আগুন জ্বেলেছেন ইয়াহিয়া খান
ইয়াহিয়া যুদ্ধে নেমেছেন। তার বিমানবহর যুগপৎ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। এ আক্রমণ অতর্কিত এবং বেপরােয়া। পাকিস্তানের অভিসন্ধি কারও অজ্ঞাত ছিল না। মাটিতেই প্রতিপক্ষের বিমানবহর বিধ্বস্ত করা এবং তাদের অরক্ষিত আকাশের নীচে সৈন্য পরিচালনা এ ধরনের অতর্কিত আক্রমণের প্রধান। উদ্দেশ্য। ১৯৬৭ সালের আরব-ইস্রাইল লড়াইর সূচনায় ইস্রাইল নিয়েছিল অনুরূপ পদ্ধতি। তার পরিণাম ছ’দিনের মধ্যে আরবের চূড়ান্ত পরাজয়। হিসাবে ভুল করেছেন ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তান ইস্রাইল নয় এবং ভারতও মিশর নয়। যে সাফল্য আশা করেছিল পাকিস্তান তা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক পাক বিমানহানার। তুলনায় ভারতের ক্ষতি সামান্য। ভারতীয় বিমানবহর প্রচণ্ড আঘাত করেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমানঘাটিতে। ওদের আকাশেই গুড়িয়ে দিয়েছে কখানি পাক জঙ্গী বিমান। নুতন করে ভারতীয় বৈমানিকরা প্রমাণ করেছেন, শিক্ষায় এবং সামরিক কৌশলে তারা নিপূণতর। পাক বিমান হানার সুবিধার জন্য ইয়াহিয়ার পশ্চিমী দোস্তদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তাদের প্রচারযন্ত্র সরব হয়ে উঠেছিল। দিনের পর দিন বলছিল, আক্রমণকারীরূপে আখ্যায়িত হতে চলেছে ভারত। নয়াদিল্লী যাতে প্রথম আক্রমণের সুবিধা না পান তার পরিবেশ সৃষ্টিই ছিল এসব প্রচারের মূল লক্ষ্য। ১৯৬৭ সালে যে ফাঁদে পড়েছিলেন নাসের সে ফাদে শ্ৰীমতী গান্ধীকে আটকাবার জন্যই এই পাঁয়তারা। সতর্ক ভারত ছিড়ে ফেলেছে শয়তানের ষড়যন্ত্র জাল। আহত সিংহের মতে সে আজ ভয়ঙ্কর। দুশমনের টুটিতে পড়েছে তার থাবা। অঝােরে ঝরছে রক্ত।
জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে পাল্টা আঘাতের নির্দেশ দিয়েছেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন জওয়ানেরা। তাদের বুটের তাড়নায় এবং কামান গর্জনে যশাের সৈন্যাবাস কাঁপছে। ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ ভারতীয় বিমানের বােমাঘাতে জর্জরিত। চট্টগ্রাম জ্বলছে। জওয়ানদের অগ্রগতি অপ্রতিহত। বাংলাদেশের মুক্তি আসন্ন। এই অনিবার্যকে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য ইয়াহিয়ার নেই। এখন কি করবে চীন, বৃটেন এবং আমেরিকা? প্রথম আক্রমণ করেছে পাকিস্তান। একথা নিশ্চিত যে, ওরা তাকে বলবে না আক্রমণকারী। বিপ্লবী চীনের সুর উচ্চগ্রামী। পাক বেতারের মিথ্যা প্রচার লুফে নিয়েছে সে। তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নয়াদিল্লীকে করছে অকথ্য গালাগালি। পাক দস্যুদের কাঁধে কাঁধ দিয়ে চীনারা বন্দুক ধরবে কিনা জানা নেই। না ধরাই স্বাভাবিক। ভারতের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সােভিয়েট রাশিয়া। বাড়াবাড়ি করার আগে অবশ্যই সাত পাঁচ ভাববেন পিকিং। ঘাপটি মেরে বসে থাকবে বৃটেন এবং আমেরিকা। ইয়াহিয়ার নাভিশ্বাস ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তােলপাড় করবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আসর। চাইবে যুদ্ধবিরতি। ইয়াহিয়া সদম্ভে বলছেন—তার এবারের লড়াই চূড়ান্ত। ভারত ধ্বংস করতে তিনি কৃতসঙ্কল্প। ১৯৬৫ সালে আয়ুব খানও নয়াদিল্লীতে বসে চা পানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাইশদিন লড়াই-এর পর তার ভাগ্যে জুটেছিল ইছােগিল খানের রক্তে লাল নােংরা পানি। অসময়ে যুদ্ধবিরতি না হলে এই যুদ্ধবাজের দেহ গড়াগড়ি যেত লাহােরের জনপথে। তাসখন্দ দলিলে স্বাক্ষর না দিলে পাকিস্তানের বিস্তৃত জনপদ থাকত জওয়ানদের বুটের তলায়। ইয়াহিয়া তার বকেয়া মনিব আয়ুবের চেয়েও হিংস্র। এই নরঘাতী দস্যু সর্দার বাংলাদেশে চালিয়েছে নারকীয় তাণ্ডব। