You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের বজ্ৰ কণ্ঠ

বাংলাদেশ স্বাধীন। মুক্তিযােদ্ধা এবং ভারতীয় জওয়ানেরা রক্ষা করছে তার সার্বভৌমত্ব। উম্মাদ ইয়াহিয়া খান। পশ্চিমে তিনি জ্বালিয়েছেন আগুন। আজ তার ক্ষমতার প্রাসাদে লেগেছে সে আগুন জওয়ানরা হেেেনছেন প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। ইসলামাবাদের বিদেশী দোস্তরা এখনও আশা ছাড়েন নি। তারা কবর থেকে অখণ্ড পাকিস্তানের শব টেনে তুলতে ব্যস্ত। নির্দোষ ভারতের দেহে কলঙ্কের ছাপ মাখাতেও তাদের দ্বিধা নেই। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী এইসব নীতিভ্রষ্ট এবং মিথ্যাচারিকে দিয়েছেন কড়া হুশিয়ারী বেছে নাও তােমাদের সুহৃদ। এক দিকে গণতন্ত্রী, এবং নিরপেক্ষ ভারতের পঞ্চান্ন কোটি জনতা। তাদের সঙ্গে সৌভ্রাত্রের রাখি বাধনে বাধা বাংলাদেশের সাড়ে সাতে কোটি নরনারী। আর অপর দিকে ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র এবং তাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানি। কাদের বন্ধুত্ব চাও তােমরা? ভারতের না পশ্চিম পাকিস্তানের? এই সহজ প্রশ্নের সাজা জবাবের উপর নির্ভর করবে তাদের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ ব্যবহার। দেয়লের লিখন স্পস্ট। ইয়াহিয়া ফিরে পাবেন না বাংলাদেশ। যুদ্ধ যদি বেশিদিন চলে তবে জওয়ানদের বুলেট বিদ্ধ হবে ইসলামাবাদের হৃদপিন্ড। আমরা জানি শক্তির বশ দুনিয়া। ন্যায়ের সঙ্গে যদি মিশে যায় শক্তি তবে তা গতি হয় দুর্বার। তাই ঘটেছে পাকভারত লড়াই এ। স্বার্তাম্বেষী বিদেশী রাষ্ট্রগুলাে যখন দেখবে ইয়াহিয়ার কপাল পুড়েঝে তখন রাতারাতি তাদের ভােল পাল্টাবে। হাত জোড় করে এই নিকসনই আসবেন ভারদের দ্বারে। আরব রাষ্ট্রগুলাে নামায পড়বেন বাংলাদেশের মাটিতে। কিন্তু আজ যে ভূমিকা নিয়েছেন তারা, ভুলবে না তা ভারত-ভুলবে না তা বাংলাদেশ।
অদূরে দাড়িয়ে আছে বিপ্লবী চীন। ইয়াহিয়ার কাঁধে বন্দুক দিয়ে ভারত সিমান্তে করছে সে সে সর্বহারার স্বতন্ত্র বিপ্লব। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দিচ্ছেন তাকে চুড়ান্ত জয়ের আশ্বাস। ইয়াহিয়া খান জয় করবেন কাকে? স্বাধীন বাংলাদেশকে? ভারতে আগত এক কোটি শরণার্থীকে? আকাশ কুসুম কল্পনায় মশগুল পিকিং নেতারা। মাথায় তাদের উদ্ভট চিন্তাধারা। গণতন্ত্রী ভারত এবং বাংলাদেশের সঙ্গে পাক জব্দীশাহীর বিশ্বাস গাতকতার নাম চীনামার্কা বিপ্লব। কত দিন চলবে এই ধাপ্পাবাজী। যে আশা কোন দিনই আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে না। সে আশা বুকে চেপে ধরে রাখা কি বাস্তববােধ? এই কি মার্কসবাদী ভাষ্য? আমেরিকার চেয়েও বেশি শয়তান এই চীন। মার্কিণ নেতাদের আমরা চিনি। ওঁরা নির্বোধ, দাম্ভিক, অপরিনামদর্শী এবং সঙ্কীর্ণ স্বার্তের নগ্ন স্তাবক। ভিয়েতনামে প্রচণ্ড মার খেয়ে ও তারা বুঝতে পারে না জাগ্রত জনতার প্রচণ্ড আঘাতের ক্ষমতা। নাক কাটামুখ নিয়ে তাই আমেরিকা নাক গলাতে চাচ্ছে পাক-ভারত লড়াই এ। ইয়াহিয়াকে বাঁচাবার জন্য চলছে তার প্রাণান্তকর অপচেষ্টা। ভাবছে টাকা দিয়ে সে কিনে রেখেছে সে ভারতের বিবেক।