চীনা-মার্কিন ব্ল্যাকমেইল
মার্কিন সপ্তম নৌবহর নাকি বঙ্গোপসাগরে ঢুকবে। বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রইজ এবং … ডেস্ট্রয়ার নাকি সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি দরিয়ায় অপেক্ষা করছে। হুকুম পেলেই ছুটবে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে। উদ্দেশ্য মহান অবরুদ্ধ ঢাকার মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার। এ-গুজব এতখানি সত্য, বলা মুস্কিল। মার্কিন মহল থেকেই ছড়ানাে হচ্ছে এসব কানাঘুষা। সঙ্গে ইর একটি খবর থাকা উচিত ছিল। সেটি হল, মার্কিন নৌবহরের পিছু পিছু ধাওয়া করছে সােভিয়েট নৌবহর। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে কেন বাদ পড়ল এই আনুষঙ্গিক সংবাদ? এশিয়ার কোন অঞ্চলে গন্ডগােল বাধলেই সেখানে যায় মার্কিন নৌবহর। চেলাদরে চাঙ্গা করে তােলাই এসব পাঁয়তারার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু মার্কিন কসরতের ধার কমিয়ে দিয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। ১৯৬৭ সালে আরব ইস্রাইল লড়াই-এর সময় মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের আবির্ভাব ঘটেছিল মিশরের কাছাকাছি দরিয়ায়। তাদের পিছু নিয়েছিল সােভিয়েট নৌবহর। ১৯৭০ সালে জর্ডানের গৃহযুদ্ধের সময় বাদশা হােসেনের দিলখুশের জন্য গিয়েছিল মার্কিন নৌবহর। বেশী বাড়াবাড়ি সম্ভব হয়নি। কারণ, তাদের অদূরে ঘােরাফেরা করছিল সােভিয়েট নৌবহর। প্রতিবারই মার্কিন অজুহাত ছিল, বিপন্ন মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার। একবার ও তারা এই ত্রাণকার্যে নামেনি। শুধু পাঁয়তারাই সার।
হঠাৎ ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের কি দরকার পড়ল? দুদিন আগেও অসামরিক বিমানে অনেক বিদেশী নাগরিক ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে শতাধিক মার্কিন নাগরিক ও ছিলেন। বাকী যারা পড়ে রয়েছেন, তারা অনায়াসেই এই সুযােগ নিতে পারতেন। সব রকমের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন নয়দিল্লী। এখন কেন দরকার পড়র পারমানবিক শক্তি চালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজের। ওদের কি মতলব -ভারতকে ব্ল্যাকমেইল, না বােম্বেটেগিরি?
বােম্বেটেগিরির সাধ্য আমেরিকার নেই। তা করতে গেলে সােভিয়েট নৌবহর আটকাবে পথ এবং মার্কিন জনমত হয়ে উঠবে উত্তাল। ভিয়েতনামের মার খাবার পর নতুন নাঙ্গনে জড়িয়ে পড়া প্রেসিডেন্ট নিকসনের পক্ষে সম্ভব নয়। তার পরিণতি ভয়াবহ। হয়ত মস্কো ওয়াশিংটনের হট-লাইন জ্বলে উঠবে। এমন মুখ অবশ্যই আমেরিকা নয়। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ক্রমেই নিবিড়ভাবে গড়ে উটছে চীন, আমেরিকা এবং পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্য আঁতাত। সামনে এসে ডুবন্ত ইয়াহিয়াকে হাত ধরে টেনে তােলা ঝকমারী কাজ। তা করার ঝুকি ও কম নয়। এ-অবস্থায় দরকার গা বাঁচিয়ে ষড়যন্ত্র আঁটা এবং ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রসংঘের ভিতরে এবং বাইরে চলছে তার মহড়া। চীন নাকি সৈন্য সাজাচ্ছে বারত সীমান্তে। তুরস্ক নাকি নিজের বিমানেঅস্ত্র সরবরাহ করবে পাকিস্তানে। আমেরিকাও নাকি যুদ্ধ-জাহাজে তুলে নেবে ঢাকার মার্কিন নাগরিকদের। এদের ধারণা, এসব কসরতের ফলে ভারতের নৌবহর হয়ে পড়বে বেকার এবং বাংলাদেশ থেকে মানে মানে সরে পড়বে ভারতীয় বাহিনী। আর সাত হাত মাটির নিচে সেধিয়ে যাবে মুক্তিফৌজিরা। যেমনি ইয়াহিয়া খান তেমনি তার দোস্ত প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং বিপ্লবি চৌ এন লাই। সবাই একত্রে রাজসভানন্দিত কণ্ঠে ধরেছেন মিলিটারী সঙ্গীত তাল ঠুকছেন ভুট্টো মিয়া। