You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত-বাঙলাদেশ মৈত্রী চিরস্থায়ী হবে

ভারতের ঘরের পাশে যখন স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বাস্তব আকার ধারণ করছে এবং খাস ঢাকায় এই দেশের সরকারের প্রতিষ্ঠা যখন আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষামাত্র তখন স্বভাবতই এই দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়টি উভয় দেশের মানুষের চিন্তায় একটা বড় স্থান অধিকার করছে। যন্ত্রণা, রক্ত ও অশ্রুর মধ্য দিয়ে এই সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা হল এবং একই রণক্ষেত্রে একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতার দ্বারা সমৃদ্ধ হল এই সম্পর্ক। ইতিহাসের নির্দেশেই এশিয়ার এই দুটি বৃহৎ দেশ অচ্ছেদ্য মৈত্রীর রাখীবন্ধনে বাঁধা পড়ল। ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের সুখ-দুঃখের সাথী, তাদের বাঁচা-মরা একই সঙ্গে, যাত্রা তাদের একই পথে। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রভৃতির যে পত্র বিনিময় হচ্ছে তাতেই দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ কালের মধুরতম বন্ধুত্বের এই প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিং বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের কাছে লেখা পত্রে অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই এই আশা প্রকাশ করেছেন যে, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সারা বিশ্বে উত্তম প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলিও বাংলাদেশ-ভারত সন্ধুত্বের সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন।
ভারতের পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যুদয় স্বভাবতই এই দেশের মানুষের পক্ষে গভীর সন্তোষের বিষয়। দুই যুগ আগে আমরা ইতিহাসের কাছে যে ঋণ করেছিলাম সেই ঋণই যেন আজ আমরা পরিশােধ করছি। নিতান্ত নির্বোধ ও উন্মাদ ছাড়া আজ অবশ্য আমাদের দেশে আর কেউ জোর করে ভারত বিভাগ রদ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করে না। আর তার প্রয়ােজন নেই। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ একদিন যে জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল সেই আদর্শের ভিতর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির স্থান ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ সেই আদর্শের মর্যাদা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারে নি। দ্বিজাতিতত্ত্বের কাছে সেদিন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছিল। দেশ বিভাগ, মহাত্মা গান্ধীর হত্যা, আশ্রয়প্রার্থী সমস্যা প্রভৃতি সেই পরাজয়েরই প্রতীক বলে এমন বেদনাময়। সেদিনকার পরাজয়ই যে শেষ কথা ছিল না, ইতিহাসের সেই মৃত্যুঞ্জয়ী সত্যের স্পষ্ট ঘােষণা আমরা আজ শুনতে পাচ্ছি বাংলাদেশের জন্মের মধ্যে। হারানাে ভাইকে বুকের মধ্যে ফিরে পাওয়ার আনন্দ যেন অনুভব করছে আমাদের দেশের মানুষ। এবং ওপারের মানুষেরও অনুভব অন্য রকমের নয়।
কিন্তু, স্পষ্টতই, দুই দেশের সম্পর্ক শুধুমাত্র এই ধরনের আবেগমথিত স্মৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে না। এই সম্পর্কের ভিত্তি আরও গভীর এবং দৃঢ়। বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ঘােষণা করেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রের আদর্শ হবে গণতন্ত্র, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা অনুসরণ করে চলবেন জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণসহাবস্থান এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতার নীতি। এগুলি ভারতেও নীতি। আদর্শের এই সমতা উভয়ের যাত্রাপথে পরস্পরকে শক্তি যােগাবে এবং দুই দেশের সম্পর্ককে করে তুলবে নীতিভিত্তিক। ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনীতি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হবে, প্রকৃতি ও ভূগােলের এটাই নির্দেশ। (যেমন, ভারতে বাংলাদেশের পাটের এবং বাংলাদেশে কয়লার স্বাভাবিক বাজার রয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা সেই নির্দেশ আগ্রাহ্য করে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিকশিত হওয়ার সুযােগ দেয় নি এবং বাংলাদেশকে নিজেদের অবাধ শােষণক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উভয়ের পক্ষে সুবিধাজনক স্বাভাবিক লেনদেনের সম্পর্কে স্থাপন করার সুযােগ পাওয়া গেল। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও দুই দেশের সরকারি সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতর করে তুলতে সাহায্য করবে।
ভারতের মধ্যে আবার বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের যে একটা বিশেষ প্রীতি ও সৌহর্দের সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে সেটা স্পষ্ট। কেননা, এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে রাজনীতি ও অর্থনীতির বন্ধন ছাড়া আরও একটা বন্ধন রয়েছে। সেটা হল ভাষা ও সংস্কৃতির বন্ধন, যে-বন্ধনের উজ্জ্বলতম প্রতীক হল রবীন্দ্র সাহিত্য। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই বন্ধনের কথা বলেছেন। ইসলামাবাদের কুচক্রীরা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বিভেদের প্রাচীর ভুলে দিয়েছিল সেই প্রাচীর ভেঙ্গে যাওয়ার পর এখন দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের বাধা থাকবে না। এতে দুই পারের বাঙ্গালীর মনের একটা বড় ক্ষুধা তৃপ্ত হবে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গভীর সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করবেন যে, বাংলাদেশের নেতা আশ্বাস দিয়েছেন, ভারতের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের দুয়ার সব সময় খােলা থাকবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চিরস্থায়ী মৈত্রীর এই সম্ভাবনাকে সুনিশ্চিত করে তােলার দায়িত্ব এখন দুই দেশের : মানুষদের ও তাদের নেতৃবৃন্দের। অবিলম্বে একটি চুক্তির আকারে মৈত্রীর সম্পর্ককে একটা স্থায়ী, বিধিবদ্ধ ও আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া দরকার। শুধু আজকের যুদ্ধের চাহিদা মেটাবার জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ শান্তির দিনে উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থের কথা মনে রেখে একটা আদর্শভিত্তিক চুক্তি এখনই স্বাক্ষরিত হওয়া উচিত।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!