You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.02 | পাক হাই কমিশনের ধুর্তামী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাক হাই কমিশনের ধুর্তামী

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশী দূতাবাসগুলাে স্থানীয় পুলিশের এক্তিয়ারের বাইরে। এখানে কোন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি আশ্রয় নিলে দূতাবাসে ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট দূতাবাস কর্তৃপক্ষের সহযােগিতা। তা পাওয়া না গেলে দূতাবাসের উপর কড়া দৃষ্টি রাখা ছাড়া উপায় নেই। আসামী বাইরে এলেই তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য তৈরী থাকা আবশ্যক। বিদেশী দূতাবাসের এসব মুযােগসুবিধার অপব্যবহার করছে পাকিস্তান। বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম শুরু হবার পর পূর্ব সীমান্ত পথে জনাকয় ইয়াহিয়া ভক্ত পাক অফিসার সপরিবারে ঢুকেছিলেন নয়াদিল্লীত। সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন পাক হাইকমিশনে। ভারতের বাইরে ওদের পাঠাবার মতলব আঁটছেন পাক হাইকমিশন। টনক নড়েছে নয়াদিল্লীর। পররাষ্ট্রমন্ত্রক ভারতের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলােকে জানিয়ে দিয়েছেন তারা যেন নয়াদিল্লীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ভারত ত্যাগের ছাড়পত্র ইস্যু না করেন। এসব ক্ষেত্রে নিয়মমাফিক যা করণীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রক তাই করেছেন। এই কঠোরতা সত্ত্বেও খাচা থেকে পাখি উড়ে যাবে কিনা তা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। অতীতের অনেক তিক্তঘটনার নজীর এখনও মনে আছে অনেকের। হায়দরাবাদে পুলিশ এ্যাকসনের পর গৃহবন্দী ছিলেন নিজামের প্রধানমন্ত্রী নায়েব আলি। সবার চোখে ধুলাে দিয়ে তিনি সপরিবারে পালিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। কাশীরের জেল থেকে পাক-দরদী কয়েদীদের পালাবার ঘটনাও বিরল নয়। এসব উদাহরণ থেকে কর্তৃপক্ষের শিক্ষা নেওয়া উচিত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা তারা যত নিচ্ছিদ্র মনে করেন আসলে ততখানি নাও হতে পারে।
হয়ত শরণার্থীদের ছদ্মবেশ পাক অফিসাররা ঢুকেছিলেন ভারতে। পুলিশের অজান্তে পাড়ি জমিয়েছেন। নয়াদিল্লীতে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তালিকা আছে দু’শ একানব্বই জনের। এই তালিকার বাইরে অবশ্যই রয়েছেন অনেক অবাঞ্ছিত পাক-নাগরিক। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরেই তাদের খুঁজে বার করা জরুরী প্রয়ােজন। জনসাধারণের সহযােগিতা ছাড়া একাজ এসজসাধ্য নয়। সীমান্তে চলেছে সামরিক উত্তেজনা। এসময় আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, পশ্চিমবাংলা এবং কাশ্মীরে গুপ্তচরদের তৎপরতা খুবই স্বাভাবিক। ওদের অন্যতম প্রধান কর্মক্ষেত্র কলকাতা। ভাড়াটিয়া দেশী, বিদেশী, পাকিস্তানি সবই আছে এই গােয়েন্দাচক্রে। অনেক বেসরকারি সংস্থাও ভারত প্রেমিকের ছদ্মবেশে চালাচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ মহলও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অভিনব এসব চক্রীর কার্যকলাপ এবং প্রচার-কৌশল। নিজের অজান্তেই নীতি রূপায়ণে পদে পদে ঘটে অসুবিধা। জাতির