You dont have javascript enabled! Please enable it!

আত্মসমর্পণ কিম্বা মৃত্যু

বাংলাদেশে পাক বাহিনীর রােজ কেয়ামতের দিন এসে গেছে। ওরা এখন ছুটছে জান বাচাবার জন্য ছুটছে। কিন্তু যাবে কোথায়? ওদের ঘিরে ফেলেছে ভারতীয় জওয়ান এবং মুক্তিফৌজীরা। আশ্রয় ছিল ক্যান্টনমেন্টগুলাে। যশাের হাতছাড়া। ময়নামতী এবং ঢাকা দুর্গের পতন আসন্ন। মাথার উপরে নেই বিমান আচ্ছাদন। স্থলে, জলে এবং আকাশে সম্মিলিত বাহিনীর একাধিপত্য। পালাবার সব পথ রুদ্ধ। এ অবস্থায় প্রতিরােধ চালিয়ে লাভ কি? সেনাপতি মানেকশ দিয়েছেন কড়া হুঁশিয়ারী, আত্মসমর্পণ কিম্বা মৃত্যু—এ দুটির মধ্যে একটি বেছে নাও। সময় চলে যাচ্ছে। আর অপেক্ষা করবে না জওয়ানেরা। ধৈর্য ধরবে না মুক্তিফৌজ। যেখান থেকে প্রতিরােধ আসছে সেখানে চরম আঘাত হানবে তারা। গুড়িয়ে দেবে অত্যাচারীর সুদৃঢ় বিবর। এই অনিবার্যকে এড়াবার একমাত্র উপায়-আত্মসমর্পণ। সুবােধ বালকের মত হাতিয়ার ছাড়লে ওরা পাবে যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা। অন্যথায় অপঘাতে মৃত্যু। ভারতীয় স্থল বাহিনীর বিজয়ী অধিনায়কের এই হুঁশিয়ারী বীরােচিত এবং সৈনিকবৃত্তির মর্যাদাসূচক। পরাজিতের আত্মসমর্পণ রণক্ষেত্রের সাধারণ ঘটনা। একমাত্র পাক-বেতার ছাড়া আর সবাই জানে, বাংলাদেশে পাক-বাহিনী একেবারেই পর্যুদস্ত। ধুলিশয্যা ছেড়ে কোমর সিধে করে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই তাদের। কেন তবে এই নিষ্ফল প্রতিরােধ?
পিছনের দিকে একবার তাকাও নরঘাতীর দল। নিরস্ত্র জনতার উপর তােমরা চালিয়েছ গুলী। কত মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে আছড়ে মেরেছ মাটিতে। জ্বালিয়ে দিয়েছ জনপদ। এক কোটি শরণার্থী পাঠিয়েছ ভারতে। হাজার হাজার নারীর দেহ নিয়ে করেছ পৈশাচিক উল্লাস। রক্তে ভেসে গেছে বাংলাদেশ। ঘরে ঘরে উঠেছে কান্না। তােমরা মান নি সভ্য সৈনিকের রীতিনীতি। এখন পালাচ্ছ কেন? কোথায় তােমাদের বীরপনা? কোথায় তােমাদের রণহুঙ্কার? ভুলে যেও না গােটা বাংলাদেশ আজ রক্তপাগল। যাদের বুকে রেখেছ তােমরা ক্ষত চিহ্ন তারা কি বদলা নেবে না? শেয়াল-কুকুরের মত তারা কি তােমাদের খুঁচিয়ে। খুঁচিয়ে মারবে না? এতদিন তােমরা হত্যা করেছ মানুষ। আজ মানুষ মারছে পশু। তােমাদের কলিজা টেনে ছিড়ে ফেলার জন্য লক্ষ লক্ষ হাত উদ্যত। এই গ্লানিকর মৃত্যুর হাত থেকে তােমাদের বাঁচাতে চাচ্ছেন জেনারেল মানেকশ। যারা সৈনিক হয়ে করেছে সৈনিকবৃত্তির অবমাননা তাদের দিতে চাচ্ছেন তিনি পরাজিত সৈনিকের মর্যাদা। ঘাতক বাহিনীর প্রতি এই অনুকম্পা যুদ্ধের সাম্প্রতিক