You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়ার প্রথম চাল ব্যর্থ

ইয়াহিয়া হয়ত ভাবতেন, ধরিত্রীর মত সহনশীল ভারত। তাকে যেমনি খুশী তেমনি পিটানাে চলে। বয়রা সীমান্তের সংঘর্ষের পর তার ধারণা পাল্টিয়েছে কিনা জানা নেই। হয়ত বদলায় নি। উন্মাদ যখন ক্ষেপে ওঠে তখন সে নিজের সর্বনাশ দেখতে পায় না। নয়াদিল্লী গাঝাড়া দিয়েছেন। আত্মরক্ষার জন্য জওয়ানেরা এখন সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবেন। শত্রু ধােলাই এর পর নিজেদের ঘাঁটিতে আবার তারা ফিরে আসবেন। কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক নির্দেশ এটা সঙ্গে বিদেশে উঠেছে সােরগােল। অনেকে দু-হাতে কপাল চাপড়াচ্ছেন। আট মাস ধৈর্য ধারণের পর অবশেষে বৈসচ্যুতি ঘটল নয়াদিল্লীর? পিটুনীর বদলে পাল্টা পিটুনীর ব্যবস্থা দিলেন তাঁরা? নিষ্কলঙ্ক চাঁদে পড়ল কলঙ্কের আঁচড়? ওদের আশপাশের শেষ নেই। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা কি? মুকিযুদ্ধাদের হননের নামে ভারতীয় এলাকায় হামেশাই পড়ছে পাক কামানের গােলা। প্রতিদিন মরছেন ভারতীয় নাগরিক। বয়রা সীমান্তে সাজোয়া বহর নিয়ে এগিয়ে এল পাকিস্তানি দস্যুদল। ওদের গােলায় আহত হলেন জনাকয় ভারতীয় জওয়ান। তাঁদের ঘাঁটি বিপন্ন। এ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকতে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে পারেন না দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের সৈন্যদল। জওয়ানরাও পারেননি। সীমান্তের ওপারে গিয়ে তারা ধ্বংস করেছেন তেরটি শেফি ট্যাঙ্ক। হানাদারদের আচ্ছামত ধােলাই দিয়ে ফিরে এসেছেন নিজেদের ঘাটিতে। আসমানের লড়াইএ পাকিস্তান হারিয়েছে তিনখানা সেবার জেট। বয়রার মারের প্রতিশােধ নিতে এসেছিল এগুলাে। ফিরে যেতে পারেনি। এখন থেকে চলবে এ দাওয়াই। মুখকে ঢিটু করতে হলে কড়া দাওয়াই ছাড়া উপায় নেই। জাতির মনােবল এবং নিরাপত্তা বােধ অটুট রাখার জন্য এই কঠোরতর প্রয়ােজন অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার সদর দরজার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। মুক্তিবাহিনীর মারের চোটে পাক-সৈন্যরা অতিষ্ঠ। ক্রমাগত পিছু হটছে তারা। ঢাকা শহরে কার্টু জারী করে। চালিয়েছে গণহত্যা। এ শহর এখন কাফুর কবলিত। সেখানে হয়ত বইছে রক্তের প্লাবন। ইয়াহিয়া খান দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য। তার চোখের সামনে হয়ত ভেসে উঠছে যশাের সৈন্যাবাসের আসন্ন পতন। গােটা বাংলাদেশ এখন পাক-সৈন্যদের বন্দীশালা। পালাবার সব পথ প্রায় অবরুদ্ধ। বাংলাদেশের মাটিতে আজ লেগেছে রক্তের তৃষ্ণা। এতদিন সেখানে পড়েছে বাঙালীর রক্ত। এখন তার উপর পড়বে পাক-সৈন্যর রক্তের আস্তরণ। ইয়াহিয়া ঘােষণা করেছেন জরুরী অবস্থা। বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে পরিণত করার শেষ চাল চেলেছেন তিনি। পাক প্রচারযন্ত্র আর্তকণ্ঠে বলছে—ভারতীয় বাহিনী ঢুকে পড়ছে পূর্ব বাংলায়। দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিবাহিনী) নাম ভুলে গেছেন ইসলামাবাদ। ভুলবারই কথা। মারের চোটে মানুষ বাবার নাম ভুলে যায়। মুক্তিবাহিনীর নাম যে ইসলামাবাদ ভুলবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
