You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.31 | শরণার্থী শিবিরে দুর্নীতি | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থী শিবিরে দুর্নীতি

দুর্নীতি কথাটা আমাদের গা-সহা হয়ে গেলেও বাংলাদেশের শরনার্থী শিবিরে দুর্নীতি ও অসততার সংবাদের প্রতি নিস্পৃহ থাকা বােধ হয় সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। আমাদের ঘূণ-ধরা সমাজের একটি বিষন্ন চিত্রই এতে ফুটে ওঠে। মানুষের দুর্ভাগ্যে বিচলিত না হয়ে যারা একে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বােধ করে না তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্র-পরিচালকদের আরও কঠোর হবার সময় এসেছে। সীমান্তের ওপারের পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযােগী দালালদের অত্যাচারে নিরুপায় হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় এই শরণার্থীরা জ্ঞান ও মান বাঁচাবার আশা নিয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এরা সাধারণ গরীব মানুষ। ঘর-বাড়ি ফেলে এসে অবস্থার বিপাকে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে শিবিরে এরা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়েছে। অনেকের স্ত্রী-কন্যা লাঞ্চিত হয়েছেন, বর্বর পাকিস্তানিদের হতে। এদের প্রতি যদি করুণা না হয় তাে আর কোন্ দুর্ভাগাদের জন্য আমরা অশ্রু বিসর্জন করব? অথচ এই ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষগুলােকে প্রতারিত করে এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেও কিছু কিছু অসৎ ব্যক্তির বিবেকে বাধছে না। এর চেয়ে লজ্জা আর পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পরে? পশ্চিম বাংলার কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে এ ধরনের দুর্নীতি নিয়মিত ঘটছে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে আমরা তার প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
প্রকাশিত সংবাদে কল্যাণী হরিণঘাটা এলাকার কয়েকটি শরণার্থী শিবিরের ভেতরকার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শিবির পরিচালনা ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের দায়িত্ব যাদের ওপর তারাই রক্ষকের বেশে ভক্ষক হয়ে দুর্ভাগা শরণার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট রেশনে ভাগ বসাচ্ছে। মাথাপিছু যে পরিমাণ রেশন -চাল, গম ও ডাল দেবার কথা তা থেকেই চলছে নিয়মিত ও সুপরিকল্পিত চুরি ওজনে কম দিয়ে। শুধু তাই নয় শরণার্থীদের নামে ভুয়া রেশনকার্ড হাজারে হাজারে তৈরি করে বিপুল পরিমাণ রেশন পাচার করা হচ্ছে। এই ডামাডােলের বাজারে কে শরণার্থী, কে শরণার্থী নয় তার বিচার করবে কে? সরকারি মাল এবং বিদেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী উভয়ের প্রতিই এই দুর্নীতিপরায়ণ সেবকদের সমান দৃষ্টি। বিদেশ থেকে আসা রান্নার তেল যা শরণার্থীদের দেবার কথা তার একটা মােটা পরিমাণ চলে যায় শরণার্থী শিবিরের একজন বিশিষ্ট স্টাফের কোয়ার্টারে। কে কাকে ধরে? শরণার্থীদের সামলাতেই সরকার হিমসিম খাচ্ছেন। তার ওপর যদি চোরের ওপর তদারকী করতে হয় তাহলে তা বেচারারা যাও পাচ্ছে তাও পাবে না।
কিন্তু না এভাবে বিষয়টিকে এভাবে দেখলে চলবে না। এই নির্লিপ্ততা হবে মারাত্মক। সীমান্তের ওপার থেকে আসা এই মানুষগুলাের জন্য কোটি কোটি টাকা সরকার ব্যয় করছেন। বিদেশ থেকেও আসছে সাহায্য। শুধু তাই নয় এই সমস্যার প্রতি আমরা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক সব দিকেই। আমরা জানি, নব্বই লক্ষ শরণার্থীর চাপ সামলানাে সােজা কথা নয়। কিন্তু তা বলে কতকগুলাে দুর্নীতিপরায়ণ, বিবেকশূন্য, অসৎ ব্যক্তির হাতে এদের দায়িত্বভার দিয়ে সরকার কোনাে মতেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না। যদি থাকেন তবে আরও বিপদই ডেকে আনা হবে। সংকটের সময়ে সবচেয়ে যা প্রয়ােজন তাহল জনসাধারণের দৃঢ়সঙ্কল্প, সততা, পারস্পরিক সহযােগিতা। দুঃখের বিষয়। সরকার যুদ্ধ আসন্ন বলে দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ করে দিলেও আমাদের ঘুণ-ধরা সমাজে তার কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। আশংকা হয়, বাংলাদেশের হতভাগ্য শরণার্থীদের খাবার, ওষুধ বা কম্বল যারা নির্বিবাদে চুরি করতে পারে যুদ্ধের সময় রণাঙ্গণের জন্য নির্দিষ্ট সামগ্রী ও তারা অনায়াসে কালােবাজারে বিক্রী করে মুনাফা লুঠতে পারে। এ ধরনের নজীর এদেশে বিরল নয়। ১৯৬২ সালে চীনা যুদ্ধের সময় তা ঘটেছিল। তাই সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন এই দুর্নীতি কি চলতে থাকবে? দুর্নীতির সঙ্গে ক্রমাগত সহঅবস্থানের ফলেই আজ আমাদের সমাজের এই দশা। কাগজে-কলমে পুঁথি-পত্রে নীতিকথার অন্ত নেই। কিন্তু লােভী, অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণদের হাতে প্রতিদিনই চলছে নীতিবাক্যের দফা-রফা। সরকার কি এরপরও চুপ করে থাকবেন? এই দুর্নীতি বন্ধ করার ক্ষমতা কি সরকারের নেই? শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ, দেশের সুনাম ও নিরাপত্তার স্বার্থেই এই দুর্নীতির মূলােচ্ছেদ করা অবিলম্বে দরকার।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ অক্টোবর ১৯৭১