You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানি না রাষ্ট্রসঙ্রে প্রস্তাব

অস্ত্র সম্বরণের এবং যুধ্যমান পক্ষ দুটিকে সীমান্তে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছে এই প্রস্তাব। যে সংস্থা ছিল বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার নীরব দর্শক সেই সংস্থাই আজ সক্রিয়। কান ধরে কে উঠাচ্ছে এবং বসাচ্ছে বিশ্বসভাকে? পাক-দোস্ত আমেরিকা। পাক-ভারত সীমান্ত পশ্চিমে। বাংলাদেশে এ সীমান্তের অস্তিত্ব নেই। এ অঞ্চলের সীমান্ত—ভারত, এবং বাংলাদেশের সীমান্ত। এ অঞ্চলে পাক সার্বভৌমত্ব বাতিল। বাংলাদেশস্বাধীন। তার সার্বভৌমত্ব ভারত এবং ভুটানের কূটনৈতিক স্বীকৃতির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। বিদেশী হানাদারদের মধ্যে যারা এখনও প্রাণে বেঁচে আছে তাদের আত্মসমর্পণ কিম্বা মৃত্যু অনিবার্য। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই হয়ত হয়ে যাবে সব প্রতিরােধের অবসান। দেয়ালের এই অব্যর্থ লিখনের হেরফের করার সাধ্য কারও নেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রসংঘের সদস্য নয়। এ সংস্থার ফরমান পৌছবে না তার কাছে। কি আছে রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবে? কেন সুরু হল পাক-ভারত সংঘর্ষ তার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন কি প্রস্তাবের উত্থাপক এবং সমর্থকরা? আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীর মধ্যে কোন তফাৎ রেখেছেন তারা?গত ৩রা ডিসেম্বর ভারতের উপর অতর্কিত ব্যাপক বিমান আক্রমণ কেন চালাল পাকিস্তান তার কৈফিয়ত চেয়েছেন কি শান্তির দূতরা? করলে ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ত ভিতরের কেউটে সাপ। গত ন’মাস ধরে ওটা ফণা মেলে ফুস ফুস করছিল। সুযােগ বুঝে ছােবল মারতেও এসেছিল। জওয়ানদের হাতে ডাণ্ডা দেখে ওটা ঢুকে পড়েছে দোস্তদের ঝুলিতে। বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব এই শয়তানটাকে বার করে আনার কসরত। একবার ছাড়া পেলেই আবার ছোবল মারবে বাংলাদেশের বুকে। রাষ্ট্রসংঘের বহু বজ্জাতি দেখেছে ভারত। মার্কিন প্রভাবিত এই সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল দাগ হ্যামারশীল্ড সসৈন্যে গিয়েছিলেন কঙ্গোতে। প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বা করেছিলেন সাহায্যের আবেদন। সাহায্যপ্রার্থীকে রক্ষা করার অছিলায় হ্যামারশীল্ড দিয়ে এসেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পরােয়ানা। ঘাতকের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন পেট্রিস লুমুম্বা। প্রায় চব্বিশ বছর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাশ্মীর আক্রমণের অভিযােগ নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের দরবারে গিয়েছিল ভারত। আজ পর্যন্ত বিশ্বসংস্থা ঠিক করতে পারে নি কে আক্রান্ত এবং কে আক্রমণকারী। ভিয়েতনামে প্রায় সাত বছর ধরে আমেরিকা চালাচ্ছে নরমেধযজ্ঞ। রাষ্ট্রসংঘ সেখানে সেজেছে বৃহন্নলা। সাইপ্রাসে বিচ্ছিন্নতাকামী সংখ্যালঘু তুর্কী সিপ্রিয়টদের রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রসংঘ পাঠিয়েছিলেন পর্যবেক্ষকদল। ওরা এখন পাকাপাকি ঘাটি গেড়ে বসেছে সেখানে। সাইপ্রাসের স্বাধীনতাই হয়ে পড়েছে অর্থহীন। কেন সােজা পথে চলতে সাহস পায় না রাষ্ট্রসংঘ? কারণ এই সংস্থাটি পকেটে করে রেখেছে আমেরিকা। যার উপর সে খুশী বিশ্বসভা তার উপর প্রসন্ন। যার উপর অখুশী সে পাবে বিষদৃষ্টি। কতগুলাে পকেটভভাটের জোরে দিনকে রাত করবেন মার্কিন কর্তারা। ঘােলা হবে জল। | তাতে ডুববে সত্য এবং ন্যায়বিচার। বৃহৎ শক্তিগুলাের সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ যেখানে জড়িত সেখানে। রাষ্ট্রসংঘের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিশ্বসভার জন্মের পর হতে এসব নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বৃহৎ শক্তিগুলাে তাে দুরের কথা। ক্ষুদ্র রােডেশিয়া, ইস্রাইল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হামেশাই রাষ্ট্রসংঘকে দেখাচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। ওরা তড়পায় পশ্চিমী শক্তিজোটের জোরে। এই যখন রাষ্ট্রসংঘের অবস্থা তখন তার প্রস্তাবের মূল্য কতটুকু?
