পথ। এ পথের শেষ অদূরে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১