টাকার থলি ধরে টান দিলেই ভিক্ষুকের মত ভারত ছুটবে তার পিছনে পিছনে। আর চীন জ্ঞানপাপী। এই মার্কিন নেতাদের সঙ্গেই বেঁধেছে সে গাঁটছড়া। যখন তখন ছাড়ছে রণহুঙ্কার। সে ভালভাবেই জানে বাংলাদেশের পায়ে নতুন করে দাসত্বের পঙ্খল পরাতে পারবেন না ইয়াহিয়া খান। জঙ্গীশাহীর অস্তিম দিন আসতে দেরী নেই। তবু চীন দিচ্ছে তাকে উস্কানী। পিছন থেখে পাক সৈন্যদের ঠেলে পাঠাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এ যুদ্ধ কত দীর্ঘস্থায়ী হবে চীনের তত লাভ। তার ধারণা যুদ্ধের শেষে বিজয়ী ভারতের ক্ষত শুকাতে লাগবে অনেক দিন। তখন পাবে সে ভৌতিক উল্লাসের বিরাট সুযােগ। ভুলে যাচ্ছে পিকিং নেতারা। অগ্নি পরীক্ষার পর যে ভারত দুনিয়ায় পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাড়াবে সে ভারতের চেহারা আলাদা। আত্মপ্রত্যয়ের দৃ৮ বনিয়াদের উপর হবে তার নবজীবনের প্রতিষ্টা। তাকে চোখ রাঙাগাবার হিম্মত থাকবে না কারও কেন দূরে দাড়িয়ে অনাবশ্যক বিপ্লবী ভেংচি কাটছে চীন? চোখের সামনে সে কি দেখছে না বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীর দূরাবস্থা? মারের চোটে তাদের পিঠের চামড়া পুরু হয়ে যাচ্ছে। কেন চীন নামছে না রণক্ষেত্রে? চীন ভারত সীমান্তের জমি কি শীতের বরফে ঢেকে গেছে? চীনা সৈন্যরা কি সেখানে পা পিছলে গড়াগড়ি দিচ্ছে? কিম্বা সােভিয়েট রাশিয়ার ভয়ে পিকিং নেতারা বিবরবদ্ধ শিয়ালের মতন কাপছেন? ১৯৬৫ সালের মত পিছন থেকে ভারত আক্রমণের হুকী কোথায়? কোথায় তার চরমপত্র? কোথায় চরমপত্রের মেয়াদ বাড়াবার দফাওয়ার পায়তারা?
সব মিথ্যা। একমাত্র সত্য যাত্রার দলের সেনাপতির অভিনয়। এ অভিনয় করেছেন পিকিং নেতারা। অনেক আগেই ভারতে দেখেছে বিপ্লবী মুখেশের আড়ালে চীনের কদর্শ মূর্তি। ওটা আদর্শবজিত একটি শয়তান রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট নগ্নতা। তা না হলে ধর্মান্ধ এবং সামন্ততন্ত্রী পাকিস্তানের সঙ্গে কি করে গড়ে উটতে পারে তার মিত্রতা? কি করে থাকতে পারে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গনহত্যায় তার প্রকাশ্য সম্মতি? নির্যাতীত মানুষের লড়াই এ কেন তার এই নির্লজ্জ অণীহা? যারা পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতী করছে এবং যারা এখনাে দু নৌকায় পা দিয়ে গা বাঁচাবার ফন্দি আটছে তাদের প্রতি শ্রীমতী গান্ধীর জ্বলন্ত আহ্বান-বন্ধু বেঁছে নাও। সুবিধাবাদ আর চলবে না। অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ দিবালােকের মত সত্য। আজ ইতিহাসের পট পরিবর্তনের পালা। সমাপ্তির পথে এই উপমহাদেশে নরপশুদের উদ্দাম নৰ্তনের সর্বনাশা অধ্যায়। শান্তি এবং প্রগতির রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা। ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি নরনারী তাতে দিয়েছেন প্রথম শােনীত স্বাক্ষর। লক্ষ্যের শেষ প্রান্তে না যাওয়া পর্যন্ত থামবেন না। তারা। যুদ্ধ চলছে এবং চলবে। কারও চাপে নতি স্বীকার করবে না ভারত। নয়াদিল্লী থেকে ধ্বনীত হয়েছে বজ্রকণ্ঠ। এ কণ্ঠ আর কারাে নয় পঞ্চান্ন কোটি সংগ্রামী জনতার মহানায়ীকা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!