কেন পাক-ভারত লড়াই থামাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পাক-দোস্তরা? ভিয়েতনামের লড়াইয়ের বেলায় তারা তাে কেউ মুখ খুলে নি? আরব-ইস্রাইলের লড়াই বন্ধের জন্য আন্তরিক উৎসাহ তাে দেখায় নি এরা?সীমান্তে সৈন্য অপসারণের প্রশ্ন এড়াবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে আমেরিকা। ইস্রাইলী সৈন্য এখনও রয়েছে দখলীকৃত আরব ভূমিতে। কি ব্যবস্থা নিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ? কোন ক্ষমতা নেই তার। ইস্রাইলী গুলীতে জান দিতে সেখানে যাবে কোন হতভাগা? ইয়াহিয়ার হাতছাড়া বাংলাদেশ। ভারত আক্রমণের উপযুক্ত জবাব পাচ্ছেন তিনি রণক্ষেত্রে। দিন যত যাবে ভারতের সংহার মূর্তি তত তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। পাক-দোস্ত দের ধারণা, বাংলাদেশ এখনও পাক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব কার্যকর হলে তিনি ফিরে পাবেন। বাংলাদেশ এবং এড়াতে পারবেন জওয়ানদের প্রত্যাঘাতের সর্বনাশা পরিণাম। পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতরে জ্বলছে চিতার আগুন। প্রতিদিন ভারতীয় বাহিনী তাতে জোগাচ্ছে ইন্ধন। যুদ্ধের সাম্প্রতিক গতি তার প্রমাণ। কোথায় এখন ইয়াহিয়া খান? তাকে খুঁজে বার করা দরকার। রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবের সঙ্গে তাকে পাঠাতে হবে সহমরণে। মানি না পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্বসভার ফরমান। মানি না সৈন্য অপসারণের নির্দেশ। যারা বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী, যারা ভারতে এক কোটি শরণার্থী পাঠাবার জন্য দায়ী, যারা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী এবং যারা মানবতার মাথায় বুটের লাথি মারার জন্য দায়ী তাদের টুটি চেপে ধরেছে ভারত। যে নৈতিক দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রসংঘের তা করছে আজ ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি নরনারী। জওয়ানেরা তাদের সশস্ত্র প্রতিনিধি। শ্বাসরােধ করে জল্লাদের দফা রফা না করা পর্যন্ত তারা থামাবে না লড়াই। তফাৎ থাক রাষ্ট্রসংঘ। তােমরা মানবদ্রোহীর মদতদার। তােমাকে বিশ্বাস নেই। শয়তানের রক্ত চাই। এ রক্ত না পেলে বেণী বাঁধবে না বাংলাদেশের হাজার হাজার ধর্ষিতা নারী। মানবদ্রোহীদের রক্ত চাই। এ রক্ত না পেলে শান্তি আসবে না এই উপমহাদেশে। তফাৎ যাও রাষ্ট্রসংঘ। পথ রােধ করাে না। বেশী চালাকি করলে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলব সব অবরােধ। ভারত আজ জাগ্রত। তার অসিতে রক্তের ক্ষুধা। সভ্যতার চিরকলঙ্ক পাক দস্যুদের সমূল উচ্ছেদের আগে কোষবদ্ধ হবে না এই তরােয়াল। তফাৎ যাক রাষ্ট্রসংঘ। ঘাড় পেতে দিও না শাণিত আঘাতের সামনে। জয় হিন্দ, জয় বাংলা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!