You dont have javascript enabled! Please enable it!

এই যদি আমাদের আয়ােজন হয়

শুক্রবারের শেষ সকালে বিমান আক্রমণের সাইরেনের মহড়ার সময় কলকাতা শহরের চিত্রটি যদি কোনাে কিছুর ইঙ্গিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে একটি কার্যকর অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে আমরা এখনাে অনেক দূরে। লােকজন দিব্যি ঘুরে বেড়াছিল, মুখে রুমাল দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়া তাে দূরের কথা ঘরবাড়ীর ভেতরে ছিল, একতলায় কোনাে নিরাপদ ঘরে গিয়ে জড়াে হবার বদলে তারা বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল, মজা দেখবার জন্যে। গাড়ী-ঘােড়া, ট্রাম-বাস সঙ্কেতমাত্র দাঁড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু যে যার মত ঠিক চলেই যাচ্ছিল, যতক্ষণ না কোনাে চৌরাস্তার মােড়ে এসে দাঁড়িয়ে যায়। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে যদি কোনাে কিছুর ছাপ স্পষ্ট ছিল তবে একটা কৌতুকমিশ্রিত নির্লিপ্ততায়, এবং যদি কোনাে নির্দিষ্ট কৃতিত্ব ছিল তবে চৌরাস্তার মােড়ে মােড়ে ট্রাফিকের বিশাল জট সৃষ্টির, যা ছাড়তে অনেক জায়গাতেই বেশ কিছু সময় লেগেছিল। অথচ আমরা এর আগে পর পর দু দুটো জরুরী অবস্থা অতিক্রম করে এসেছি- ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে। অসামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা আমাদের কাছে একটা অজানা অচেনা কিন্তু কিছু মনে হবার কথা নয়। তাছাড়া খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আর রেডিও থেকে প্রচার করে ব্যাপারটা প্রতিদিনই মানুষকে জানাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং আকাশ থেকে বােমা পড়লে গদাইলস্করী চালে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানােটা যে নিরাপদ নয় সেটা না বুঝতে পারার মত নির্বোধ সম্ভবত কেউই নয়। তবুও কেন একটি যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সম্পর্কে এতখানি উদাসীনতা, এতটা শৃঙ্খলাবােধের অভাব? হতে পারে এটা প্রথম মহড়া, কিন্তু প্রথম মহড়াই বা এতখানি বিশৃঙ্খল হবে কেন যাতে চৌরাস্তার মােড়ে মােড়ে ট্রাফিক পুলিশের হাত না দেখলে কেউ দাঁড়াবার প্রয়ােজনীয়তাই অনুভব করবে না। যুদ্ধ না হতে পারে। মহড়া হলেই যে যুদ্ধ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু যুদ্ধ যদি সত্যিই আসে তাহলে এই রকম একটা কর্তব্যবােধহীন জনতা নিয়ে আমরা কি করব?
স্পষ্টতই জনসাধারণ অসামরিক প্রতিরক্ষার বর্তমান উদ্যোগকে এখনাে পর্যন্ত গুরুত্বের সংগে নেয় নি। এটা মূলত তাদেরই দোষ। কিন্তু এটা কি তাঁদেরও দোষ নয় যাদের ওপর অসামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারটি সুসংগঠিত করার দায়িত্ব রয়েছে? ১৯৬২ সাল থেকে অসামরিক প্রতিরক্ষার জন্যে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কেবল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার কিম্বা আকাশবাণী থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের বাইরে আর কিভাবে জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর যােগাযােগ স্থাপন করা যায় তা ঐ সংগঠনের জানা থাকার কথা। পাড়ায় পাড়ায় ওয়ার্ডেনের দপ্তরের সাইন বাের্ডও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ঐসব সাইন বাের্ড আর প্রতিদিন সকাল ন’টার সাইরেনের বাইরে আর কিভাবে ঐ সংগঠন জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে কাজ করেছে বা করছে? একথা মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, কোনাে কোনাে জায়গায় ওয়ার্ডেনের সাইন বাের্ড আছে কিন্তু ওয়ার্ডেন নেই, এবং যেখানে ওয়ার্ডেন আছেন সেখানেও তার ওপর কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে কোনাে বিশদ নির্দেশ নেই। যে-কোনাে অসামরিক প্রতিরক্ষায় নাগরিকদের একটা ট্রেণিং দেবার ব্যবস্থা থাকে। তার কোনাে ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা হয়েছে বলে আমরা জানি না। বিভিন্ন অফিস বা সংস্থার মধ্যেও সাধারণত প্রতিরক্ষার ছােট ছােট সংগঠন সাধারণত গড়ে তােলা হয়ে থাকে। সে ব্যবস্থাও দৃশ্যত অসম্পূর্ণ। সাধারণ নাগরিক দূরের কথা, অফিসের কর্তৃপক্ষের মধ্যেও এ সম্পর্কে কোনাে তাগিদ সঞ্চারিত হয়েছে বলে মনে হয় না। নইলে শুক্রবার সকালে অন্তত ট্রাম বা বাসের ড্রাইভাররা আরও বেশী দায়িত্ববােধের পরিচয় দিতে পারতেন। এই যদি আমাদের আয়ােজন হয় তাহলে মহড়া করা বা না করার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!