You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইঙ্গ-মার্কিন অপপ্রচার

ভারতীয় বাহিনী নাকি বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের নামে তারা নাকি লড়াই করছে। গত ক’দিন ধরেই এ-ধরনের প্রচার চালাচ্ছে বৃটিশ পত্রিকাগুলাে। তাতে নাকি হীথ সরকারের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটেছে। তারা নাকি ভারতকে আক্রমণকারী বলে ঘােষণার কথা ভাবছেন। এই উন্নাসিক দেশের প্রচারযন্ত্রগুলাে মনে করে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের বংশধর বৃটিশ জাতি। ওরা যে রায় দেবে, গােটা দুনিয়া তা মেনে নেবে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই-এর সময় শ্রমিকদলের প্রধানমন্ত্রী মিঃ উইলসন ভারতকে আক্রমণকারী আখ্যা দিয়েছিলেন। এই মিথ্যা অভিযােগের জন্য পরে তিনি অনুতাপ করেছেন। সব দোষ কমনওয়েলথ দপ্তরের পাক-সমর্থক অফিসারদের উপর চাপিয়ে নিজে হাল্কা হয়েছিলেন। বেশী দিন আগের কথা নয়। ১৯৫৬ সালে রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ইডেন ফ্রান্স এবং ইস্রাইলের সহযােগিতায় হানা দিয়েছিলেন মিশরে তখনও এই হানাদারদের উগ্র সমর্থক ছিল রক্ষণশীল বৃটিশ পত্রিকাগুলাে। শেষ রক্ষা অসম্ভব দেখে পরে তারা সুর পাল্টিয়েছিল। সুয়েজের নােংরা জল খেয়ে বৃটিশবাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নিজস্ব সত্তা হারিয়ে ফেলেছে বৃটেন। সে এখন আমেরিকার লেজুড়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ তার ডান কান ধরে টানলে ডান দিকে মুখ ঘােরে, আর বাঁ কান ধরে টানলে বাঁদিকে। ভদ্রতা এবং ন্যায়নীতির মুখােস খুলে ফেলে প্রেসিডেন্ট নিকসন যখন পাক নরঘাতীদের সমর্থনে আসরে নেমেছেন, তখন রাতারাতি বৃটেনেরও ভােল গেছে বদলে। সে এখন পুরাপুরি মার্কিন মনিবের বরকন্দাজ।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বৃটিশ এবং মার্কিন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ। ভারত, বাংলাদেশ এবং এক কোটি শরণার্থীর সঙ্গে তারা করেছে বিশ্বাসঘাতকতা। গত আট মাস ধরে ওরা মায়াকান্না কেঁদেছে। হতভাগ্য মানুষগুলাের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এতটুকু চাপ দেয়নি ইয়াহিয়ার উপর। বাংলাদেশে পাক সৈন্যদের গণহত্যার বিরুদ্ধে করেনি কোন নিন্দার বাণী উচ্চারণ। ভারতকে দিয়েছে শুধু বিরাট ধৈর্যের রাশি রাশি সার্টিফিকেট। এই সব সার্টিফিকেট ধুয়ে জল খেলে মিটবে কি শরণার্থীদের ক্ষুধা? ভারত কি বইতে পারবে পর্বতপ্রমাণ বােঝা? শ্রীমতী গান্ধী ওদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ সমস্যার উৎস-মুখ। বৃটিশ এবং মার্কিন রাজনৈতিক ধুরন্ধররা সামনে শুনিয়েছেন মিষ্টি কথা। পিছন থেকে মেরেছেন ছুরি। ধৈর্যচ্যুত নয়াদিল্লী যখনই নিয়েছেন কঠোর পথ এবং মুক্তিবাহিনী বাড়িয়েছেন মারের তীব্রতা, তখনই বিড়ালতপস্বীরা তপস্বীর বেশ ছেড়ে ধরছেন আসল বিড়ালের মূর্তি। ওরা ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীকে জইয়ে রাখবেন এবং বাংলাদেশের উপর স্বৈরাচারীর আধিপত্য নষ্ট হতে দেবেন না। তা দিলে ভেঙে পড়বে তাদের এশিয়ার সামরিক স্ট্র্যাটেজী-নষ্ট হবে ব্যবসায়িক স্বার্থের বনিয়াদ। পাকিস্তান যখন বাংলাদেশে গণহত্যা চালাল, এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দিল এবং সীমান্তে সৈন্য সাজাল, তখন তারা ছিল নীরব। ভারতের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই আকাশে উঠল। তাদের আর্তনাদ। ওদের দাবী-সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাও। এ-দাবীর পিছনে রয়েছে কূটনৈতিক চাল। মুক্তিবাহিনীকে