You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাহুমুক্ত বাঙলাদেশ

বাংলাদেশ শান্ত। তার সব রণাঙ্গন স্তব্ধ। জওয়ানদের শাণিত অসি কোষবদ্ধ। তাদের কামানের মুখ থেকে আর মৃত্যু বেরিয়ে আসবে না। মুক্তিবাহিনীর রণ-হুঙ্কারে আর পাকি-দুষমনদের বুক কেঁপে উঠবে না। নিঃসর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন লে: জেনারেল নিয়াজী। যারা এতদিন বাংলাদেশে চালিয়েছে গণহত্যা এবং নারীধর্ষণ, তারা ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন সপ্তম নৌবহর রক্ষা করতে পারেনি তাদের। জওয়ান এবং মুক্তিযােদ্ধারা মানুষমারা যন্ত্র নয়। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেমেছিল তারা লড়াই-এর ময়দানে। তাদের বিজয় সম্পূর্ণ। দখলদার বাহিনীর হৃদপিণ্ড ঢাকা আজ রাহুমুক্ত। যেখানে উড়ত নরপশু ইয়াহিয়ার ঘৃণিত পতাকা, সেখানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের জয়ধ্বজা। লক্ষ লক্ষ নরনারী তাকে জানাচ্ছে সেলাম। গদানত শত্রু বিজয়ীর কৃপা-ভিখারী। জেনিভা কনভেনশনের যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা পাবে ওরা। যারা চালিয়েছে নিরস্ত্র জনতার উপর অকথ্য অত্যাচার, তাদের ভাগ্যে জুটবে মানবতার উদার ব্যবহার। বর্বর পশ্চিম পাকিস্তান নয়, ভারত এবং বাংলাদেশ। তারা দিয়েছে জেনিভা কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি। এ-প্রতিশ্রুতির খেলাপ হবে না।
মনে পড়ে গত ২৫শে মার্চের বিভীষিকার কথা। পাক-ঘাতকদের গুলীতে প্রাণ হারিয়েছিল হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। মনে পড়ে টিক্কা খানের নারকীয় তাণ্ডবের কথা। কত জনপদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কত ধর্ষিতা নারীর আকুল হাহাকারে বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। মনে পড়ে গৃহতাড়িত মানুষের মিছিল। তারা চলছে। দৃষ্টি ভারত-সীমান্ত। এখানে এলে পাবে তারা নিরাপদ আশ্রয়। এই সর্বহারার মিছিলগুলােও নিস্তার পায়নি ইয়াহিয়ার নেকড়েদের কবল থেকে। যখন-তখন চলেছে তাদের উপর মেসিনগানের গুলী। এক সর্বনাশা নারকীয় উৎসবে মেতে উঠেছিল জানােয়ারগুলাে। কোথায় আজ তাদের বীরপণা? কোথায় তাদেরর রণ-হুঙ্কার? কোথায় তাদের চোখে আগুনের কণা? সব আস্ফালনের অবসান ঘটেছে। চোখের জলে মনের আগুন নিভে গেছে। ওরা কৃপাপ্রার্থী এবং মানবিক ব্যবহারের কাঙ্গাল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে-যেদিন তারা বাংলাদেশে রক্তহহালীতে মেতেছিল, সেদিন কোথায় ছিল মানবতাবােধ? কোথায় ছিল বিশ্ববিবেক? কোথায় ছিল প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং তার দোসর চৌ এন লাই? নির্যাতিত বাংলাদেশের বুক ছিড়ে যখন বেরিয়ে এসেছে প্রতিশােধের আগ্নেয় প্রস্রবণ, তখন তাদের মধ্যে পড়ে গেছে হুড়ােহুড়ি। নরঘাতকদের রক্ষার জন্য। চলছে শয়তানের দাপাদাপি। দরকার নেই তাদের। পায়ের নীচে লুণ্ঠিত শত্রুকে মারবে না ভারত-প্রাণে মারবে না বাংলাদেশ। তাদের মানবতার আদর্শ হাজার হাজার বছরের পুরানাে। রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে আছে সভ্যতার প্রাচীন ধারা। তার অমর্যাদা হতে দেবে না ওরা। বাংলাদেশ সরকার অপরাধীর বিচার করবে-বদলা নেবে না।
