মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে যাবে না
ইসলামাবাদ আর মার্কিন মারণাস্ত্র পাবেন না। ছত্রিশ লক্ষ ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম পাঠাবার জন্য ছিল পাকিস্তানে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ রপ্তানী লাইসেন্স বাতিল করেছেন। তাঁদের ধারণা—এতে ভারতের উত্মা কমবে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার তান্ডব শুরু হবার পর সােজা পথে পা দেন নি প্রেসিডেন্ট নিকসন। তাঁর কথায় এবং কাজে ছিল বিরাট অসামঞ্জস্য প্রকাশ্য তিনি বলতেন। পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ নিষিদ্ধ। অথচ তালে তালে চলত ইয়াহিয়ার হাতে অস্ত্র পৌঁছানাের ব্যবস্থা। অনেক কথাই ফাস করেছিলেন সিনেটের কেনেভি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান-প্রীতি কারও অজানা নয়। অবশ্যই তিনি জানেন ছত্রিশ লক্ষ ডলারের অস্ত্র রপ্তানী বন্ধ করলেই মিলবে না বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। তার জন্য যেতে হবে সমস্যার গােড়ায়। সেখানে হাত দিতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ নারাজ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এত নজির তারা ছড়িয়ে রেখেছেন যে, এখন আমেরিকার কথায় বিশ্বাস করা শক্ত। সম্প্রতি এ মর্মে সংবাদ রটেছে যে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গেছে পাকিস্তানে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য করছেন না। ফলে সন্দেহ ক্রমেই দানা বেধে উঠছে। ইয়াহিয়া খানের অপর এক ঘনিষ্ঠ দোস্ত ইরানের শাহ। তিনি বলছেন পাক-ভারত লড়াই বাধলে ইরান থাকবে পাকিস্তানের পক্ষে। এই ইরানকে আকণ্ঠ অস্ত্র সজ্জিত করছে বৃটেন এবং আমেরিকা। এর খানিকটা অংশ যে পাকিস্তানে যাবে না—তারই বা গ্যারান্টি কোথায়? তৃতীয় রাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র প্রেরণের উদ্দাম নতুন নয়। আগেও ঘটে গেছে এ ধরণের ঘটনা। হাতে হাতে ধরাও পড়েছে।
বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গী স্বচ্ছ — যদি হত তবে অস্ত্র রপ্তানী লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্তকে ভারত আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে। বহু জল ঘােলা করার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ সঠিক পথে সলজ্জিতভাবে একটুখানি পা বাড়িয়েছেন। তাতে জোড়া লাগবে না ভারত-মার্কিন মতানৈক্যের বিরাট ফাটল। বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারে প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। ওদিকে গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ক্রমেই দুর্বার হয়ে উঠছে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি। পাক-ভারত সীমান্তে চলছে সামরিক উত্তেজনা। অগ্নিগর্ভ সীমান্ত অঞ্চল থেকে পাক-ভারত বাহিনী অপসারণ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল মােতায়েন, উ থান্টের মধ্যস্থতা প্রভৃতি হরেক রকমের প্রস্তাব নিয়ে ভারতের উপর ইসলামাবাদকে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ফেলেছেন একই পর্যায়ে। পাকিস্তানের হাতে তাঁরা তুলে দিয়েছেন অপপ্রচারের হাতিয়ার। পক্ষপাতদৃষ্টির শিকড় এতদুর শেধিয়ে গেছে যে, ছত্রিশ লক্ষ ডলার মূল্যের অস্ত্র রপ্তানী লাইসেন্স বাতিলের দ্বারা তা উপড়ান যাবে না। পাকিস্তানের মারণ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলাই যদি হয়ে থাকে আমেরিকার মুখ্য উদ্দেশ্য তবে ইয়াহিয়াকে অর্থ সাহায্য দেবার জন্য কেন সে ওকালতি করছে সাহায্যকারী বিদেশী রাষ্ট্রগােষ্ঠির মধ্যে? বাংলাদেশের যে ক্ষতি করেছে আমেরিকা তা অপূরণীয়। ভুল। সংশােধনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা থাকলে —- তার বলা উচিত—পূর্ববাংলার জন্য কি ধরনের রাজনৈতিক সমাধান সে চায়। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কি তার ব্যবস্থা? ফরাসী প্রেসিডেন্ট জরজেস পপিদু সাফ কথা বলেছেন। তার মতে, সম্মিলিতক্রমেই তার সমাধান হওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট জনগণ বলতে তিনি বিশেষ করে বুঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের জনগণকে। সােভিয়েট রাশিয়া বর্তমান পাক-ভারত সঙ্কটের জন্য দায়ী করেছে পাকিস্তানকে। বাংলাদেশ সমস্যা সৃষ্টি না হলে দেখা দিত না এই উপমহাদেশে সামরিক উত্তেজনা। এর প্রশমনের জন্য দরকার বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান। পাকিস্তানের প্রচার চলছে ভিন্ন পথে। তার মতে, প্রথমে পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনার প্রশমন এবং তারপর বাংলাদেশ সমস্যা। শেষেরটা তাদের ঘরােয়া ব্যাপার। তাতে নাক গলানাে চলবে না। বাইরের কারও। অথচ সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি পাকিস্তানেরই কাজ। তার সৈন্যবাহিনীই প্রথমে জমায়েত হয়েছে সীমান্তে। অনবরত দিচ্ছে যুদ্ধের প্ররােচনা। তার ধারণা ছিল—পাক হুমকীর মুখে সাত হাত মাটির নীচে সেধিয়ে যাবে ভারত। তা যখন হয়নি তখন সে চাচ্ছে সীমান্ত থেকে পাক-ভারত সৈন্য অপসারণ। তা কার্যকর হলে বাংলাদেশ সমস্যা রূপ পাবে পাক-ভারত বিরােধ। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীকে অবাধে ঠেঙ্গাবার অধিকার পাবে পাক সৈন্যদল। শ্রীমতী গান্ধীর স্পষ্ট জবাব পাবার পরও আমেরিকার মতিগতি পাল্টাবার প্রমাণ খুবই সামান্য। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এক সময় বলতেন ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির জমিন তৈরীর জন্যই দরকার তাকে অস্ত্র সাহায্যদান। অস্ত্র রপ্তানী লাইসেন্স বাতিল করে তারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন তাদের পাক নীতি ছিল ভ্রান্তিতে ভরা? তা যদি হয়ে থাকে তবে প্রকাশ্যে তারা দাবী করুন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক সমাধান চাই। এই সমাধানের অর্থ—১৯৭০ সালের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। বাংলাদেশ থেকে মার্কিন অস্ত্রের অপব্যবহারকারী পাক সৈন্যদের অপসারণ। এ দাবী কার্যকর না হলে শরণার্থীরা ফিরবেন না স্বদেশে এবং কমবে না পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ নভেম্বর ১৯৭১