You dont have javascript enabled! Please enable it!

দরকার নেই উ থান্টের মধ্যস্থতার

সক্রিয় হয়ে উঠেছেন উ থান্ট। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল তিনি। তাঁর সজাগ দৃষ্টির সামনে কোথাও শান্তিভঙ্গ হবার জো নেই। যেখানেই দেখা যাবে অশান্তির সম্ভাবনা সেখানেই একটা কিছু করার জন্য উঠে পড়ে লাগবেন উ থান্ট। পদাধিকার বলে তিনি গােটা বিশ্বের অতন্ত্র প্রহরী এবং নিরপেক্ষতার মূর্তিমান প্রতীক। সম্প্রতি পাক-ভারত সীমান্তে চলছে সামরিক উত্তেজনা। চঞ্চল হয়ে পড়েছেন সেক্রেটারী জেনারেল। একটু কিছু না করলে হয়তাে বেধে যাবে লড়াই। বিপন্ন হবে বিশ্বশান্তি। তাই উ থান্ট গা ঝাড়া দিয়েছেন। তিনি নাকি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য উদগ্রীব। বুদ্ধিমান ব্যক্তি রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল। অবশ্যই তিনি জানেন, সাম্প্রতিক পাক-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার প্রধান কারণ বাংলাদেশ। সেখানে ইয়াহিয়ার তাণ্ডব এবং তার অত্যাচারে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ভারতে আগমন। যখন পুর্ব বাংলায় সুরু হয়েছিল পাক-বাহিনীর গণহত্যা তখন নিঃসন্দেহে ইসলামাবাদ ভেঙ্গেছিলেন রাস্ট্রসংঘের সনদের বহু বিঘােষিত আদর্শ। আদর্শনিষ্ঠ উ থান্ট ভুলে গিয়েছিলেন সেদিন আদর্শের কথা। বলেছিলেন-ওটা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। শরণার্থীরা আসতে লাগলেন ভারতে। তাদের সাহায্যের জন্য বিশ্বময় আবেদন জানালেন। তিনি। যারা তাদের এখানে পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও ফুটল না তার মুখে। প্রতিষ্ঠিত হল বাংলাদেশ সরকার। মুক্তিবাহিনীর হাতে নাজেহাল হতে লাগল পাক-বাহিনী। ইয়াহিয়ার অভিযােগ, মুক্তিবাহিনী আসলে ভারতের সাহায্যপ্রাপ্ত হানাদার। তিনি সীমান্ত বরাবর করলেন সৈন্য সমাবেশ। তার ধারণা, এতে বাড়বে পাক-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা। আসরে নামবে রাষ্ট্রসংঘ কিম্বা অপর কোন তৃতীয় রাষ্ট্র।
উত্তেজনা প্রশমনের নামে চলবে পাক-ভারত আলােচনা। বাংলাদেশ সমস্যা রূপ নেবে পাক-ভারত বিরােধে। ভারতে আগত শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সমস্যা এবং বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার নৃশংসতার কাহিনী পড়বে ধামাচাপা। এতসব ঘটনা যখন ঘটছিল তখনও উ থান্ট ছিলেন নীরব দর্শক।
আত্মরক্ষার তাগিদে ভারত সীমান্তে সাজাল সৈন্যদল। টনক নড়ল উ থান্টের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বললেন-যতদিন শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযােগ না পাবেন ততদিন সীমান্তে থাকবে ভারতীয় বাহিনী। মহা ফ্যাসাদে পড়েছেন ইয়াহিয়া খান। ভারতীয় জাওয়ানদের মুখােমুখী দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সৈন্যদল। গ্রামাঞ্চলে তাদের ছড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। এই সুযােগ নিচ্ছে মুক্তিবাহিনী। ওরা খতম করছে বিচ্ছিন্ন পাক-সৈন্য এবং রাজাকারদের। এদের রক্ষার জন্য সীমান্ত থেকে যেতে পারছে না কোন সাহায্যকারী পাক সৈন্যদল। ইয়াহিয়া ঘােষণা করেছেন- সীমান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসৃত হলেই তিনি সরিয়ে নেবেন পাক-বাহিনী। এ অবস্থা কার্যকর করতে পারলেই সম্ভব হয়ে উঠবে মুক্তিবাহিনীর উপর তাঁর সর্বাত্মক আক্রমণ। এর জন্য দরকার তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা। তাতে লাভ হবে দুটি-বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে পরিণত করা চলবে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীকেও নির্মূল করা যাবে। ইয়াহিয়া যখন প্রথমে