ইতিহাস বিরল। জানি না, এ সুযােগ নেবে কিনা নির্বোধের দল। ওরা হয়ত ভাবছে পশ্চিম রণাঙ্গনে ইয়াহিয়া করবে বাংলাদেশের ত্বরিত সামরিক ফয়সালা। হয়ত তাদের ধারণা, রাষ্ট্রসংঘে মার্কিনী খেলের জোরে তারা পাবে মুক্তি সন্ধান। এই আকাশ কুসুম কল্পনা বাতুলতা : রক্তশূন্য দেহ নিয়ে বেশী তাকত দেখাতে গেলে রেহাই পাবে না কেউ। ঢাকার চারদিকে গড়ে উঠছে শক্ত বেষ্টনী। দু-তিন দিনের মধ্যেই চেপে ধরবে ভীত-চকিত শয়তানদের। হাত যাদের কাঁপছে, কি করে তারা চালাবে হাতিয়ার? ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে সব প্রতিরােধ। ধ্বংসের জ্বলন্ত স্ত পের মধ্যে পুড়ে ছাই হবে ঘাতকদলের মাংসপিণ্ড।
বাংলাদেশ স্বাধীন। সেখানে পা রাখার কোন অধিকার নেই হানাদারদের। গত ন’মাসের মধ্যে অবশ্যই বুঝেছে তারা এ-অঞ্চলে পাক-জঙ্গীশাহী কত ঘৃণিত এবং কত অবঞ্ছিত। যারা ইসলামাবাদের নরপশুদের খিদমতগার ন্যায় বিচার তাদের অবশ্য প্রাপ্য। এ বিচারের ভার যদি পড়ে বাংলাদেশের জনতার উপর, তবে কারও হাড়ে এক কণা মাংস থাকবে না। সাড়াশী দিয়ে দেহের চামড়া তুলে নেবে তারা। তাই জেনারেল মানেকশর হুঁশিয়ারী-এখনও সময় আছে। আত্মসমর্পণ কর। আমরা জানি, সর্বনাশের উন্মাদনা যাদের পেয়ে বসেছে বাস্তব মুক্তি তাদের কাছে বৃথা। বন্দী চড়ই পাখীর মত দিশাহারা অসহায়ের দল মাথা কুটবে দেয়ালে দেয়ালে। পাবে না পালাবার পথ। ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে মরণ খাচায়। মনে হয়, এই আত্মবিলুপ্তির পথই বেছে নিয়েছে হানাদাররা। ওদের আত্মসমর্পণের লক্ষণ নেই। কালহরণ অনাবশ্যক। মূর্খেরা শুনবে না উপদেশ। যত দিন যাবে পশ্চিম রণাঙ্গনে চরম আঘাতের সময় তত পিছিয়ে পড়বে। তালগােল পাকাবার সুযােগ পাবে বিদেশী পাক-দোস্তরা। ঝাপিয়ে পড়ক ভারতের এবং বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনী। চুরমার করে ফেলুক সব। দয়ামায়ার প্রবণতা সাময়িকভাবে স্থগিত থাকুক। নিঃশেষ হয়ে থাক বাংলাদেশে পাকশাহী ঔদ্ধত্যের শেষ চিহ্ন। মানবদ্রোহী দুশমনদের ক্ষমা নেই। যারা বাঁচবে তাদের বিচার করবেন স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। ঢাকায় জয় বাংলার পতাকা উড়িয়ে হাত মুছে ফেলুক ভারতীয় বাহিনী। নরঘাতীদের ভাগ্যে যা ঘটবার ঘটুক। ভারতীয় বাহিনীর কাছে যারা সময়মত আত্মসমর্পণ করল না, তাদের বিচারের ভার নেবেন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। নরকের কীটগুলােকে তারা বাঁচিয়ে রাখবেন, না বুটের তলায় পিশে মারবেন তা তারাই দেখবেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!