পাক আক্রমণ আসন্ন
ইয়াহিয়া খান গােটা পাকিস্তানের জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেছেন। তাঁর ভারত আক্রমণ আসন্ন। আগামী দু’এক দিনের মধ্যেই হয়ত শুরু হবে পাক-ভারত লড়াই-এর সূচনা। গত একমাস ধরেই পাক সেনারা খুজে বেড়াচ্ছিল ভারতীয় সীমান্তের দুর্বল স্থানগুলাে। ওদের কামানের গােলা পড়ছিল ভারতীয় জনপদে। উপযুক্ত জবাব দিচ্ছিলেন সীমান্ত রক্ষীরা। জওয়ানরা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন, ভারতের নিরাপত্তা তাদের হাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ১৯৬৭ সালের আরব-ইস্রাইল লড়াই এর পর পাক জঙ্গীচক্র নজর দিয়েছিলেন বিমান বহরের উপর। ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলাের উপর আকস্মিক আক্রমণ ছিল তাদের পরিকল্পনা। একথা গােপন করেন নি তারা। ইস্রাইলের বিমান হামলার অভাবনীয় সাফল্যে ওরা দেখেছিলেন ভারত বিজয়ের আশার আলাে। জঙ্গীনেতারা প্রকাশ্যেই বলতেন, আকাশ দখলে থাকলে ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে বৃহৎ দেশ জয় সম্ভব। পাক বিমান বহরকে শক্তিশালী করার আয়ােজন ছিল প্রচুর। পাকিস্তানি বিমান-বহর আজ ১৯৬৫ সালের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। ওদের দুঃসাহস বাড়ছিল দিন দিন। খুশীমত তারা ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করত এবং তাড়া খেয়ে পালাত। গত সােমবার বয়রা সীমান্তে এসেছিল চারটি পাক, জঙ্গী-বিমান। তাদের তিনটি ভূপাতিত। তিনজন পাইলট বন্দী। উচিত শিক্ষা পেয়েছে পাক-দুশমন। ওরা বুঝেছে, পাকিস্ত নি ইস্রাইল নয়, আর ভারতও মিশর নয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর মারে এবং জওয়ানদের হাতে সীমান্ত লঙ্ঘনকারী পাক-দস্যুদের লাঞ্ছনায় ক্ষেপে উঠেছেন ইয়াহিয়া খান। তাঁর সব কারসাজী ব্যর্থ। এখন তিনি মরিয়া। যেকোন মুহূর্তে জ্বলে উঠবে পশ্চিম সীমান্ত। আসল লড়াই হয়ত হবে সেখানে। পাকিস্তানের খরচের খাতায় বাংলাদেশ। লড়াই শুরু হলে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে বাংলাদেশে পাক প্রতিরােধ। মুক্তিবাহিনীর হাতে যারা নাজেহাল তারা কখনােই দাঁড়াতে পারবে না ভারতীয় বাহিনীর সামনে। মরার আগে ওরা শেষ নষ্টামী করে যাবে। হয়ত তারা এলােপাথারি। বােমা ফেলবে। পশ্চিম বাংলার, বিশেষ করে কলকাতা জনসাধারণ সাবধান। তাদের সামনে সমূহ বিপদ। শত্রুকে সহজভাবে নেবেন না। চরম সঙ্কটের জন্য তৈরী থাকুন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী দরকার আতঙ্ক এবং নৈরাশ্য পরিহার। দু’একটা পাক বােমা যেন কোনমতেই জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিশৃঙ্খলা আনতে না পারে। জনতার শৃঙ্খলাই জোগাবে জওয়ানদের সংগ্রামের প্রেরণা। তাদের হাতে দেবে শক্র হননের শক্তি।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলােড়ন সৃষ্টির দেরী নেই। ব্যাঙ্গের ছাতার মত গজাবে শান্তিকামীর দল। তারা ছুটাছুটি করবে ভারত এবং পাকিস্তানে। চেষ্টা চলবে আপােষ বৈঠক বসাবার। গা-ঝাড়া দেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। ইয়াহিয়াকে বাচাবার পায়তারা চলবে তখাকথিত শান্তি প্রচেষ্টার আড়ালে। বাংলাদেশ সমস্যা ভারতের নয়। ওটা ইসলামাবাদ এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য অস্ত্র ধরেছেন মুক্তিবাহিনী।
এই অস্ত্রের প্রয়ােগ যত জোরাল হচ্ছে ভারতকে জড়াবার পাক অপচেষ্টা তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই শােনা গেছে রাষ্ট্রসঙ্ েপাক প্রতিনিধি আগাশাহীর আর্তনাদ। নয়াদিল্লীর বক্তব্য খুবই সরল। ১৯৭০ সালের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করুন ইয়াহিয়া খান। যদি কোন মীমাংসায় তিনি আসতে পারেন, ভাল কথা। না পারলে মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের জোবে আনবেন শেষ ফয়সালা। এ ফয়সালার কার্যকর রূপ স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর সমূল উচ্ছেদ। জনতার সংগ্রাম আজ উচ্চগ্রামী। তারা প্রচণ্ড আঘাত হানবেন আগামী ক’সপ্তাহের মধ্যেই। মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই যদি পাক-ভারত লড়াই বাধে তবে ত্বরান্বিত হবে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। শরণার্থীরা তখন ফিরতে পারবেন স্বদেশে। তাড়া খাওয়া ইসলামাবাদের হিংস্র নেকড়ে নিজের সৃষ্ট পিঞ্জরে বন্দী। ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে। গণহত্যার পাপ ঘাতকের দেহক্ষরিত রক্তে ধুয়ে ফেলা দরকার। তা না হলে শান্তি পাবে না নিগৃহীত বাংলাদেশের অশান্ত আত্মা। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ইস্পাতদৃঢ় সঙ্কল্পে অটুট থাকুন। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি নরনারী তার পিছনে। এ দুর্জয় শক্তিকে পর্যুদস্ত করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের নেই। পাকিস্তান কোন ছার। তার কবর তৈরী। শুধুমাত্র শব নামাবার অপেক্ষা। পাক-ভারতের আসন্ন যুদ্ধ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের নিশ্চিত ইঙ্গিত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ নভেম্বর ১৯৭১