সৃষ্টির নিদারুণ অভিশাপ রাজাকর দল। যুদ্ধের পর পাক যুদ্ধবন্দীরা হয়ত ফিরে যাবে স্বদেশে। তারা সঙ্গে নেবে না সমাজের এই উচ্ছিষ্টদের। তারা সঙ্গে নেবে না সমাজের এই উচ্ছিষ্টদের। দখলদার বাহিনীর অধিকৃত এলাকায় ওরাই ছিল মুর্তিমান শয়তান। মুক্তিযােদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে। বাকে-তাকে গুলী করে মেরেছে। পাক সৈন্যদের জন্য নারী জুগিয়েছে। এরা হাত গুটালে অনেক মুক্তিযােদ্ধা প্রাণে বাঁচত। তাদের সংগ্রাম আরও জোরদার হয়ে উঠত। বহু নারীর ইজ্জত রক্ষা পেত। সােজা পথে পা বাড়ায়নি নরকের জীবগুলাে। ভেবেছিল বাংলাদেশের মহাশ্মশানে তারা বানাবে ইসলামাবাদের নতুন সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের খিদমতগার হবে রাজাকর। কোথায় পালাবে এখন ঘৃণিত সারমেয়ের পাল? প্রতিশােধের অনির্বাণ অগ্নিশিখা নিয়ে ছুটে আসে হাজার হাজার লাঞ্ছিত নরনারী, তবে কে দেবে তাদের আশ্রয়? ভয় নেই, দুবৃত্তের দল। ভয়াতুর পশুকে রুটের ঠোক্কর মেরে লাভ কী? ওদের বুকের রক্তে গােসল করলেও ফিরে আসবে না নিহত প্রিয়পরিজন। যে-মাটিতে পড়েছে শহীদের পূত শােণিতধারা, সে-মাটি নেবে না পিশাচদের দূষিত রক্ত। তবে পাইকারী হবে ছাড়া পাবে না দেশদ্রোহী এবং সমাজদ্রোহী ঘাতকের দল। গণআদালতে তাদের বিচার অবশ্য কাম্য। যারা অপরাধী, তারা পেতে পারে না ক্ষমা-পেতে পারে না নিষ্কৃতি। যে-আগুন জ্বলছে আজ বাংলাদেশের বুকে, তা নিভানাের জন্যই দরকার উপযুক্ত বিচার। নইলে শান্ত হবে না বাঙালীর অশান্ত আত্মা। সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে না সমাজ। তুষের আগুন একদিন রূপ নেবে সর্বধ্বংসী দাবানলে।
কোথায় আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান? ইসলামাবাদের নিষ্ঠুর কারাগারে বসে তুমি কি দেখতে পাচ্ছ তােমার সাধের বাংলাদেশে নব সূর্যোদয়? যে-ঢাকা থেকে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা তােমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে, সে-ঢাকা আজ স্বাধীন। তার প্রাসাদগুলাের শীর্ষে উড়ছে জয় বাংলার পতাকা। তােমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য গােটা বাংলাদেশ আজ পাগল।
পূবের যুদ্ধ থেমেছে। পশ্চিম রণাঙ্গন এখনও উত্তাল। আপনি কি করবেন সেখানে, ইয়াহিয়া খান? ভয়াবহ রূপ নেবে সেখানে জওয়ানদের সম্ভাব্য অভিযান। মার্কিন এবং চীনা দোস্তরা দাঁড়াবে কি আপনার পাশে? মরণকামড় দেবার জন্য কি তারা চাঙ্গা করে তুলবেন আপনাকে? বাংলাদেশের পরিণাম দেখে যদি ইসলামাবাদের শিক্ষা না হয়ে থাকে, তবে চরম শাস্তির জন্য তৈরী হােন। সদ্যসমাপ্ত মুক্তি-সগ্রামের পুনরাবৃত্তি ঘটবে পশ্চিম পাকিস্তানে। নরহত্যা করতে চায় না ভারত। তা যদি চাইত, তবে গুঁড়িয়ে দিতে পারত ঢাকা। একটি পাক সৈন্যও পেত না জান নিয়ে দেশে ফেরার সম্ভাব্য সুযােগ। বাংলাদেশের মুক্তি এবং শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল নয়াদিল্লীর একমাত্র লক্ষ্য। জওয়ান এবং মুক্তিযােদ্ধারা সদর্পে পৌছে গেছে লক্ষের শেস সীমানায়। আর যুদ্ধ নয়, আর রক্তপাত নয়—আসুক শান্তি-নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি। পশ্চিমে হয় যদি অস্ত্র সম্বরণ তাতে হয়ত আপত্তি করবেন না নয়াদিল্লী। অধিকৃত কাশ্মীর ছাড়তে হবে ইয়াহিয়া খানকে। এই বিষবৃক্ষ আর জইয়ে রাখা চলবে না। একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা প্রাণ দিলেন এবং আদর্শের জন্য যারা রক্ত ঢাললেন, তারা গােটা মানবজাতির নমস্য। আজ ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি মানুষের মর্মভেদী শােক এবং উল্লাসের দিন। পুরাতনকে ভুলে যাও বাংলাদেশের মা-বােনেরা। তােমাদের প্রিয়জনের রক্তস্নাত মাটিতে হয়েছে স্বাধীনতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলেছ তােমরা। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি নরনারী তােমাদের প্রগতির সহযাত্রী। পরাধীন জাতির মুক্তি-সংগ্রামে মুক্তিযােদ্ধা এবং ভারতের জওয়ানরা পরস্পরের নিকটতম সাথী। তাদের শােণিতে বাংলাদেশ ধন্য এবং পবিত্র। সব কলঙ্ক মুছে গেছে। ফুটে উঠছে নব-জাতির নব-উন্মেষের অনাবিল শুভ্রতা। এই নবীন বাংলাদেশকে প্রণাম। শুভঙ্কর হােক তােমার যাত্রারম্ভ। জয় বাংলা, জয় হিন্দু।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!