ভারতের পাশে সােভিয়েট রাশিয়া
ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। ফেরুবিনের দিল্লী সফরান্তিক যুদ্ধ বিবৃতিতে পাওয়া গেছে তার প্রমাণ। সীমান্তের ওপার থেকে ইয়াহিয়া খান দিচ্ছেন যুদ্ধের হুমকি। ভারতের উপর আঘাত হানতে পাকিস্তান তৈরি। এই অবস্থায় সােভিয়েট উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেরুবিন এসেছিলেন ভারতে। চারদিন ধরে চলেছিল ভারত-সােভিয়েট আলােচনা। মস্কো নেতারা স্বীকার করেছেন, ভারতের উপর পাকআক্রমণের আশঙ্কা বাস্তব। ভারত-সােভিয়েট মৈত্রীচুক্তির নয় নম্বর ধারা কার্যকর করার সময় আগত। এই ধারায় বলা হয়েছে- চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র দু’টির যে-কোন একটি আক্রান্ত হলে কিম্বা আক্রান্ত হবার আশঙ্কা দেখা দিলে অবিলম্বে তারা আলােচনায় বসবে। এই আশঙ্কা দূরীকরণের জন্য প্রয়ােজনীয় এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। ভারতের উপর পাক আক্রমণের হুমকী আছে বলেই দরকার পড়েছিল এই আলােচনার। সাম্প্রতিক পর্যায়ের সলা-পরামর্শই শেষ কথা নয়। এটা শুধু সূচনা। ভবিষ্যতে দফায় দফায় আলােচনা চলবে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই এক প্রতিনিধিদল নিয়ে নয়াদিল্লী আসবেন সােভিয়েট চীফ এয়ার মার্শাল কুতনব। এই সফরের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সামরিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সম্ভাব্য পাক-আক্রমণ প্রতিরােধে ভারতকে কিভাবে সাহায্য করতে পারে সােভিয়েট রাশিয়া হয়ত তাই হবে সােভিয়েট সামরিক প্রতিনিধিদলের আলােচ্য বিষয়। মনে হয়, চুক্তির মর্যাদা রক্ষায় মস্কো নেতারা দৃঢ়-সংকল্প।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হলে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, এই সমাধানের অর্থ -১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে ক্ষমতা অর্পণ এবং পূর্ববাংলা থেকে পাক বাহিনীর অপসারণ। মস্কো নেতারাও কার্যতঃ মেনে নিয়েছেন এ ব্যাখ্যা। গত সাত মাস ধরে তারা লক্ষ্য করেছেন ইয়াহিয়া খানের গোঁয়ার্তুমী। কারও অনুরােধ-উপরােধে কান দেননি তিনি। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তের বদলে ভারত সীমান্তে তিনি করছেন সৈন্য সমাবেশ।
ইয়াহিয়া খান দেখাতে চাচ্ছেন- বাংলাদেশ সমস্যা আসলে পাক-ভারত বিরােধ। দুনিয়াকে ধোঁকা দেবার ষড়যন্ত্র আঁটছেন তিনি। আত্মরক্ষার জন্য নয়াদিল্লী চালাচ্ছেন সামরিক প্রস্তুতি। পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়ন করেছে সােভিয়েট রাশিয়া। তার দৃষ্টিতে, এই অবাঞ্চিত অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী ইসলামাবাদ। অপর পক্ষে সমস্যার আসল প্রকৃতি এড়িয়ে যাচ্ছে পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলাে এবং আমেরিকা। ভারত এবং পাকিস্তানকে একই পর্যায়ে ফেলে উভয়ের উপর উপদেশ বর্ষণ করছেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ। মধ্যস্থতা, সংযম, সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দল মােতায়েন প্রভৃতি হরেক রকমের প্রস্তাব শূন্যে ছুঁড়ছে আমেরিকা। একে একে তা লুফে নিচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ছে বৃটেন। তালে তালে নাচছেন রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান কি করে হবে এবং কিভাবে শরণার্থীরা ফিরবেন স্বদেশে-এ কথাগুলাে সবসময়ই থাকছে অনুক্ত। অথচ এসব প্রশ্নের সদুত্তর এবং তার কার্যকর ব্যবস্থা ছাড়া পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা প্রশমন অসম্ভব। মূল আসামী ইয়াহিয়া খান। পাক-ভারত উপমহাদেশের শান্তি তার উপর নির্ভরশীল। এখানেই সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রের পার্থক্য স্পষ্ট।
ইয়াহিয়া খান বলেছেন, সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরাতে রাজী হলে পাকিস্তানও অনুরূপ ব্যবস্থা নেবে। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশের যদি কোন দরকার না থেকে থাকে তবে প্রথমে তিনি সীমান্ত বরাবর সৈন্য সাজালেন কেন? যখন তিনি এ কাণ্ডকারখানা করতে গেলেন তখন আমেরিকা কিম্বা অপর কোন পশ্চিমী রাষ্ট্র তাকে হুঁশিয়ারী দিল না কেন? আজ যেভাবে তারা পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনায় আর্ত চীৎকার করছে সেদিন তারা এমনিভাবেই কলরব তুললে হয়ত বর্তমান পরিস্থিতিটাই সৃষ্টি হত না। ওদের ছিল কুমতলব এবং বাংলাদেশ সমস্যা চাপা দেবার অপকৌশল। ষড়যন্ত্রের প্রথমপর্বের আয়ােজন ব্যর্থ করেছেন নয়াদিল্লী। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন-যতদিন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হবে এবং শরণার্থীরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ না পাবেন ততদিন সীমান্তে মােতায়েন থাকবে ভারতীয় বাহিনী। নয়দিল্লীর এই কঠোর মনােভাব জোগাবে মুক্তিবাহিনীর প্রেরণা। দখলদার পাক-বাহিনীর উপর তাদের আঘাত হবে জোরদার। ইয়াহিয়া খান যেখানে বেপরােয়া এবং অপরিণামদর্শী সেখানে মুক্তিবাহিনীই শরণার্থীদের ভরসা। ওদের সার্থক অভিযানই দেবে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযােগ। দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণা-যুদ্ধ প্রস্তুতিই যুদ্ধ নিরােধের শ্রেষ্ঠ উপায়। এই পথই বেছে নিয়েছে ভারত। সােভিয়েট রাশিয়া তাকে দেবে মদৎ। এটাই মৈত্রীচুক্তির নয় নম্বর ধারায় প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। এরপর কি ইয়াহিয়ার সম্বিত ফিরবে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ অক্টোবর ১৯৭১