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে পাক নেকড়ের দল। হাজার হাজার নরনারী এবং শিশুকে হত্যা করেছে তারা। এক কোটি শরণার্থীকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতে। আর এই বর্বরদের অস্ত্র জুগিয়েছে আমেরিকা। বৃটেন দিয়েছে পরােক্ষ মদৎ। বিপ্লবী চীন স্বৈরাচারীদের নিয়ে করছে মাতামাতি। এই রাষ্ট্রটি নাকি কমিউনিস্ট। সর্বহারাদের দুঃখে নাকি তার চোখ থেকে নেমে আসে গরম জলের ফোয়ারা। বাংলাদেশের নির্যাতীত মানুষগুলাে কি সর্বহারা নয়?ইসলামাবাদের শােষণে তারা কি রক্তশূন্য হয়ে পড়েনি? চীনা বিপ্লবীদের এমনিই বিপ্লবী ধারণা যে, তারা নির্বিকারচিত্তে গাঁটছড়া বেধেছেন পুঁজিবাদী ইঙ্গমার্কিন এবং সামন্ততন্ত্রী পাক স্বৈরাচারীদের সঙ্গে। আর নির্লজ্জভাবে দুনিয়াকে দেখাচ্ছেন বৈপ্লবিক তর্জনী।
যুদ্ধ চায়নি ভারত। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত এক কোটি দুর্গত মানুষকে দিয়েছে সে আশ্রয়। এই মানবতাবোেধ যদি তার না থাকত তবে এসব হতভাগ্যের ঘাড়ে পড়ত জল্লাদের খাড়া। আট মাস অপেক্ষা করেছেন নয়াদিল্লী। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী। কেউ দেয়নি শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথের সন্ধান। বাঁচার তাগিদেই মুক্তিবাহিনী হাতে নিয়েছে অস্ত্র। তাদের সমর্থন করেছে ভারত। মানবতার প্রতিদানে সে পেয়েছে পাকিস্তানের অতর্কিত আক্রমণ। পঞ্চান্ন কোটি ভারতীয় এবং সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশের নরনারীর উপর যুদ্ধ চাপিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন নয়াদিল্লী। একদিকে গণতন্ত্রী জনতা এবং অপরদিকে সামন্ততন্ত্রী জঙ্গীশাহী-এ দুয়ের লড়াই পাক-ভারত উপমহাদেশের অনন্যসাধারণ ঘটনা। সবচাইতে তাজ্জব ব্যাপার বিপ্লবী চীন আজ সামন্ততন্ত্রী এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদীদের একান্ত সহচর। গণতন্ত্রী বলে কথিত বৃটেন এবং আমেরিকা তার দোসর। তাতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ন্যায়ের জয় অবশ্যম্ভাবী। দুনিয়া জেনে রাখুক—আগুন জ্বালিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার আগুনেই পাকিস্তানকে পুড়িয়ে মারবে ভারত। জঙ্গীশাহীর পিঠে বুটের ঠক্কর মেরে ছিনিয়ে নেবে সে বাংলাদেশ। সেখানে প্রতিষ্ঠা করবে স্বাধীন এবং সার্বভৌম গণতন্ত্রী সরকার। ভূমির লােভ তার নেই। ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে সসম্মানে শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে পারলেই নয়াদিল্লী খুশী। পশ্চিমের যুদ্ধ চলছে এবং চলবে। সেখানে লড়াই যত দীর্ঘস্থায়ী হবে ভারতের জয়ের পথ তত প্রশস্ত হয়ে উঠবে। বাইরের সাহায্য না পেলে রণক্ষেত্রে খােয়ান অস্ত্রের পরিপুরণ করতে পারবে না পাকিস্তান। কিন্তু ভারত নিজেই অস্ত্রনির্মাতা। তার আয়ুধ সহজে নিঃশেষিত হবার নয়। বাংলাদেশে সগ্রামের ত্বরিত সমাপ্তি দরকার। তা না হলে তালগােল পাকাবার সুযােগ পাবে স্বস্তি পরিষদের পাক দোস্তরা। তিন তিনবার প্রতারিত হয়েছে ভারত। এবার বিশ্বাসঘাতকদের অন্তিম দিন। এদিনের মােকাবিলা করতে চাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। তার বাসনা পূরণ করবেন জওয়ানেরা। পাকিস্তান মৃত। তার শবের উপর সংগ্রামী | জনতার পদযাত্রার শুধু অপেক্ষা। ধৈর্য ধরে চেয়ে থাকুন বিবেকবর্জিত বিশ্বশক্তিগুলাে। ইয়াহিয়ার রণসাধ এবং তাদের কৌতুহল দুই মিটাবে সত্যাশ্রয়ী জওয়ানের দল।
সূত্র: যুগান্তর, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১