সঙ্কট মুহূর্তে সধার, বিশেষ করে সীমান্তের নাগরিকদের অতি সতর্কতা খুবই কাম্য। সম্প্রতি সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে চলেছে পাকনাশকদলগুলাের তৎপরতা। এক শ্রেণীর স্থানীয় অধিবাসীর সাহায্য না পেলে এদের পক্ষে কাজ হাসিল করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি করিমগঞ্জের একটি অঞ্চলে বসান হয়েছে পিটুনিকর। ভ্রুক্ষেপ করেছেন না স্থানীয় অধিবাসীরা। দেশী বিভীষণদের জন্য দরকার আরও কঠোর ব্যবস্থা। ডামাডােলের মধ্যে হয়ত শরণার্থী বাছাই হয়ে উঠে নি। যুদ্ধের মুখােমুখী দাঁড়িয়ে আর কালহরণ চলে না। লড়াই বাধলে পাক-এজেন্টেদের কাজ হবে মারাত্মক। যাঁরা শরণার্থী শিবিরে আছেন নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পুলিশে দেওয়া তাদের আবশ্যিক কর্তব্য। প্রশাসনে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাক-দরদীদের কতখানি অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা খতিয়ে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃমহলকে। জঞ্জাল বাছার কাজ আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ কমবে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদারতা মাত্রাহীন। মনে হয়, সামনের দিকে চেয়ে কাজ করতে তারা অভ্যস্ত নন। যেসব পাকিস্তানি নাগরিক বেআইনীভাবে ভারতে ঢুকেছেন তাদের মধ্যে চারজনের একটি পরিবারকে নাকি ভারত ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর একটির সম্পর্কে নাকি সরকার বিবেচনা করছেন। এই উদারতা দেখাবার আগে কর্তৃপক্ষ কি সন্ধান নিয়েছেন, অনুরূপভাবে আটক ভারতীয় বন্দীদের উপর কি ধরনের ব্যবহার করছে পাকিস্তান? আটক ভারতীয়দের সঙ্গে ভারতীয় হাই-কমিশনকে যােগাযােগ করতে দিচ্ছেন না। ইসলামাবাদ। যেখানে হওয়া উচিত বন্দী বিনিময় সেখানে ভারত দেখাচ্ছে একতরফা ঔদার্য। গােয়ার মুক্তির পরও ভুল করেছিলেন নয়াদিল্লী। পাইকারীহারে তারা ছেড়ে দিয়েছিলেন পর্তুগীজ বন্দীদের। যখন হচ্ছিল মানবতাবােধের প্রদর্শনী, তখন পর্তুগীজ কারাগারে মুক্তির দিন গুনছিলেন জনাকয় মুক্তিযােদ্ধা গােয়ানীজ। তাদের কথা খেয়াল ছিল না কারও। এদের মুক্তির জন্য অনেক কাঠখড় পােড়াতে হয়েছিল। কর্তৃপক্ষকে। মুক্তি এসেছিল ক’বছর পরে। পাকিস্তানের বেলায়ও নয়াদিল্লী করছেন অনুরূপ ভুল। যেসব পাকিস্তানি বেআইনীভাবে ঢুকেছেন ভারতে এবং রয়েছেন পুলিশ হেফাজতে তাদের সম্পর্কে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। তারা যদি ইয়াহিয়ার আনুগত্য অস্বীকার করে থাকে তবে অবশ্যই ভারতে পেতে পারেন রাজনৈতিক আশ্রয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের ফিরে যাবার প্রশ্ন আপাততঃ আসে না। কিন্তু যারা ব্যতিক্রম তারা আসামী এবং দণ্ডপ্রাপ্তির উপযুক্ত। পাক-হাইকমিশন অন্যায়ভাবে যাদের আশ্রয় দিয়েছেন তারা যেন কিছুতেই ইসলামাবাদে ফিরে যেতে না পারেন। জাল ফেলে রাখতে হবে চারদিকে। বাইরে এলেই ওদের গ্রেপ্তার প্রশাসনিক কর্তব্য। নয়াদিল্লীর সামনে এই পকধূর্তামী একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর মােকাবিলাতেই প্রমাণ পাওয়া যাবে ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতখানি নিচ্ছিদ্র।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ নভেম্বর ১৯৭১