উচ্ছেদ করার জন্য এটা আন্তর্জাতিক অপকৌশল। এ-চাপের কাছে ভারত নতি স্বীকার করছে না বলেই সে আজ আক্রমণকারী বলে আখ্যায়িত হতে চলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবার হিম্মত দেখিয়েছে বলেই ভারতের বিরুদ্ধে অভিযােগ উঠেছে-সে অপরের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলাতে চাচ্ছে। পাক-বেতারের প্রলাপ আজ রিলে করে শােনাচ্ছে চীন, বৃটেন এবং আমেরিকা। তাতে কিছু আসে যায় না। এ-তিনটি রাষ্ট্রের বহু অভিনয় এবং প্রহসন দেখেছে ভারত। এখন যে-নাটকের অভিনয় করছে তারা, তা মােটেই অপ্রত্যাশিত নয়। বৃটেনের সাম্রাজ্য নেই। সামরিক শক্তিতে সে দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় শ্রেণীর। কিন্তু বৃহৎ শক্তির ঢং আছে পুরা মাত্রায়। এই দাম্ভিক রাষ্ট্রটি আজ গােটা বিশ্বের বিরাট কৌতুক।
শ্রীমতি গান্ধীর অপরাধ-তিনি এক কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবী জানাচ্ছেন। ভারতের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থাগুলাে পাকাপােক্ত করতে চাচ্ছেন। এর জন্য দরকার বাংলাদেশে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের সরকার প্রতিষ্ঠা এবং পূর্বাঞ্চল থেকে পাক-বাহিনীর অপসারণ। শান্তির সব পথ অবরােধ করে রেখেছেন ইসলামাবাদ। বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনী ধরেছে অস্ত্র এবং হানছে কঠোর আঘাত। এরা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন। তারা কারও তাবেদার নন। সঙ্গত কারণেই ভারত ওদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাতে যদি ইঙ্গ-মার্কিন গােষ্ঠীর শরীরে ফোস্কা পড়ে, পড়ক। ক্ষতস্থানে মলম মাখাতে যাবে না ভারত বাংলাদেশ থেকে পাকবাহিনীর অপসারণ দাবী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী। এ-কথা ভুললে চলবে না যে, এই দস্যুদলই চালিয়েছে গণহত্যা, সৃষ্টি করেছে শরণার্থী সমস্যা এবং ভারতের উপর চালাচ্ছে হামলা। এটা অপরের ঘরােয়া সমস্যায় নাক গলাবার ঘটনা নয়, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এবং ভারতের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াস মাত্র। এ নিয়ে প্রশ্ন করার নৈতিক অধিকার নেই বৃটেন এবং আমেরিকার। ১৯৬২ সালে কিউবা নিজের জমিতে বসিয়েছিল সােভিয়েট ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাটি। প্রেসিডেন্ট কেনেডি এগুলাে অপসারণের দাবী জানিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, নৌবহর দিয়ে অবরােধ করেছিলেন কিউবা। সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চভ সরিয়ে নিয়েছিলেন ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিনিময়ে পেয়েছিলেন কিউবার সার্বভৌম মর্যাদা রক্ষার মার্কিন প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনায়াসেই প্রয়ােগ করা যেতে পারে এই ফরমুলা। কেন মার্কিন কর্তারা আজ তাদের নিজেদের প্রদর্শিত পথে এগুচ্ছেন না? কেন বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য অপসারণের দাবী তুলছেন না? অন্যের ঘরােয়া সমস্যায় নাক গলানাে—এ-অভিযােগ কি বৃটেন এবং আমেরিকার মুখে সাজে? ১৯৫৮ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদল কি নামেনি বেইরুটে? জর্ডনের বাদশা হুসেনের সিংহাসন রক্ষায় আম্মানে ধাওয়া করেনি কি বৃটিশবাহিনী? আজ ভূতের মুখে শােনা যাচ্ছে রাম নাম। ভারত জানে, আসল ভূত কারা? এশিয়ার কাঁধ থেকে ওদের না নামানাে পর্যন্ত শান্তি আসবে না এই মহাদেশে। শ্ৰীমতী গান্ধীর আয়ােজন তারই উদ্যোগ পর্ব।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!