You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | দ্বিতীয় ফ্রন্টের লড়াই | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

দ্বিতীয় ফ্রন্টের লড়াই

লােকসভায় বিরােধী পক্ষের একজন নেতা যে বলেছেন, সারা ভারতে এখন একটি মাত্র জাতি, একটি মাত্র দল, একজনই মাত্র নেত্রী তার মধ্যে অত্যুক্তি এতটুকুও নেই। পাকিস্তানি আক্রমণের মােকাবিলায় সংসদের বৈঠক যে অভূতপূর্ব মতৈক্য দেখা গেল তা সারা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনমতেরই সঠিক প্রতিফলন। আমাদের ঐক্য যতােই দৃঢ়তর হবে শত্রুর ত্রাসও বাড়বে ততােই। তবে এই ঐক্য শুধু একটি মনােভাব হয়ে থাকলেই তাতে প্রার্থিত ফল পাওয়া যাবে না, সেই মনােভাব প্রতিফলিত হতে হবে আমাদের দৈনন্দিন আচরণে। আজকের এই সঙ্কটের মুহুর্তে সবচেয়ে বড়াে প্রয়ােজন অসামরিক ক্ষেত্রে সব কিছুর চাকা সচল রাখা।
সীমান্তে যে-সব বীর জওয়ান মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে সর্বস্ব পণ করছেন, তাঁদের সহায়তা দেওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ এটাই। শুক্রবার মধ্যরাত্রে জরুরী অবস্থার কথা ঘােষণা করার সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই প্রয়ােজনীয়তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য অবশ্যই আছে, থাকবেও। কিন্তু এখন সেই সব মতপার্থক্যকে আমাদের প্রতিরক্ষা প্রয়াসের প্রতিবন্ধক হতে দেওয়া যেতে পারে না। এটা অত্যন্ত সুলক্ষণ যে বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে এই ধরনের দায়িত্বপূর্ণ আচরণের কিছু কিছু প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলতে সুরু করেছে। একটি শিল্প-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পাঁচশ’কর্মী জরুরী অবস্থা সুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা নিশ্চয়ই অন্যান্যরাও অনুসরণ করবেন। প্রতিরক্ষা ও রাসায়নিক কারখানার কর্মচারীদের ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, উৎপাদন কোনােভাবে ব্যাহত হবে না। বন্দর ও ডক কর্মীরাও পুরােদমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই মনােভাব কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের সবক্ষেত্রে প্রসারিত হওয়া দরকার। কারণ দেশের প্রতিরক্ষা কোনাে বিছিন্ন ব্যাপার নয়, বৈষয়িক ব্যবস্থার মধ্যে যে-কোনাে ধরনের দৌর্বল্য আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে তুলবে। বস্তুত: এটাই লড়াইয়ের দ্বিতীয় ফ্রন্ট এবং এই ফ্রন্ট প্রথম ফ্রন্টের চেয়ে কোনােরকমেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই শুধু উৎপাদন চালু রাখলেই চলবে না, উৎপাদন যাতে ক্রমশঃ বেড়ে চলে তাই আমাদের অভীষ্ট হওয়া উচিত। কৃষিক্ষেত্র ছাড়া শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন ইদানিং তেমন উল্লেখযােগ্য হয় নি। তার কারণ একাধিক এবং বহুবার আলােচিতও বটে। সেই সব বাধা দূর করার কাজে শিল্পপতি ও শ্রমিকদের সঙ্গে একত্রে হাত মিলিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। আমাদের সীমাবদ্ধ সঙ্গতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার এবং অপচয় ও শৈথিল্য বন্ধের দ্বারা আমরা যে অবস্থার অনেকটা উন্নতি ঘটাতে পারি সে-বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। এই প্রয়াস আজ বিশেষ প্রয়ােজন এই কারণে যে, পাকিস্তানের কোনাে কোনাে মুরুব্বি আমাদের এই বলে শাসাচ্ছে যে, আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দেবে। অর্থমন্ত্রী শ্রীচ্যবন অবশ্য আগেই ঘােষণা করেছেন। যে, ভারত সব রকম অবস্থার জন্যেই তৈরি। এখন দেশের এই দুঃসময়ে আমরা যদি স্বাবলম্বী হওয়ার। সুযােগকে কাজে লাগাই তবে বিদেশী সাহায্য বন্ধ হওয়াটা শাপে বর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রবিবার সকালে পশ্চিম বাংলার অধিবাসীদের উদ্দেশে রাজ্যপাল শীডায়াস যে ভাষণ দিয়েছেন তার মধ্যেও তিনি প্রতিরক্ষার কাজে জনগণের সহযােগিতার জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। এবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংগ্রামে পশ্চিম বাংলার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ লড়াই এবার একেবারে এই রাজ্যের দরজায়। পশ্চিম বাংলায় বৈষয়িক ব্যবস্থাকে চাঙা করে তােলার জন্যে যে-প্রয়াস ইদানিং সুরু হয়েছে পাকিস্তানি হামলার ফলে তা ব্যাহত হতে দেওয়া উচিত নয়। এই রাজ্যে এখনও অনেক কল-কারখানা বন্ধ। সেগুলি খােলার কাজ যদি এগােতে থাকে এবং তাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তবে তাতে দেশেরই লাভ। তবে যে কথাটা এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার তা এই যে, এদেশে উৎপাদন বাড়লেই সব সময় ঘাটতি মেটে না। তার কারণ, উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে একদল মুনাফাশিকারী ফড়িয়া কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করতে রীতিমতাে ওস্তাদ। এদের প্রশ্রয় না-দেওয়ার জন্যে সরকার জনসাধারণকে অনুরােধ করেছেন। মুনাফাবাজী। প্রতিরােধে জনসাধারণের ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু জরুরী অবস্থা ঘােষণার পর সরকারের হাতে এখন অত্যন্ত। শক্তিশালী অস্ত্র এসেছে। যারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে শত্রুকে সাহায্য করছে তারা তাে রাষ্ট্রদ্রোহী বটেই কিন্তু দেশের দুঃসময়ে যারা দু’পয়সা বাড়তি মুনাফা লুঠতে চায় তারাও শত্রুর পঞ্চম বাহিনী ছাড়া কিছু নয়। তাদের সম্বন্ধেও সমান কঠোরতা দরকার।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১