চেয়েছিলেন পুরানাে দোস্ত ইরানের মধ্যস্থতা, তারপর আমেরিকার, তারপর বৃটেনের এবং তারপর ত্রিশক্তির (বৃটেন, আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার)। হালে পানি পাননি ইয়াহিয়া খান। কোন মধ্যস্থতার প্রস্তাবে পাত্তা দেয়নি ভারত। সােভিয়েট রাশিয়ার কথা স্বতন্ত্র। ভারতের সঙ্গে সে এখন মৈত্রীচুক্তিতে বাঁধা। বাংলাদেশ সমস্যার মূল্যায়নে মস্কো-নয়াদিল্লীর মতামত প্রায় অভিন্ন। তাসখন্দ চুক্তির পরিণাম দেখে সতর্ক হয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। তার মধ্যস্থতার প্রশ্ন এখন উঠে না। আশা ছাড়েনি বৃটেন এবং আমেরিকা। ইয়হিয়াকে বাঁচাবার জন্য জান-প্রাণ কবুল করেছে তারা। এদের ইঙ্গিতে উঠছেন এবং বসছেন রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট। মধ্যস্থতার নামে ইয়াহিয়া খানকে পরােক্ষ মদৎ দিতে চাচ্ছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ধরে ফেলেছেন এই কূট চাল। পাক-স্বার্থে উ থান্টকে ব্যবহার করার কসরত আঁটছে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমী সাকরেদরা। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল আত্মসমর্পন করেছেন তাদের কাছে। শ্রীমতী গান্ধী স্পষ্টই বলেছেন, উ থান্টের কোন প্রয়ােজন নেই মধ্যস্থতা করার।
উ থান্টের একদর্শিতা নতুন নয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই-এর সময় পাওয়া গেছে তার নমুনা। কাশ্মীর সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দলের নেতা ছিলেন তখন নিম্মি। তাঁর রিপাের্টে বলা হয়েছিলআরম্ভ করেছে পাকিস্তান। বৃটিশ ইঙ্গিতে উ থান্ট চেপে রেখেছিলেন এ রিপাের্ট। এবারও সংবাদ বেরিয়েছেকাশ্মীরে গ্রাউণ্ড রুল মানছেন না ইসলামাবাদ। যুদ্ধ-বিরতি সীমারেখার অতি কাছে ঘটি শৃঙ্খল বানাচ্ছেন তাঁরা। রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দল নাকি এ মর্মে পাঠিয়েছেন রিপাের্ট। এই উদ্বেগজনক খবর যদি সত্যি হয় তবে প্রতিকারের কি ব্যবস্থা নিয়েছেন উ থান্ট তা জানার আগ্রহ ভারতের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আর সত্যি না হলে রাষ্ট্রসংঘ থেকেই তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্বসভা নীরব। উ থান্টের মধ্যস্থতার প্রস্তাব গ্রহণে পাকিস্তান রাজী এবং ভারত গররাজী-এ নিয়ে হৈ চৈ করছে স্বার্থান্বেষী বিদেশী মহল। ওরা দেখাতে চাচ্ছেনইয়াহিয়া কত শান্তিপ্রিয়। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পাক-ভারত বিরােধ মিটাতে তিনি কত আগ্রহী। ইসলামাবাদের আসল মতলব স্বার্থান্বেষীরা জেনেও না জানার ভান করলে বলার কিছু নেই। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট অবশ্যই জানেন-সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু কোথায় নিহিত। ওটা পাক-ভারত সীমান্তে নয়, বাংলাদেশে। ওখানে যুধ্যমান পক্ষ বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদ। ভারতে আগত শরণার্থী ইয়াহিয়ার সৃষ্টি। বাংলাদেশের সমস্যা মিটলেই ওরা ফিরে যেতে পারবেন স্বদেশে। উ থান্ট যদি শান্তি চান তবে ভারতে না এসে চলে যান পাকিস্তানে। করুন বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা। তাতে যদি সার্থক হন তবে কমবে পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। আর যদি ব্যর্থ হন তবে উত্তেজনা চলবে। শরণার্থীদের নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকবে না ভারত। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পথ প্রশস্ত করাই হবে নয়াদিল্লীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। শরণার্থীদের কল্যাণেই তার দরকার।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!