You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.08 | নিক্সনের এই আচরণই প্রত্যাশিত | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

নিক্সনের এই আচরণই প্রত্যাশিত

নিকসন সাহেবের কাণ্ড-কারখানা দেখে আমাদের সরকারি মহল যদি এখনও ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকেন, তবে আমরা বলব, তাঁরা নিতান্তই তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন। কারণ বাংলাদেশের ব্যাপারে নিকসনী প্রশাসনের গত আট মাসের কলঙ্কময় রেকর্ড যারা জানেন তাদের পক্ষে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হওয়ার সুযােগ কোথায়? তথাকথিত স্বাধীন দুনিয়ার এই স্বয়ম্ভু মাতব্বর এবং গণতান্ত্রিক আর্দশের ধ্বজাধারী মার্কিন সরকার গত মার্চে পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রকে জবাই হতে দেখেও চোখের জল ফেলার সময় করে উঠতে পারে নি। আজ ভারত-পাক যুদ্ধের তিন দিনের ক্ষয়ক্ষতি দেখেই যে নিকসন সাহেবের হৃদয় মথিত হয়ে উঠেছে। এবং শান্তি শান্তি’ করে যিনি দারুণ সােরগােল তুলেছেন, গত আট মাসে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি দস্যুদের তাণ্ডব দেখার পরও তিনি মুখে রা কাড়েন নি। এক কোটি নিরীহ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে দেশছাড়া হওয়ার পর যিনি এক হাতে শরণার্থীদের জন্যে ছিটেফোটা সাহায্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গী-নায়ক ইয়াহিয়াকে অন্য হাতে অস্ত্র জুগিয়ে এসেছেন, সেই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছ থেকে আজকের ব্যবহারই প্রত্যাশিত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদিন যখন নিজে মার্কিন মুলুকে গিয়ে ব্যস্ত প্রেসিডেন্টকে সব কথা বােঝাতে চাইলেন, তখন হােয়াইট হাউসের ভােজসভায় নিকসন সাহেব ভােজসভাগৃহের ইতিহাস আউড়ে আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গেলেন কোনাে রকম চক্ষুলজ্জার বালাই না করে। আমরা তবে আজ কেন আমেরিকার আচরণে নতুন করে বিস্মিত হবে?
পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা সুরু হওয়ার পর ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট নিকসনের মােটেই দেরি হল না। কারণ, ভারত নাকি ঐ সব অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হচ্ছে। অথচ যে মার্কিন অস্ত্র হাওলাত করে ইয়াহিয়া খান বাঙালি নিধন করে এল এবং ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সামরিক প্ররােচনা দিয়ে এল সেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে তার প্রায় আট মাস সময় লেগে গেল। সেটাও করা হল অনেক আন্তর্জাতিক চাপ এবং মার্কিন কংগ্রেসের একাধিক প্রস্তাবের পর। শুধু তাই নয়, সেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আগে পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ পর্যন্ত করা হয়েছিল। ভারতের বেলায় কিন্তু এ-সব কিছুরই দরকার হল না। এমন কি অর্থ সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হল না একটুও। রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রস্তাব এনে যখন ভারতকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত ব্যর্থ হল তখন প্রেসিডেন্ট নিকসন নিয়েছেন এই বাঁকা পথ। ইয়াহিয়া খানকে চরম বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার জন্যে প্রেসিডেন্ট নিকসনের এই শেষ চেষ্টা দেখেও আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কারণ এশিয়া এবং দুনিয়ার অন্যান্য প্রান্তে গণতন্ত্রের প্রবক্তা এই আমেরিকাই কি বছরের পর বছর নানা স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক জমানাকে নির্লজ্জভাবে মদৎ দিয়ে আসে নি? কোরিয়ার সিংম্যান রি থেকে ভিয়েনামের থিউ, তাইওয়ানের চিয়াং কাইশেক থেকে কিউবার বাতিস্তা পর্যন্ত একই লজ্জাকর দৃষ্টান্ত। বিশেষত: যে-মার্কিন সরকার ভিয়েৎনামের অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের রক্তে হাত কলঙ্কিত করেছে তারা তাে ইয়াহিয়ার বাঙালি নিধনের কাজে মদৎ দেবেই। তা ছাড়াও আছে বৃহৎ রাষ্ট্রের সেই ন্যক্কারজনক খেলা-যার নাম কোনাে এলাকার শক্তির ভারসাম্য রক্ষা। এই নীতির (অথবা নীতিহীনতার) তাগিদেই মার্কিন সরকার গত ২৪ বছর ধরে পাকিস্তানকে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে তুলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা কৃত্রিম ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করে এসেছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবের ফলে সেই সাধের তাসের প্রাসাদ ভেঙে পড়ে দেখে মাথায় হাত দিয়েছে আমেরিকা। তার ওপর নতুন বন্ধুর খোঁজে নিকসন সাহেব পিকিং যাচ্ছেন। গত জুন মাসে সেই মিলনের জমি তৈরি করতে কিসিঙ্গার যখন গােপনে পিকিং যান তখন তাতে ঘটকালি করেছিল ঐ ইয়াহিয়া খান। সেই সেবার একটা নগদ বখশিসও তাে দেওয়া দরকার।
কিন্তু নিকসন সাহেব এখনও ভুল স্বর্গে বাস করছেন। ১৯৬৫ সালে যে-দাওয়াইয়ে কাজ হয়েছিল ১৯৭১ সালে সে-দাওয়াই কাজে লাগবে না। আমাদের অর্থমন্ত্রী চ্যবন আগেই ঘােষণা করেছেন যে, ভারত যেকোন সম্ভাবনার জন্যই প্রস্তুত এবং সেই সম্ভাবনার মধ্যে মার্কিন সাহায্য বন্ধের সম্ভাবনাকেও বাদ দেওয়া হয় নি। বলা হয়েছে যে, মার্কিন সাহায্য বন্ধ করা হয়েছে সাময়িকভাবে। নিকসন সাহেবের পােষ্য এবং দোস্ত ইয়াহিয়ার সর্বনাশ দেখে সেই সময়ের মেয়াদ বেড়ে যেতে পারে। শােনা যাচ্ছে, জাপানও নাকি আমেরিকার পথ গ্রহণ করতে পারে। তবে অন্যান্য যে-সব দেশ ভারতকে সাহায্য দেয়, যেমন বৃটেন, ফ্রান্স বা পশ্চিম জার্মানী, তারা এখনও এই ধরনের কোনাে হুমকি দেয় নি। কিন্তু যে-কোনাে অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্যেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও হবে। কারণ, জাতির স্বার্থ রক্ষার জন্যে যে-কোনাে রকম কৃচ্ছসাধন করতে তৈরি থাকা ছাড়া এখন আর কোনাে পথ নেই।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১