You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বস্তি পরিষদে মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ

স্বস্তি পরিষদে মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছে সােভিয়েট রাশিয়া। কাঁটা তারের বেড়ার মধ্যে আটকা পড়েছেন নরপশু ইয়াহিয়া খান। চারদিক থেকে তাকে খুঁচাচ্ছেন ভারতীয় জওয়ান, বৈমানিক, নাবি বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা। এই ডুবন্ত জানােয়ারটার হাতে আমেরিকা পরাতে চাচ্ছিল স্বস্তি পরিষদের রক্ষা কবচ। একটা হেচকা টানে ওটা জঞ্জালের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। রাষ্ট্রসঙ্রে এই ক্ষুদে পরিষদে আমেরিকা এনেছিল একটি শয়তানি প্রস্তাব। ওতে ছিল ভারত এবং পাকিস্তানকে নিজস্ব এলাকায় সৈন্যাপসারণের নির্দেশ এবং সীমান্ত বরাবর রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল মােতায়েনের সুপারিশ। বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে জাহান্নামে পাঠাবার উৎকট প্রয়াস অকালে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীর স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতির মুখে বালি চাপা দেনেওয়ালারা নিয়েছে ভূমিশয্যা। মার্কিন প্রস্তাবের উপর ভিটো দিয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। আমেরিকার হৃদপিণ্ডে আঘাত করেছে সে। তার প্রশ্ন। সহজ এবং সরল। পাক-ভারত সংঘর্ষের উৎস কোথায়? কে করেছে শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি? কে চালিয়েছে গণহত্যা? বাংলাদেশে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই নিমিষে বন্ধ হবে পাকভারত সংঘর্ষ। শরণার্থীরা ফিরে যাবেন নিজেদের বাড়ীঘরে। এই মৌল সমাধানের ধারে কাছে যায় নি আমেরিকা। গত আট মাস ধরে করেছে শুধু টালবাহনা। গােপনে পাকিস্তানকে দিয়েছে সে অস্ত্র সাহায্য। পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনায় জুগিয়েছে ইন্ধন। ইসলামাবাদের নরঘাতক ইয়াহিয়ার মার্কিন মনিব সাজতে চাইছেন শান্তিদূত। তার মুখােস ছিড়ে ফেলেছেন মস্কো। ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে মানবদ্রোহীতার কদর্যতা এবং নগ্ন স্বার্থের নির্লজ্জ প্রতিমূর্তি।
গত শুক্রবার যখন অতর্কিত পাক বিমান আক্রমণ হল ভারতের উপর তখন কোথায় ছিল আমেরিকা? আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে নিন্দার ভাষা কেন ফোটেনি তার মুখে? গত মার্চ মাসে বাংলাদেশে যখন গণহত্যা চালালেন ইয়াহিয়া খান তখন কোথায়, ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিকসন?হাজার হাজার নরনারীর রক্তস্রোতের সামনে কেন চোখ বুজে বসেছিলেন তিনি? এক কোটি শরণার্থী যখন আশ্রয় নিল ভারতে তখন তার চোখ থেকে কেন পড়ল না এক ফোঁটা চোখের জল? স্বস্তি পরিষদের কথা তখন কেন মনে আসে নি তাঁর? এই সংস্থাকে কারা করেছিল কর্তব্যবিমুখ?ঘাপটি মেরে বসেছিল বৃটেন এবং আমেরিকা। ভারতের উপর পাকিস্ত বনের অতর্কিত বিমান আক্রমণ যদি ফলপ্রসূহত তবে স্বস্তি পরিষদের দরজায় ধর্ণা দিত না পাক সুহৃদের দল। ১৯৬৭ সালে আরব-ইস্রাইল লড়াই-এর সময় ইঙ্গ-মার্কিন পাঁয়তারা তার প্রমাণ। যুদ্ধজয়ের পথে দ্রুতগতিতে এগুচ্ছিল ইস্রাইল। স্বস্তি পরিষদের মাধ্যমে তাকে থামাবার চেষ্টা করছিল মিশরের বন্ধুরা। আর তাদের বাধা দিচ্ছিল ইঙ্গ-মার্কিন গােষ্ঠী। এবার হাওয়া বদলের পালা। পাকিস্তানের হাতছাড়া হতে চলেছে। বাংলাদেশ; সেখানে তার অস্তিত্ব প্রায় অবলুপ্ত। