You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | ইয়াহিয়া যুদ্ধে যাচ্ছেন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়া যুদ্ধে যাচ্ছেন

আর দেরী নেই। মাত্র দশটা দিন। ইয়াহিয়া যুদ্ধে যাবেন। আটঘাট সব বাধা। বড় শয়তানী করছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই দলের শক্তঘাটি বাংলাদেশ বেলুচিস্থান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। পূবে আছেন গফুর খানের পুত্র ওয়ালীখান। গত নির্বাচনে ওয়ালী খানের দল বেলুচিস্থান এবং উপর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইয়াহিয়ার কলমের এক আঁচরে ন্যাপ হয়ে গেছে বেআইনী। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের ভাসানীপন্থী, মুজাফরপন্থী, বেলুচিস্থান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ওয়ালীপন্থীরা। ওয়ালী খানের ভাগ্য খারাপ। মাত্র সপ্তাহ দুই আগে বিদেশ সফর করে ফিরে এসেছেন স্বদেশে। ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে তিনি এখন পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু। ভারতের সঙ্গে ওয়ালী নাকি বেধেছেন গাঁটছড়া। ভাসানী এবং অধ্যাপক মুজফর আমেদের তাে কথাই নেই। তারা এখন মুক্তি সংগ্রামের শরিক-ইয়াহিয়ার ধরাছােয়ার বাইরে। পশ্চিম পাকিস্তানের কথা আলাদা। সেখানে শুরু হয়েছে ধর-পাকড়। ওয়ালী খান এখন কোথায় বলা মুস্কিল। যদি গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন তবে শ্রেণী বিভাগে লাগবে গন্ডগােল। এদিকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিচারের জন্য আদালত বসেছে। বিচারকদের ঠিক করতে হবে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু কে? মুজিবর রহমান না ওয়ালী খান। ইয়াহিয়ার মতে দুজনেই এক নম্বর শত্রু। এই পাগলকে সামলান জজদের কর্ম নয়।
যেমনি রাষ্ট্র পাকিস্তান তেমনি তার রাষ্ট্রপ্রধান। কথায় বার্তায় এবং চালচলনে দুই সমান। শ্রীমতী গান্ধীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ইয়াহিয়া খান ভয় দেখিয়ে এই স্ত্রীলােকটি আমাকে নতিস্বীকার করাবে এমন আদমী আমি নই। একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে যিনি এ ধরনের কদর্য ভাষায় সম্বােধন করতে পারের তিনি অবশ্যই দস্যুদলের উপযুক্ত সর্দার। আর এর সঙ্গেই বৃটেন এবং আমেরিকার মিতালী। আসল কথা, বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর মার খেয়ে ইয়াহিয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মুখ থেকে বেরুচ্ছে কেবল অশালীন প্রলাপ। এই জংলীর সঙ্গেই শান্তি বৈঠকে শ্রীমতী গান্ধীকে বসাবার চেষ্টা করছেন হীথ এষং নিকসন। দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধে যেতে তৈরী ইয়াহিয়া। আবার ডিসেম্বর মাসের সাতাশে তারিখে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকতেও তিনি সমভাবে প্রস্তুত। এই দুটি কাজ কি করে এক সঙ্গে চলবে? নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠদল আওয়ামী লীগ বেআইনী এবং ন্যাপ নিষিদ্ধ। পাইকারী হাবে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পােরা হচ্ছে। জেলে। কাদের নিয়ে বসবে অধিবেশন? কত গুলাে ভাড়াটিয়া নিয়ে? সব ভাওতা। লােক ঠকানাের নির্বোদ পায়তারা। আসলে ইয়াহিয়া বলতে চাচ্ছেন—সবাই মিলে আমাকে ঠেকাও। ভারতীয় জওয়ানদের থামাও। নইলে আমি যুদ্ধে যাব। হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব। বেলুচিস্থান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণহত্যা চালা। এ দুটি প্রদেশের বেইমানরা বাংলাদেশের পথ নিচ্ছে। ওরা চায় স্বাতন্ত্র। জঙ্গীচক্রের শাসনের অবসান। ঘরের শত্রু এবং বাইরের শত্রু—উভয়ের বিরুদ্ধে চলবে সংগ্রাম। ঘরের লড়াই শুরু হয়েছে। বাকী আছে বাইরের লড়াই। মাত্র দশটা দিন সময়। এর মধ্যে যদি বৃহৎ শক্তিগুলাে ভারতকে সংযত করতে না
পারে তবে প্রলয়কান্ড অনিবার্য। অতএব আমাকে ধর। হাত ধরে টানাটানি কর। বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে ঠাণ্ডা রাখ। মুখ রক্ষার একটা উপায় বাৎলিয়ে দিলেও সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভাবতে অবাক লাগ, ইয়াহিয়ার মত একজন জবরদস্ত জেনারেল যুদ্ধে যেতে কেন দশদিন সময় নিচ্ছেন? তার ভাষ্য অনুযায়ী ভারতীয় জওয়ানরা তাে পূর্ব বাংলায় ঢুকে গেছে। এই মুহূর্তেই তিনি যুদ্ধে যাচ্ছেন না কেন? কে তাকে পিছু টানছে? বৃটেন এবং আমেরিকা অবশ্যই খুব সক্রিয়। এই উপমহাদেশে যুদ্ধ ঠেকাবার জন্য তারা গলদঘর্ম। স্বস্তি পরিষদের বৈঠক আহ্বানের কথাও নাকি ভাবছে পাক দোস্তরা। সমর্থনের অভাবে নাকি তারা এগুতে পারছেন না। বাংলাদেশ তাে যায় যায়। পশ্চিম পাকিস্তানও ভাঙ্গনের মুখে। ইয়াহিয়ার ইঙ্গি-মার্কিন কর্তারাও দিশাহারা। ভারতকে আটকাবার জন্য একটার পর একটা ফাঁদ তারা পাতছেন। আর নয়াদিল্লী তা ছিড়ে ফেলেছেন। এক কোটি শরণার্থী এবং নিগৃহীত বাংলাদেশের জন্য যারা চোখের জল ফেলার অবকাশ পাননি, তারা আজ অঝােরে কাঁদছেন ইয়াহিয়ার জন্যে। কোন লাভ নেই। ঘরের আগুনে ভাজা ভাজা হচ্ছেন পাক ডিকটেটর। পুড়ে ছাই হবার জন্য দরকার বাইরের আগুন। দশদিন বাদে কেন? এখনই যুদ্ধে আসুন ইয়াহিয়া খান। দেখবেন মারের বহরটা। তিনি জানেন, রণক্ষেত্রে পা দিলে আর ঘরে ফিরতে পারবেন না। তাই বিদায়ের পালাটা আগেই শেষ করে নিচ্ছেন কেউ যদি জাপটিয়ে ধরে রাখে তবে মুখরক্ষ। নইলে সর্বনাশ। কিন্তু সে সম্ভাবনা কম। নিরাশ হবেন না ইয়াহিয়া খান মুজিবরের পায়ে ধরে ক্ষমা চান। বাংলাদেশ থেকে তার ঘাতকদল অপসারণ করুন। পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিন। এ ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। আর যদি যুদ্ধ চান তবে মৃত্যুযাত্রার দামামা বাজান। তার কবর তৈরী। প্রত্যাঘাত হানার জন্য ভারত প্রস্তুত।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ নভেম্বর ১৯৭১