You dont have javascript enabled! Please enable it!

এখন প্রথম কাজ উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়া

বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ একথা একাধিকবার দ্বিধাহীন ভাষায় ঘােষণা করেছেন যে, পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তানি অত্যাচারের ফলে যেসব শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই সসম্মানে, পূর্ণ অধিকার নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবেন। গত শনিবার মুক্ত যশােহর শহরে এক বিশাল জনসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই ঘােষণাই আবার নতুন করে উচ্চারণ করে বলেছেন, যারা অবস্থার সূযােগ নিয়ে বাস্তুত্যাগীদের সম্পত্তি দখল করেছে সেই সম্পত্তি আবার প্রকৃত মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। দখলদাররা যদি স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দেয় তাহলে তাদের শাস্তির মাত্রা হবে কম। আর যদি তা না দেয় তাহলে মুক্তিবাহিনী সম্পত্তি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেবা ব্যবস্থা করবে।
সুতরাং বাংলাদেশ সরকার তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং শরণার্থীদের সংশয়াচ্ছন্ন হবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রদায়ীক রাজনৈতিক দলগুলির সেখানে কোন স্থান থাকবে না। যে ভয়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে আতঙ্কিত আর আর অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে তারা দেশ ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন, তাদের ফিরে যাবার পরিস্থিতি আদৌ সেরকম নয়। তারা এসেছিলেন পাকিস্তান থেকে পলাতক হয়ে; তারা ফিরে যাবেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে।
তবু এক কোটি উদ্বাস্তুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটা খুব সহজ কিংবা জটিলতামুক্ত নয়। এর জন্য বিরাট প্রশাসনিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন আছে। ঐ বিভিষিকাময় দিনগুলিতে অনেকেই প্রানের ভয়ে তাদের বিষয় সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে এসেছেন। সেই সব সম্পত্তির কিছু কিছু মুক্তিবাহিনীর লােকেরা নিজেরাই রক্ষা করছে, কিন্তু অধিকাংশই লুষ্ঠিত এবং বেদখল হয়ে গেছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু উদ্বাস্তুদের ফিরতে হলে ঐ সব হৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া এমন বহু শরণার্থী আছেন যাদের জমিটি হয়ত অক্ষত আছে কিন্তু বাড়িটি নেই। তাই এমন কিছু আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা দরকার যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে গিয়ে খােলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য না হয়।
এই সব কাজ একদিনের ব্যাপর নয়।, কিংবা শুধু মুখের কথাতেই সম্পন্ন হয়ে যাবে না। একদিকে যেমন এটা দেখতে হবে যেন শরণার্থীরা কোনদিক দিয়ে বঞ্চিত না হন, তেমনিএটাও দেখা দরকার শরণার্থীদের মধ্যেও কোন সূযােগ সন্ধানী যেন অতিরিক্ত লাভবান হবার চেষ্টা না করে। এটা ব্যাপকতম প্রশাসনিক তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয়, এবং প্রশাসনিক যন্ত্র সেইভাবে গােড়ে তােলার আগে উদ্বাস্তুরা ব্যাপক সংখ্যায় ফিরতে শুরু করলে নানারকম জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। তারা এ ব্যাপারে ভারতীয় উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী, আর কে, খালিদকরের সঙ্গে আলােচনাও করেছেন। আমরা শুধু তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই ব্যাপারে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার দরকার আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের সামনে এটাই পয়লা নম্বর সমস্যা, কেবল এই জন্যে নয় যে, এর সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠণের প্রশ্নটিও জড়িত আছে, এই জন্যেও যে, এই উদ্বাস্তু প্রশ্নটিকেও কেন্দ্র কওেন বাংলাদেশ সংক্রান্ত রাজনীতি অনেকখানি আবর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কায়ে হবার পর শরণার্থীদের আর বেশিদিন ভারতীয় শিবিরিগুলিতে আটক রাখা যাবেনা। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সেটা উচিত ও নয়। এবং আমাদের মতে মনস্ত ত্ত্বিক পুনর্বাসনের খাতিরেই বাংলাদেশ সরকার উদ্বাস্তুদের জন্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কায়েকটি ট্রানজিট ক্যাম্প খােলার কথা ভেবে দেখতে পারেন।
কিন্তু এটা শুধু প্রশাসনিক ঈখস্তুতিরও ব্যাপার নয়। সামাজিক, বৈষয়িক ও মানুসিক সব দিক দিয়ে যাতে উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন লাভ করতে পারেন তার জন্য উপযুক্ত প্রচারের ও প্রয়ােজন। কেবল কয়েকটি জনসভায় ভাষন দিয়ে নয় গ্রামে গ্রামে কাজ করার প্রয়ােজন আছে। এই কাজ মুক্তিবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের চমৎকার কাজে লাগানাে যেতে পারে এবং এই কাজে অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকেও সঙ্গে নেওয়া উচিত। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ এই ব্যাপারে সহযােগীতার সর্বপ্রকার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার চাইলে এ বিষয়ে সেখানকার অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেরও সহযােগীতা নিশ্চয়ই পাবেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!