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় জওয়ানরা একযােগে হেনেছে। প্রচণ্ড আঘাত। তাদের অগ্রগতি অপ্রতিহত। দেয়ালের লিখন আজ স্পষ্ট। গত আট মাস ধরে যেসব নরপশু চালিয়েছে গণহত্যা এবং নারী ধর্ষণ, তারা আজ মানুষের শিকার। একটি পাক সৈন্যও ফিরে যেতে পারবে না পশ্চিম পাকিস্তানে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধের নির্মম বিচার। পশ্চিম পাকিস্তানে জওয়ানেরা করছেন প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। জ্বলছে আকাশ, জ্বলছে মাটি এবং রক্তে লাল করাচ বন্দরের অদূরবর্তী দরিয়া। অবরুদ্ধ চট্টগ্রাম এবং অবরুদ্ধ করাচী। সংহার মূর্তি ধরেছে ভারতীয় নৌবহর। কোথায় পালাবেন ইয়াহিয়া খান? চারদিকে আগুন। যেখানে যাবেন সেখানে তাড়া করবে তাঁকে মৃত্যুর বিভীষিকা। সেন্টো এবং সিয়াটো সামরিক জোটের ছােট দারােয়ানের মরণদশা দেখে জ্বলে যাচ্ছে বড় মুরুব্বীদের কলিজা। ভারতের উপর ইয়াহিয়ার অতর্কিত বিমান আক্রমণের ব্যর্থতার মতই স্বস্তি পরিষদে ইঙ্গ-মার্কিন অভিযান ব্যর্থ। এখানেই নিরস্ত্র হবে না তারা। ওদের দেহের বিষাক্ত রক্তের মধ্যে রয়েছে ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের বীজাণু। উৎকট ব্যাধি হিসাবে তা আত্মপ্রকাশ করবে বার বার। এই বিষবৃক্ষগুলাের মালি বিপ্লবী চীন। তাদের গােড়ায় ঢালছে সে এশিয়ার অশান্তির জল। ইয়াহিয়া হেলবেন, কিন্তু সহজে মাটিতে পড়বেন না। তাকে হাত ধরে টেনে তােলার মানুষের অভাব নেই।
ভারতের সামনে এসে পড়েছে আজ প্রতিশােধ গ্রহণের সীমাহীন সুযােগ। তার চোখের সামনে বাংলাদেশের হাজার হাজার নরনারীর শব নিয়ে উন্মত্ত উল্লাসে মেতেছিল পাক পশুর দল। ধর্ষিতা নারীর করুণ ক্রন্দন এপার থেকে শুনেছে ভারত। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে নি সে। আন্তর্জাতিক বাধা নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল তাকে। যারা পাড়ি দিতে পেরেছিল সীমান্ত, তাদের সেবায় গােটা ভারত খুলে দিয়েছে তার ভাণ্ডার। সামান্য আহার ভাগ করে খাচ্ছে সে শরণার্থীদের সঙ্গে। প্রতিদানে পেয়েছে বিশ্বের অবহেলা এবং পাক-জঙ্গীনায়কদের কামানের গােলা। এবার খাঁচায় পড়েছে নরপশু। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে তাকে। কিন্তু সহজে মরবে না এশিয়ার শান্তি বিঘ্নকর এই দুরন্ত দানব। মরার আগে সে নেবে সহস্র প্রাণ এবং বইয়ে দেবে ধ্বংসের প্লাবন। আজ আত্মশ্লাঘার দিন নয়, মহাপরীক্ষার দিন। বারবার প্রতারিত হয়েছে শান্তি কামী ভারত। এখন এসেছে চরম বিচারের শুভ লগ্ন। দুঃখ আসবে, রক্ত ঝরবে এবং শত শত মায়ের হাহাকারে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে আকাশ বাতাস। তবু এগুতে হবে। শান্তি, প্রগতি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ মসৃন নয়, বন্ধুর। দুহাতে উপড়াতে হবে পথের কাটা। ক্ষতবিক্ষত হবে সারা দেহ। তবু মাঝ পথে থেমে গেলে চলবে না। দুঃখ যদি আসে আসুক, দৈন্য যদি আসে আসুক এবং ধ্বংস যদি আসে আসুক এগিয়ে যাবে ভারত। জওয়ানেরা ধরেছেন অস্ত্র। সাধারণ মানুষ তাদের দেহে করবেন শক্তি সঞ্চার। প্রাণখুলে দেবে আশীর্বাদ। আমাদের লড়াই বাঁচার লড়াই, আমাদের লড়াই মানবতার লড়াই এবং আমাদের লড়াই গণতন্ত্রের লড়াই। মেঘ কেটে যাবার পর যখন আমরা পিছনে ফিরে তাকাব তখন সগর্বে বলতে পারব জাতির এই সঙ্কটের দিনগুলােই ছিল ভারতের গৌরবময় মুহূর্ত। তার সদ্ব্যবহার করেছি। আমরা। পাকিস্তানের মাটিতে দিয়েছি স্বৈরতন্ত্রী ঔদ্ধত্যের চিরস্থায়ী কবর। এই উপমহাদেশে ফিরিয়ে এনেছি। শান্তি-সংগ্রহ করেছি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সমৃদ্ধির পাথেয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!