You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য সরাও

বাংলাদেশে পাক বাহিনীর অবস্থান ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। ওদের সরিয়ে নিতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। ইয়াহিয়া খান যদি এতে রাজী হন তবেই বােঝা যাবে, বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে তিনি ইচ্ছুক। রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর এই স্পষ্টোক্তি নিঃসন্দেহে আগামী দিনের সম্ভাব্য ঘটনাবলীর ইঙ্গিতবাহী। ইয়াহিয়াকে আড়াল করার জন্য নেপথ্যে যারা পায়তারা কষছেন অবশ্যই তাদের মনে চমক লাগবে। প্রেসিডেন্ট নিকসন হয়ত ভাববেন সীমান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনীর অপসারণের বদলে শ্রীমতী গান্ধী চাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে পাকবাহিনীর অপসারণ। প্রধানমন্ত্রীর এই দাবীর পিছনে রয়েছে গত আট মাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা গণহত্যা চালিয়েছে। এক কোটি মানুষকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতে। সীমান্তের ওপার থেকে ওদের গােলাগুলী পড়ছে এপারে। মরছে সাধারণ মানুষ। মাঝে মাঝে ভারতীয় সীমান্ত ঘাটিগুলাের উপর চলছে হামলা। পাক দোস্তরা জানে, সীমান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারিত হলেই পাকসৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়বে মুক্তিবাহিনীর উপর। বিঘ্নিত করবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রগতি রােধ করতে পারবে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা। এ সুযােগ দেওয়া হবে না শয়তানদের। দু দু বার আক্রমণ করেছে তারা ভারত। তৃতীয়বার আচমকা হামলা চালাবার সুযােগ পাবে না দুশমনের দল। প্রেসিডেন্ট নিকসন যতই কলকাঠি নাড়ন তার অপচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী আজ বজ্রের মত কঠোর এবং সুদূরপ্রসারিত তার দৃষ্টি। সহজে বাংলাদেশ ছাড়বেন না ইয়াহিয়া খান। শান্তির লেশমাত্র ইচ্ছা নেই তার মনে। মুক্তিবাহিনীর অভিযান দুর্বার। তাদের প্রতিরােধ পাক বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ দিবালােকের মত সত্য। দেয়ালের লিখন মুছে ফেলার সাধ্য নেই স্বার্থান্বেষী বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের।
আন্তর্জাতিক সমাজকে আট মাস সময় দিয়েছেন শ্রীমতী গান্ধী। নরঘাতী ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির বদলে তারা বাড়িয়েছেন সমস্যার জটিলতা। বারবার বলেছেন নয়াদিল্লী রাষ্ট্রসঙ্ঘ কিম্বা বৃহৎ শক্তিগুলাে বাংলাদেশ এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধানে এগিয়ে না এলে ভারত নেবে তার নিজস্ব ব্যবস্থা। কেউ আমল দেয়নি এই হুশিয়ারীতে। ওদের পরােক্ষ মদতে ইসলামাবাদের স্পর্ধা আজ আকাশচুম্বী। শরণার্থী পাঠিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না তাঁরা। ভারত সীমান্তে চালাচ্ছেন নিরবচ্ছিন্ন হামলা। প্রতিবাদ জানালে দিচ্ছেন সর্বাত্মক লড়াই-এর হুমকী। ধৈর্যচ্যুত নয়াদিল্লীর প্রথম নির্দেশ ছিল জওয়ানদের উপর-সীমান্ত লঙ্ঘন করাে না। এপার থেকেই থামিয়ে দাও পাকিস্তানের কামান। তাতে ইসলামাবাদের এবং তাদের দোস্তদের টনক নড়েনি। দ্বিতীয় নির্দেশ—যেখান থেকে গােলা আসছে সেখানে গিয়ে স্তব্ধ কর পাক ঔদ্ধত্বের উৎস মুখ। তারই পরিণতি বয়রা এবং হিলির প্রচণ্ড মার এবং পাকিস্তানের মরাকান্না। গত আট মাস ধরেই সবার মনে দানা বেধে উঠেছিল একটিমাত্র প্রশ্ন নয়াদিল্লীর লক্ষ্য কোথায়? বাংলাদেশ এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধান কোন পথে? আন্তর্জাতিক সমাজের মুখ চেয়ে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে যেতেন এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর। শুধুমাত্র বলতেন—বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ভারতের কাম্য। এই সমাধানের অর্থ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই হস্তান্তর কার্যকর করার জন্য দরকার শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। তার জবাবে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের বুকের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন ডাঃ মালিকের দালাল সরকার। রক্তস্নাত বাংলার মাটিতে করছেন উপনির্বাচনের প্রহসন। আর তাকে বাহবা দিচ্ছেন তার বিবেকবর্জিত বিদেশী স্তাবকের দল।
শ্ৰীমতী গান্ধী বুঝেছেন, শান্তির সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। এই হিংস্র নেকড়েদের বিশ্বাস নেই। জোড়াতালির কোন সমাধান টিকবে না ধর্ষিতা বাংলাদেশে। ইয়াহিয়ার সৈন্যদল সেখানে অবাঞ্ছিত, ঘূণিত এবং অরণ্যের শিকার। মুক্তিবাহিনী যেখানে তাদের পাবে, টুটি চেপে ধরবে। ওদের গায়ের মােটা চামড়া তুলে নিয়ে জুতাে বানাবে। আর সেই জুতাে পরে লাথি মারবে ইয়াহিয়ার মাথায়। যে জঘন্য অত্যাচার করেছে তারা নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর তা ভুলবে না মুক্তিবাহিনী। একতরফা মারের দিন শেষ হয়েছে।বাঙালী রক্ত দিতে এবং নিতে শিখেছে। অভিভূত শ্ৰীমতী গান্ধী ভারতের ভাগ্য মিশিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের সঙ্গে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবলুপ্তি দাঁড়িয়ে দেখতে পারে না প্রতিবেশী ভারতের পঞ্চান্ন। কোটি নরনারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্থ-একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এর ফলশ্রুতি—শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। যতদিন দখলদার পাকসৈন্য থাকবে এ অঞ্চলে ততদিন চলবে রক্তস্রোত। ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে বারবার। জীয়ানাে থাকবে পাক-ভারত সমর উত্তেজনা। অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। ওর মধ্যে প্রাণসঞ্চার অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং তার বন্ধুরা শত চেষ্টাতেও ফিরিয়ে আনতে পারবেন না এক বছরের আগেকার স্থিতাবস্থা। পাক দোস্তদের মনে তাতে যদি কোন সন্দেহ থেকে থাকে তবে পরখ করুন মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি। ভাল করে পড়ন রাজ্যসভায় শ্রীমতী গান্ধীর বিবৃতি। বুঝবেন কোনদিকে বইছে হাওয়া। চলতি মাসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হুঁশিয়ারী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই মাসেই হয়ত বােঝা যাবে—সামনে কি আছে, সংগ্রাম, না শান্তি। কিম্বা দীর্ঘ বেদনার বন্ধুর পথ। অবশেষে সার্থক সমাপ্তি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!