ওদের মারের মাত্রাধিক্য হয়ত তার কারণ। পাল্টা জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন নি নয়াদিল্লী। তাঁদের সিদ্ধান্ত দুরদর্শিতার পরিচায়ক। লড়াই করছে মুক্তিবাহিনী এবং পাক সৈন্যদল। রণক্ষেত্রে হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান। ভারত তার অংশীদার নয়। নয়াদিল্লীর মাথা ব্যথা শরণার্থীদের নিয়ে। ওদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্যই দরকার মুক্তিবাহিনীর বিজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। গায়ে পড়ে সে পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। আক্রান্ত হলে অবশ্যই প্রত্যাঘাত হানবে। ইয়াহিয়ার ভারত অভিযান এখনও শুরু হয়নি। এ অভিযান আসন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানের সমর উত্তেজনা এবং সামগ্রিক প্রস্তুতি তার ইঙ্গিতবাহী। যুদ্ধ যখন আসবে তখন ভারতের জরুরী অবস্থা ঘােষণার প্রয়ােজন পড়বে। তার আগে এ ঘােষণার অর্থ, স্বাথান্বেষী বিদেশী শক্তিগুলােকে বাংলাদেশ সমস্যার পাশ কাটাবার সুযােগ দান। শান্তি প্রচেষ্টার আড়ালে ওরা রক্ষা করবে ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্রের নড়বড়ে বুনিয়াদ। আর ইয়াহিয়াও হাতে পাবেন ভারত-বিরােধী প্রচারের হাতিয়ার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ছিড়ে ফেলেছেন মানবদ্রোহীদের শয়তানি জাল। বেকুব বনেছেন ইয়াহিয়া খান।
বেশীদিন আগের কথা নয়। পাক ডিকটেটর সদম্ভে ঘােষণা করেছিলেন ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানের মাটিতে পা দিলেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এই উপমহাদেশে। ভারতের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ করবেন যুদ্ধ ঘােষণা পাক বেতার প্রচার এবং ইয়াহিয়ার প্রলাপে সবাই জেনেছে—পূর্ব বাংলায় ঢুকে পড়েছে ভারতীয় বাহিনী। কাফেররা যুদ্ধ করছে এবং দলে দলে মরছে। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কেন যুদ্ধ ঘােষণা করছেন না ইয়াহিয়া খান? তিনি কি বুঝতে পারছেন না, এরপর পাকিস্তানিরা তাঁকে মিথ্যাবাদী এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী বলে ধিক্কার দেবে? ফ্যাসাদে পড়েছেন পাক ডিকটেটর। তিনি জানেন, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদলের অনুপ্রবেশের অভিযােগ কল্পিত। বহু মিথ্যা কথা বলেছেন তিনি। তাঁর কথায় দুনিয়া আর আস্থাবান নায় আর্তনাদ করে বাজীমাৎ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। কার জোরে তিনি লড়বেন? চীনা নেতারা তর্জন গর্জন করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য বন্দুক ঘাড়ে নেবেন না। ঘরের কাছে তাইওয়ান এবং হংকং যারা উদ্ধার করতে পারলেন না তারা এসে ইয়াহিয়ার জন্য উদ্ধার করবেন বাংলাদেশ? যুদ্ধ বাধলে বৃটেন এবং আমেরিকার ভূমিকা হবে ১৯৬৫ সালের মত। ওরা ভারত এবং পাকিস্তানকে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখবে। এদিকে ইয়াহিয়ার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণকর্মীরা ব্যাঙ্ককে পাড়ি জমিয়েছেন। শেষ রক্ষার তাগিদ পাক-বাহিনী হয়ত ঝাপিয়ে পড়বে কাশ্মীরে। আগামী ক’দিনের মধ্যেই হয়ত জ্বলে উঠবে পশ্চিম সীমান্ত। আত্মতুষ্টির সময় নেই। সামনে সম্ভাব্য মহারণ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে করতে হবে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ। যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটবে জওয়ানদের পাইকারী মার। তার আগে আত্মরক্ষামূলক সীমিত প্রহার। বর্তমানে এ দাওয়াই যথেষ্ট। বাইরের চাপ আসবে। অনমনীয় থাকুন নয়াদিল্লী। ইয়াহিয়ার প্রথম চাল ব্যর্থ। তারপর হয়ত শুরু হবে তার ভারত আক্রমণ। তিনি যে-পথেই পা দিন না কেন, স্বাধীন বাংলাদেশ, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং জঙ্গীচক্রের পতন অনিবার্য। কেউ রােধ করতে পারবে না ইতিহাসের গতি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!