You dont have javascript enabled! Please enable it!

বুদ্ধিজীবীদের বাঁচা হবে না

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেছে হিংস্র নাৎসী বাহিনী পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরােপের যেকানেই যখন হামলা চালাতাে, সেখানেই পাইকার হারে লেখক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী চিকিৎসকদের এক কথায় যাদের বলা হয়, তাদের ধরে ধরে কোতল করত। এই হত্যার সমর্থনে হিটলারী চক্রের কুখ্যাত প্রচারসচীব উ: জোসেফ গােয়েবলস বলতেন যে, দেহশ্রমী সাধারণ মানুষরা চলেন চলতি ঘটনার ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল রেখে। তাদের তাই দরকার মত পিটুন দিয়ে গড়েপিটে নেয়া যায়। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা অভিমত সম্পন্ন মানুষ তারা আপন প্রত্যয়ে অসমনীয় থাকেন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এবং সুযােগ পেলেই নিজ মূর্তি ধরেণ। কাজেই নববিধান প্রবর্তন করতে হলে তাদের ঝাড়ে বংশে খতম করা ছাড়া উপায় নেই। এই নিকাশকে তারা বলেঝেন এক ঐতিহাসিক রােজ কেয়ামত।
দেখা যাচ্ছে পূর্ব দুনিয়ার ক্ষুদে হিটলার ইয়াহিয়া খানও একই মন্ত্রের উপাসক। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণনীয় অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক লেখিকা অনেকেই ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে গিয়ে গুলি করেছিল তার জল্লাদ বাহিনী। সেখান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত চলেছে তাদের সেই পাইকারী খুনের খেলা। তাবশ্য শুধু এই নয়, এক দিকে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে তারা নিরীহ চাষী কারিগর ও গরীব গৃহস্থ নর-নারীকে হত্যা করেছে, অন্য দিকে শহর বন্দরে ঢুকে বেছে মান্য গণ্য মানুষ যাদের পাকড়াতে পেরেছে, তাদেরই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। বলা নিষ্প্রয়ােজন যে এই নির্বিচার ঘাতনের ব্যাপারে তারা হিটলারকেও টেককা দিয়েছে কারণ আগেই বলা হয়েছে পাইকারি হত্যার তালিকায় নাৎসীরা গায়ে সাধারণ মানুসদের বড় একটা ঠাই দিত না।

পাকিস্তানি পাইকারী হত্যার আধুনিকতম একটি সংবাদ পাওয় গেল ব্রাহ্মনবেড়িয়া থেকে। মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় বাহিনী সেখানে পৌছিলে প্রায় ৩ শশা লােককে হাত পা বাঁধা অবস্থায় মরে পড়ে থাকতে দেখতে পান। অনুসন্ধানে জানা যায় এদের মধ্যে ডাক্তার অধ্যাপক আইনজীবীরা আছেন শিক্ষিত ও পদস্থ দ্ৰজন আছেন সাধারণ বুদ্ধিজীবী গৃহস্থ এবং ছাত্রও। এদের পাকিস্তানি উপরওয়ালারা ধাপ্পা দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বর্তমান সংকটে ইতিকর্তব্য বা কি সম্বন্ধে আলােচনা করবে বলে। তারপর অগ্রসরমান সংযুক্তবাহিনীর আবির্ভাব দেখে যখন তারা বুঝলাে হালে পানি পাওয়া যাবে না তখন ঐ নিরপরাধ মানুষদের ধড়াধুড় গুলি করে সদলবলে প্রাণ নিয়ে পলায়ন দিল তারা। বিশ্বাসগাতকতা এবং ঘৃণ্যকাপুরুষতার দৃষ্টান্ত হিসাবে এমনতর ঘটনা ইতিহাসেই বিরল।
নিহত ব্যক্তিদের বলা হয়েছিল মুক্তিফৌজকে তােমরা মদৎ দিয়েছ তা না হলে তারা কখনই ঘয়েল করতে পারত না আমাদের। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীরাই যে স্বাধীন বাংলার মনস্তত্ব তৈরি করেছেন, এ শয়তানরা বুঝেছে। আর তা বুঝেই করেছে এই হত্যাকান্ড ! এটিলা, মিহিরগুলা, তৈমুর, নাদিরশা…ইতিহাসে বহু লক্ষমারী দুবৃত্তদের নাম অঙ্কিত আছে। একালের ইতিহাসও তাতে হিটলার ও মুসােলীনির নাম দুটি যুক্ত করেছে, যুক্ত করেছে আংশিকভাবে স্তালিনের নামও। তারপর উঠেছেন ইয়াহিয়া খান যিনি বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও যােগ্যতায় পূর্বোক্তদের পদনখেরও যােগ্য নন, কিন্তু রক্তপায়ী নৃশংসতায় তাঁদের ঠাকুরদাদা স্থানীয়। এই নরাধম এখনাে যে মানুষের পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন এ বর্তমান যুগেরই দূর্ভাগ্য। কত দিনে এই কলঙ্ক স্ফালন করবে মানুষ ইতিহাসের দেবতাই তা শুধু জানেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!