You dont have javascript enabled! Please enable it!

সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দল?

রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে চিঠি দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। ভারতীয় জওয়ানরা নাকি ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। এই উপমহাদেশের অবস্থার নাকি দ্রুত অবনতি ঘটছে। অতএব সীমান্তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠানাে দরকার। তারা নিজের চোখে সব কিছু দেখে রিপাের্ট পাঠাবেন সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে। তারপর কি করবেন উ থান্ট? এ সম্পর্কে কিছুই বলেন নি ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে যখন গণহত্যা চলছিল তখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার দাবী উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। ইয়াহিয়া খান দিয়েছিলেন বাধা। পাকিস্তানে জঙ্গীচক্রের গণহত্যা নাকি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। রাষ্ট্রসঙ্রে তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। ওরা বলেছিলেন, গণহত্যার কথা ভারতের প্রচার। এসব কিছু চলে নি পূর্ব বাংলায়। রাষ্ট্রসঙ্রে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার প্রস্তাব অবাস্তব। সুবােধ বালকের মত পাকিস্তানি যুক্তিতে নতি স্বীকার করেছিলেন উ থান্ট তার মুখ থেকে বের হয় নি কোন নিন্দার ভাষা। এখন কোন মুখে তিনি পর্যবেক্ষক পাঠাবেন সীমান্তে? কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি সীমারেখা লঙ্ঘন করছে পাকিস্তানি সৈন্যদল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল যথারীতি রিপাের্ট পাঠিয়েছেন উ থান্টের কাছে। তিনি একেবারেই নীরব। একবার মুখ ফুটে উ থান্ট বলুন—তার পর্যবেক্ষক দলের প্রেরিত রিপোের্ট সত্য না মিথ্যা। নিজের কলঙ্ক মােচনের জন্য এই রিপাের্টগুলাে প্রকাশের দাবী ইয়াহিয়া খানেরও করা উচিত।
সােজা পথে যাবেন না ইসলামাবাদের শয়তানরা। গেলে, কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে পড়বে সাপ। মুক্তিবাহিনীর মারের চোটে ওদের হয়েছে মাথা খারাপ। দিনের পর দিন প্রলাপ বকছে পাক বেতার। গত ১৪ই এবং ১৫ই নভেম্বর ইয়াহিয়ার প্রচার যন্ত্র ঘােষণা করল—বারটি ভারতীয় ডিভিসন ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। পাক সৈন্যরা তুমুল লড়াই করছে তাদের সঙ্গে। রণক্ষেত্রে গড়াগড়ি খাচ্ছে বিধ্বস্ত ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং জওয়ানদের মৃতদেহ। বিমান পড়েছে ক’খানা। নিহত পাক সৈনিকের সংখ্যা এক ডজনের উপরে উঠে নি। তারপর হয়ত খেয়াল হয়েছে যে, বাংলাদেশে মােতায়েন রয়েছে প্রায় চার ডিভিসন পাক সৈন্য। মাত্র ডজনখানেক সৈন্য খুইয়ে বার ডিভিসন ভারতীয় সৈন্য ঠেকান সম্ভব নয়। তাই ১৮ই এবং ১৯শে নভেম্বর পাক বেতার বলল— কিছুসংখ্যক ভারতীয় সৈন্য ঢুকেছে বাংলাদেশে। ওরা লড়াই চালাচ্ছে এবং যথারীতি মার খাচ্ছে। গত ২২শে নভেম্বর পাক প্রচার যন্ত্রের দাবী মেরে হাড় গুড়িয়ে ভারতীয় সৈন্যদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজেদের এলাকায়। তারপর সামরিক সঙ্গীত। ক’ঘণ্টার মধ্যেই আবার সুর গেল বদলে। মুক্তিবাহিনীর নামে যারা লড়াই করছে তারা আসলে পাকিস্তানি নয়, খাটি ভারতীয় সৈনিক। বিরাট একটা ধাধা। রহস্যের পর রহস্য। ঠেলা সামলান উ থান্ট।
সেক্রেটারী জেনারেল সত্যিই যদি বাংলাদেশে পাঠাতে চান রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল তবে মনে রাখতে হবে তার কতগুলাে কথা। ভারতের মাটিতে পা দিতে পারবে না ওরা। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলাের অধিকাংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে। সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বেশী বাড়াবাড়ি করলে গুলী খেতে হবে। ওদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবে না কেউ। এমন কি, গবর্ণর মালিক পর্যন্ত নিরাপত্তার অভাবে পরিবারবর্গ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসের পরিকল্পনা আঁটছেন। বিদেশীরা ঢাকা থেকে…। কারও হুঁশিয়ারী না শুনে উ থান্ট বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন ত্রাণ সামগ্রী এবং ত্রাণ কর্মিদল। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ত্রাণ সামগ্রী বােঝাই দু’একটি জাহাজ গেছে জলের নীচে। কর্মীরা চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা বলে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যাঙ্ককে। এরপর যদি আসে পর্যবেক্ষক দল তবে তাদের দশা কি হবে? তারা কি পাক সৈন্যাবাসগুলাে থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন? এলে খাবেন গেরিলাদের গুলী। পাক সাজোয়া বাহিনী নিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি এলে ঝাপিয়ে পড়বে ভারতীয় জওয়ানরা। জান নিয়ে পালাতে পারবেন না ওরা। কেন উ থান্ট এদের মরতে পাঠাবেন বাংলাদেশে?আর পাক সৈন্যরা তাে এক একজন অসম সাহসী বীর। পাকিস্তান। চব্বিশ ঘণ্টা তাই বলে চলেছে। ওরা নাকি নিজের ঘর নিজেই সামলাতে জানে। তবে কেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল নিয়ে টানাটানি? বরং ইয়াহিয়া খান নিজেই আসুন বাংলাদেশ সীমান্তে। স্বচক্ষে দেখুন অবস্থা। ফিরে যেতে পারবেন কিনা বলা মুস্কিল। দশদিনের মধ্যে তাে তিনি যুদ্ধে যাবেন। তার পাঁচদিন চলে গেছে। দু’একদিন আগেই তিনি যাত্রা করুন বাংলাদেশে। তাতে তিনি প্রতিশ্রুতিভঙ্গের সম্ভাব্য অভিযােগ থেকেও বাঁচবেন এবং বাংলাদেশে আগমনেচ্ছুক রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকরাও রেহাই পাবেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!