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন পিছনে সােভিয়েট রাশিয়া কতদূরে? সামনের ভারতীয় শ্রোতারাই বা কি করছেন? কি তাদের প্রতিক্রিয়া? ভয় পেয়েছি তাে? ইয়হিয়ার টুটি কি তারা ছাড়বে? ওর দম যে একেবারে বন্ধ হবার উপক্রম। গলা খুলছে না। শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে।
মনে রাখুন প্রেসিডেন্ট নিকসন মনে রাখুন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং হাজার বছর লড়নেওয়ালা জুলফিকার আলী ভুট্টো-বাংলাদেশ স্বাধীন। যার হাত সেখানে পড়বে তার হাত দুমড়ে যাবে। ঢাকার অবরুদ্ধ পাকবাহিনী কিছুতেই রেহাই পাবে না। বিশ্বের সব শয়তার একত্র হয়ে ও তাদের উদ্ধার করতে পারবে না। বহু ব্ল্যাকমেইল দেকেছে ভারত। প্রেসিডেন্ট নিকসনের একান্ত সহচর কিসিঙ্গারাই না শাসিয়ে গিয়েছিলেন নয়াদিল্লীকে – সম্ভাব্য পাক ভারত লড়াই -এ চীন হস্তক্ষেপ করলে আমেরিকা এগিয়ে আসবেনা ভারতের সাহায্যে। মার্কিন ধাপ্পাবাজীর এমনই মহিমা যে, আজ চীন এবং আমেরিকা একজোট হয়ে একত্রে ব্ল্যাকমেইল করছে নয়াদিল্লীকে। তাতে ঘাবড়াবে না ভারতীয় জনতা এবং শঙ্কিত হবে না বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি রাহুমুক্ত নরনারী। ইয়াহিয়া বলেছেন, এই যুদ্ধই তাঁর শেষ যুদ্ধ। সার্থক তাঁর প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশ হাতছাড়া। ওটা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। পশ্চিম পাকিস্তানের হার্ট দূর্বল। চীন এবং আমেরিকা তাকে দিচ্ছে কোরামিন ইনজেকসন। তারই প্রতিক ব্ল্যাকমেইল। ইয়াহিয়া যদি বেঁচেও ওঠেন, তবে কতটুকু ভুভাগ থাকবে তার হাতে? সিন্ধু বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দাবী ইবা তিনি ঠেকাবেন কি করে? তাঁর নিজের গদীই শেষ পর্যন্ত থাকবে তাে? এত বিপর্যয় কাটিয়ে আবার যুদ্ধ বাধাবার হিম্মত তার কিম্বা তাঁর উত্তরসূরীদের থাকবে না। কেন তবে নির্বোধের ব্ল্যাকমেইলের পাঁয়তারা? সত্যকে স্বীকার করে নাও। বাংলাদেশ থেকে নজর সরাও। জেনে রাখ- স্বাধীন বাংলাদেশে মার্কিন প্রবেশ নিষিদ্ধ। এর পর ভারতে মার্কিন ব্যবসা নিয়েও পড়বে টানাটানি। চীন এবং পশ্চিম পাকিস্তান কি পুরাতে পারবে এই ঘাটতি? একটু বুঝেসুজে চলুন প্রেসিডেন্ট নিকসন। বােম্বেটেগিরির দিন আর নেই। আর ব্ল্যাকমেইলও পুরানাে। ক্ষুদ্র পাখি নয় ভারত। ফাকা আওয়াজে ঢিপ ঢিপ করে উঠবে না তার বুক। সে জানে নির্মমভাবে বাংলাদেশ কেটেছে আমেরিকার নাক। চীনা নাক একেবারেই ভোতা। সুতরাং নাক কাটার ভয় নেই তার। চীনা নাকের সঙ্গে মার্কিনী কাটা নাকের যতই দোস্তীর ঘষাঘষি হােক না কেন তাতে বেরুবে না আগুন। ঝরবে শুধু রক্ত। তাতে ইয়াহিয়ার ভাঙ্গা কোমর লাগবে না। জোড়া।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১